শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

শিক্ষার মান এভাবে নামছে কেন

খায়রুল কবীর খোকন

শিক্ষার মান এভাবে নামছে কেন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৬ বছরে একমাত্র প্রফেসর ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ছাড়া অন্য শিক্ষামন্ত্রীদের বিবেচনায় নিলে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সবচেয়ে দক্ষ ও কার্যক্ষম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। একসময়কার বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের সভাপতি নাহিদ সাহেব শিক্ষা বিভাগের সীমাহীন দুর্নীতিতে জরাগ্রস্ত শিক্ষা-কর্মকর্তাদের ‘কাজের উপযোগী দুর্নীতিমুক্ত’ করার যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। শিক্ষাব্যবস্থার ‘চরম-নৈরাজ্যময়-দশার’ একটা সমাধান-চেষ্টায় তার ‘রাতের ঘুম হারাম’ হয়ে আছে, সেটা সবাই সাধারণ দৃষ্টিতেই দেখতে পান।

দুর্ভাগ্য শিক্ষামন্ত্রীর, তারও চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এ জাতির। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য ক্রমশ বিস্তৃত হয়েই চলেছে, শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব অফুরান চেষ্টা করেও সেই নৈরাজ্যের রাশ টেনে ধরতে ব্যর্থ। একজন সৎ শিক্ষামন্ত্রী এবং দু-চারজন শিক্ষা-কর্মকর্তার অপরিসীম কর্মতৎপরতা চললেও শিক্ষাব্যবস্থাকে অতল গহ্বর থেকে উদ্ধারের আসল কাজটি যে হচ্ছে সেটা বলা যাবে না। কারণ, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। শিক্ষামন্ত্রীর শত চেষ্টাতেও শিক্ষা-কর্তারা দুর্নীতি ছেড়ে সততার সঙ্গে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা পরিচালনার উদ্যোগে এতটুকু আগ্রহী হয়ে উঠছেন না। তার বড় প্রমাণ পরীক্ষার আগে অবিরাম প্রশ্নপত্র ফাঁস। শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে যদি দশ শতাংশও দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ হন, আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালান, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না কেন? একের পর এক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, আর তদন্ত কমিটির পর কমিটি হচ্ছে, কিন্তু তার ফলাফল শূন্য। কীভাবে এটা সম্ভব! পুরো জাতি কি এরকম ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে! একটা বিশাল রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে একটা জাতি স্বাধীনতা অর্জন করল, তারপরে সে জাতির জীবনে প্রায় আধাশতক পার হতে চলেছে, এর পরেও শিক্ষা কার্যক্রমের ন্যূনতম মানমর্যাদা বজায় থাকবে না, শিক্ষার দুর্নীতিতে লাগাম টেনে ধরা যাবে না, সেটা কীভাবে আমরা মেনে নেব? একটু একাডেমিক আলোচনায় আসি; আমাদের দেশের শিক্ষার মান নেমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে—শিক্ষকদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় বাসা বেেঁধছে। শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাঝে, মানে আমলা-গোষ্ঠীর মাঝে আগেও দক্ষতা ছিল না, তাদের আলস্যপ্রিয়তা সবারই জানা, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনিক কাজকর্মে শম্বুক গতি কে না জানে! তবে অতীতে শিক্ষা বিভাগের আমলাদের মাঝে যতই অদক্ষতা ও দুর্নীতি থেকে থাকুক না কেন, প্রাথমিক থেকে উঁচুতম পর্যায় অবধি স্তরে স্তরে বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সন্তানস্নেহে শিক্ষাদানের যে দায়িত্ববোধ কাজ করত তা এখন দুষ্প্রাপ্য। শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয় সেক্ষেত্রে চলছে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। বলা চলে, শিক্ষকদের মাঝে থাকা প্রকৃত-অভিভাবকের দায়িত্ববোধ একেবারেই বিলুপ্তপ্রায় দশায়। (ব্যতিক্রম যা কিছু আছে তা নিতান্তই ব্যতিক্রম, হয়তো পাঁচ শতাংশ বা তার চেয়েও কম)।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিদ্যালয়ের মানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের রাষ্ট্রের অন্যসব কর্মচারীর তুলনায় একটু বেশি সম্মানীই দেওয়া দরকার। শিক্ষাদান বিষয়টা উঁচু মাপের ‘টেকনিক্যাল’ একটা বিষয়, বিশেষ একটা মেধা-শ্রম বিনিয়োগের বিষয়, সেখানে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের অপরিহার্যতা যেমন রয়েছে, সেখানে রয়েছে যথেষ্ট মেধাবী ছাত্রদের লেখাপড়া শেষে এ পেশায় যোগদানে উৎসাহিত করা, এ পেশায় টানা কর্মজীবী থাকার জন্য পর্যাপ্ত হারে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদকে আকৃষ্ট করা, তেমনি রয়েছে সর্বোচ্চ মাপের দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটানোর অপরিহার্য বিষয়টি। সেটি এখানে হওয়ার মতো পরিবেশ রয়েছে কি? সার্বিক পরিবেশ এখানে তেমনটা নেই, কারণ, জাতিগতভাবে আমরা সেই কাজটি করতে পারিনি—একটা বিশালকায় সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।

সাধারণ আমলা গোষ্ঠী শিক্ষা বিভাগের শিক্ষা কর্মকর্তা বা শিক্ষকদের বেতন সুযোগ-সুবিধা থেকে বৈষম্যের শিকার বানানোর কাজটি সব সময়ই করে আসছে, তা নিয়ে সরকারি শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। ক্ষোভ রয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যেও। সেই ক্ষোভের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে যেসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন দরকার ছিল সরকারের নেতাদের দায়িত্বে, তা যথাযথভাবে সম্পাদন করা হয়নি কখনো। সেখানে বাধা সৃষ্টি করছে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেকার অশিক্ষা আক্রান্ত মনমানসিকতা, আর আমলাতন্ত্রের মধ্যেকার কুচক্রী মনোভাব, অপরিসীম হীনমন্যতা। তাই শিক্ষকদের বঞ্চনার সেই ক্ষোভ তুষের আগুনের মতো জ্বলে ধিকি ধিকি, সব সময় তা চোখে দেখা না গেলেও সে আগুন কখনো নেভেনি। এর পাশেই জন্ম নিয়েছে, এ ভোগবাদী সমাজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, শিক্ষকদের একটা বড় অংশের মধ্যেই সীমাহীন অর্থলোভ যা থেকে কোচিং ব্যবসার উদ্ভব। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছেন কোচিংবাণিজ্য উচ্ছেদ করতে, কিন্তু উচ্ছেদ তো দূরের কথা, পুরো মাফিয়া চক্রের কোচিংবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ আদৌ সম্ভবই হচ্ছে না।

এদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে সমগ্র ক্যাম্পাস এখন ভয়ানক অস্থিরতার মধ্যে, শিক্ষা পরিবেশ নিদারুণভাবে বিঘ্নিত। ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দলে কয়েক বছরে প্রায় অর্ধশত নিহত, আর আহত হয়েছে হাজার হাজার। আর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের আক্রমণে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের বিশেষভাবে ছাত্রদলের অনেক কর্মী মারা গেছে, আহত হয়েছে শত শত কর্মী। এর ফলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে প্রতিদিন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের মধ্যে একটা বড় অংশই সরকারি দলের চাটুকার আর তোষামোদকারী। শিক্ষকদের একটা বড় অংশই সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করে চলেছে। এসব ঘটনা ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে দিয়েছে।

শিক্ষকদের মধ্যে লেখাপড়া শেখানোর কাজটিতে নিজের সন্তানদের যেভাবে শেখানো দরকার তা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষকতার কর্মে নিজেদের নিয়োজিত রাখার দেশপ্রেমিক কর্তব্যে অংশ নিতে আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে—যা এখনো সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। লেখাপড়া শিখে সাধারণভাবে রাস্তায় চলতেও বিধিবিধান মানার কালচার ধারণ করতে পারে না যে তরুণ, যে যুবক, তার লেখাপড়াই তো বৃথা। যেসব তরুণ বা যুবক মোটরবাইক চালায় তাদের দেখলেই বোঝা যায়—আমাদের শিক্ষিত তরুণরা সাধারণ বিধিবিধান মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়নি। কেন হয়নি? জবাব অতি সোজা, তারা জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে সচেতনতা, নীতিনৈতিকতা, জীবনযাপনের সাধারণ নিয়মনীতি মেনে চলতে কিছুই শিখেনি। শিক্ষার মৌলিক বিষয়টিই হচ্ছে—নিজের ভিতরে চেতনার উন্মেষ ঘটানো, নিজের হৃদয়-মগজে সচেতনতার প্রকৃত শিক্ষা অর্জন। সেটি করা না গেলে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটাই ব্যর্থ প্রমাণিত হবে।

আমরা অবশ্যই জানি, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটা বড় লক্ষ্যই হচ্ছে—নিজেকে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মযুক্ত হওয়া বা ব্যবসায়িক বা শিল্পোদ্যোগের প্রাথমিক সব বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ ইত্যাদি অর্জন করা। কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার, যে কোনো মানুষ শিক্ষা ব্যতীত যে সাধারণ প্রাণীতুল্য, সে অবস্থা থেকে ওঠে এসে সচেতন সজ্জন হয়ে ওঠার, মানবিকতার চেতনার বিকাশের, উন্মেষের কাজটি কিন্তু শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য—সারাবিশ্বেই তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই লক্ষ্যটিই এখন হারাতে বসেছে। নিদারুণভাবে সেই লক্ষ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

কেবল বছর শুরুতে স্কুল পর্যায়ে ৩০ কোটি বই বিতরণ কাজ করলেই শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন হয়েছে ভাবা যাবে না। হাজার হাজার কোটি টাকা বার্ষিক বরাদ্দ দিলে আর বছর বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠান আর লাখ লাখ সার্টিফিকেট দিতে থাকলেই আমাদের শিক্ষার মান বাড়বে না, অর্জিত হবে না শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। বছর বছর পরীক্ষা সঠিক পদ্ধতিতে নিতে হবে, সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থাও চলবে, তবে আসল লক্ষ্য শিক্ষা লাভের মাধ্যমে প্রকৃত সচেতন মানুষ হওয়া সেই লক্ষ্য যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।

শিক্ষিত তরুণ ও যুবারা নিজের জীবিকার্জনের জন্য একেকটি পেশায় যোগদানের সক্ষমতা অর্জন করবেন, শিল্পোদ্যোগ বা ব্যবসায়-বাণিজ্য উদ্যোগে যোগদান করবে, সেটা আমরা ভুলে যাব না, তবে শিক্ষিত হলে সমাজের সব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ভালো সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ভুলে গেলে চলবে না। সমাজ-প্রগতির সব ভাবনা যেন আমাদের তরুণ-যুবাদের মনের ভিতরে গেঁথে থাকে সে লক্ষ্যে শিক্ষকদের শিক্ষণ কাজ চালাতে হবে। নিজেরা যেন আইন মেনে চলে, অন্যদের যাতে বিধিবিধান মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে সে শিক্ষা সব তরুণকে দিতে হবে। শৈশব থেকে সেসব শিক্ষার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় অবধি সেই শিক্ষারই বিস্তার করতে হবে সবার মাঝে। কেবল সে পরিস্থিতিতেই একটা মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম হতে পারে, সেটাই আমাদের জাতিগত কামনা হওয়া দরকার।

            লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর