শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

মৃত্যুদণ্ড কোনও সমস্যার সমাধান নয়

তসলিমা নাসরিন

মৃত্যুদণ্ড কোনও সমস্যার সমাধান নয়

শিশু ধর্ষণে ভারতের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। প্রতিদিন শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চলছে। শুধু ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণের খবর আসছে। ছয় মাসের শিশুকেও রেহাই দিচ্ছে না ধর্ষকরা। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে, মাথায় পাথর মেরে, গলা কেটে হত্যা করছে শিশুদের। বীভৎস এমন অপরাধের শাস্তি, অধিকাংশ মানুষই বলছে, মৃত্যুদণ্ডই শ্রেয়। বেশ কিছুদিন যাবৎ ভারতবর্ষে আন্দোলন চলছে শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে, জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায় আট বছর বয়সী এক মেয়েকে অপহরণ করে গণধর্ষণ করেছে কয়েকটি পুরুষ, তারপর খুন করে ফেলে রেখেছে জঙ্গলে। ধর্ষক আর খুনিদের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া চার্জশিট থেকেই মূলত মানুষ জানতে পেরেছে কী অকথ্য নির্যাতন চলেছে একটি নিরীহ শিশুর ওপর। ভারতে এখন ১২ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুকে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন আনা হচ্ছে। ভারত সরকার যে জনতার আর্জি শুনেছেন, ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, এ অধিকাংশ শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীকে স্বস্তি দিয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডের আইন বহাল করা নিয়ে যখন তোড়জোড় চলছে, মনে পড়লো ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কথা, হেতাল পারেখ নামের একটি ১৪ বছর বয়সী স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ এবং হত্যা করার জন্য ২০০৪ সালে যে লোকটির ফাঁসি হয়েছিল! পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য ধনঞ্জয়ের ফাঁসির জন্য এমন জোর আন্দোলন করেছিলেন, মিডিয়াও সঙ্গে ছিল তাঁর যে, শেষ অবধি ফাঁসি দিতেই হলো ধনঞ্জয়কে। ধনঞ্জয় এবং তার ফাঁসি নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি মুক্তি পেয়েছে গত বছর, ওতে দেখানো হয়েছে ধনঞ্জয় যে দোষী, তার কোনও প্রমাণ নেই। হেতাল পারেখকে আসলে মেরেছেন তার মা, ওটি এক ধরনের ‘অনার কিলিং’। ধনঞ্জয় নির্দোষ এমন কথা তখন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বলেছিল। বলেছিল ধনঞ্জয় গরিব বলে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি জানি না ধনঞ্জয় আসলে নির্দোষ কিনা, তবে এরকম ঘটনা যে ঘটে না তা নয়, ঘটে। নির্দোষকে ফাঁসি দেওয়ার পর আসল দোষীর দেখা মেলে। তখন, সবাই বুঝি যে, বড্ড দেরি হয়ে যায়। নির্দোষকে আর বাঁচিয়ে আনা সম্ভব হয় না। কত নিরপরাধ কত নির্দোষ জেলে পচে মরছে। টাকার অভাবে ভালো উকিল জোগাড় করতে পারেনি। কত অপরাধী ঘুরে বেড়াচ্ছে, আনন্দে স্ফূর্তিতে বেঁচে আছে। আমাদের তো বৈষম্যের সমাজ। যার টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, খ্যাতি আছে, সে অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। নীরব মোদী ১৩ হাজার কোটি টাকা চুরি করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে দেশ থেকে, আর ১৩ হাজার টাকা চুরির অপরাধে কেউ নিশ্চয়ই জেল খাটছে। পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই অভিযোগ করে সংখ্যালঘুদের ফাঁসানো হয়। পাকিস্তানের এক গরিব খ্রিস্টান মহিলা আসিয়া বিবিকে এক দল খ্রিস্টান বিরোধী মুসলিম-মৌলবাদী চক্রান্ত করে ব্লাসফেমির অভিযোগ দিয়ে ফাঁসিয়েছে। আসিয়া বিবির মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে, জেলে বসে আছে, মাথার ওপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি। আসিয়া বিবি যে নির্দোষ, তা বুঝতে কোনও কিছুর বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। জাপানের হাকামাদা ৪৫ বছর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে পাঁচ বর্গমিটার সেলের ভিতর কাটিয়েছেন। ৭৮ বছর বয়সে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেওয়ার পর তাঁকে জেল থেকে আপাতত মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাঁর নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে। লোকে বলে, পুলিশের নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি বলেছিলেন তিনি অপরাধী। হাকামাদার মতো আরও অনেক মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি জাপানের সেলের ভিতর একা বসে থেকে থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে। হাকামাদা বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র তার নিজের লোকদের হত্যা করবে, এটা মানা যায় না।’ যদিও আন্তর্জাতিক আইন বলে, মানসিক অসুস্থতা যাদের আছে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু জাপান সে কথা মানবে না। ১৪০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে, কিছু দেশ খুব বড় অপরাধ ছাড়া সাধারণ অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। হতে পারে, জাপানও একদিন মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করবে।

ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর কি পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ বা খুন বন্ধ হয়েছে, নাকি কমে গেছে? সত্যি কথা বলতে, বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে নারীবিরোধী অপরাধের সংখ্যা গত কয়েক বছরে এত বেড়েছে যে ভারতের নারীবিরোধী রাজ্যগুলোর কাতারে এটি বেশ পাকাপোক্ত আসন গেড়ে নিয়েছে। ফাঁসি কি অপরাধ কমায়? খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি সমাজে আর খুন হয় না? ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলে কি ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়? জরিপে দেখা যায়, খুন ধর্ষণসহ কোনও অপরাধই বন্ধ হয় না। কানাডায় ১৯৭৬ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলুপ্ত করা হয়। অপরাধের সংখ্যা ১৯৭৬ সালে যা ছিল কানাডায়, তার চেয়ে অর্ধেক কমে গেছে এখন। তাহলে মৃত্যুদণ্ড না থাকলেও অপরাধ কমে। তাহলে অপরাধ কমানোর পেছনে মৃত্যুদণ্ডের ভয় নয়, অন্য কিছু কাজ করে।

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা দেশগুলোয় যত অপরাধ ঘটে, তুলনায় তার চেয়ে কম ঘটে মৃত্যুদণ্ড না থাকা দেশগুলোয়। সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, লুক্সেম্বার্গ, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড— এসব দেশে সবচেয়ে কম অপরাধ ঘটে, এসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। যে-সব দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল আছে, সে-সব দেশে যে মৃত্যুদণ্ডের কারণে অপরাধের সংখ্যা কম, তা নয়। সেসব দেশ ধীরে ধীরে সভ্য হয়েছে; মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সমানাধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা এবং সচেতনতা বেড়েছে বলে অপরাধের সংখ্যা কমেছে।

আমিও হয়তো আর সবার মতো মৃত্যুদণ্ডে সায় দিতাম, যদি আমি ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করতাম। আমি মনে করি না মৃত্যুদণ্ড কোনো সমস্যার সমাধান। ধর্ষণের কারণ বের করতে হবে, সেই কারণকে নির্মূল করতে হবে। ধর্ষণ ঘটে ভায়োলেন্ট বা টক্সিক মাস্কুলিনিটি আর ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের কারণে। পুরুষতন্ত্র জন্ম দেয় নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা, নারীকে ক্ষুদ্র তুচ্ছ নিকৃষ্ট আর ধর্ষণের বস্তু ভাবার মানসিকতা। এটিই পেশিসর্বস্ব অহংকারী পৌরুষকে দিয়ে ধর্ষণ ঘটায়। সঙ্গে আছে ধর্ষককে নয়, ধর্ষিতাকে দোষ দেওয়ার সমাজ। মিডিয়াও ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধর্ষণের সময় মেয়েটি কী পোশাক পরে ছিল, তখন দিন ছিল কী রাত ছিল, মেয়েটির চরিত্র কেমন, মেয়েটি একা ছিল কি না, মেয়েটি মদ্যপান করেছিল কিনা— ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। কেউ জিজ্ঞেস করে না পুরুষটির কেন মনে হয়েছিল ধর্ষণের মতো একটি ভয়াবহ অন্যায় কাজ করা তার উচিত।

যতদিন অবধি ধর্ষণের, নারীহত্যার, শিশু পাচারের, যৌন নির্যাতনের আসল কারণগুলো বিলুপ্ত করা না যায়, ততদিন পর্যন্ত ধর্ষণ চলবে। অপরাধ যে কারণে হচ্ছে, সেই কারণকে নির্মূল করা গেলে অপরাধ কমবে। এই নির্মূল করার কাজটি কঠিন ভেবে অনেকে সোজা পথটি ধরতে চায়। সোজা পথটি হলো, অপরাধীকে মেরে ফেল, চোখের বদলে চোখ নিয়ে নাও, খুনের বদলে খুন। এর নাম কিন্তু বিচার নয়, এর নাম প্রতিশোধ। এটি করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যায়। জনগণ ভাবে অপরাধ দমনে সরকার বিরাট এক ভূমিকা নিয়েছে।

অপরাধীর জেল হলে এমন তো হতে পারে, সে ভালো মানুষ হয়ে জেল থেকে একদিন বেরোবে। সমাজের জন্য খারাপ নয় বরং ভালো কাজই করবে। জেল বাসের পর তো কত মানুষের অনুশোচনা হয়। আমরা সবাই জানি, কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। কেউ জন্ম থেকে ধর্ষক, খুনি নয়। সমাজের কুশিক্ষা মানুষকে অপরাধী বানায়। অপরাধ করলে অপরাধীকে শুধু দোষ দিলে চলবে কেন। কুশিক্ষাকেও দিতে হবে দোষ। আমি মনে করি, ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে না। পুরুষ তখন ধর্ষণ বন্ধ করবে যখন মেয়েদের ধর্ষণের বস্তু হিসেবে তারা আর দেখবে না। এই নষ্ট নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের শিখিয়ে ফেলেছে যে মেয়েরা ধর্ষণের বস্তু, এই শেখাটা মাথা থেকে দূর করতে হবে। তাহলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে। নতুন করে কাউকে আর নতুন কিছু শেখাতে হবে না, শেখাতে হবে না যে মেয়েরাও মানুষ, তাদেরও শ্রদ্ধা করা উচিত।

ভারতকে যেন অনুসরণ না করে বাংলাদেশ। যেন ভারতের চেয়েও সভ্য দেশ, যে-সব দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, যে-সব দেশে অপরাধের সংখ্যা কম, সে-সব দেশের নীতি আদর্শ অনুসরণ করে।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর