বুধবার, ৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

জাতীয় বাজেট নিয়ে আমার কিছু কথা

লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

জাতীয় বাজেট নিয়ে আমার কিছু কথা

২০১৮-১৯ সালের জাতীয় বাজেট আর কয়েক দিন পর জাতীয় সংসদে উপস্থাপন হতে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে এবারের বাজেট গত বছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বিশালতর এক ঢাউস বাজেট হবে। অর্থমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন এবারের বাজেট জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের বাজেট হবে, পাঁচ লাখ কোটি টাকার অঙ্কও ছাড়িয়ে যাবে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে দেখছি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক (macro economy) অবস্থা ক্রমাগত ভঙ্গুর। জাতীয় প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারছেন না। এ বছরের জাতীয় প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ নয়, নিম্নমুখী। এ নিম্নগতি সামনের দিনে আরও নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। বর্তমানে জাতীয় বাজেটের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির বল্গাহীন অশ্ব দ্রুতবেগে সামনে ধাবমান। ইতিমধ্যে তা দুই ডিজিটে পৌঁছে গেছে। মূল্যস্ফীতি দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডলার ও ভারতীয় রুপির বিপরীতে টাকার মান হ্রাস পেয়েই চলেছে। দেশের শেয়ারবাজারেও কোনো উৎসাহব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। লাখ লাখ কোটি টাকা বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিজিটে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। মানিলন্ডারিংয়ের মহোৎসব চলেছে। চলেছে চরম ব্যাংকের লুট, জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। ব্যাংকগুলো থেকে সীমাহীন ঋণ, অতিরিক্ত ঋণ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য প্রকল্পের নামে দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ বহুলাংশেই স্থানান্তরিত (diverted) হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। দেশি বিনিয়োগও চরমভাবে নিরুৎসাহিত। বিপুল অর্থ ও সম্পদ বিদেশে পাচার হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের কাজে অত্যন্ত মন্থরগতি। প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় থেমেছে। এদিকে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, অস্থিরতা  উত্তেজনাপূর্ণভাবে বিরাজমান। জনগণ চরম নিরাপত্তাহীনতায় জীবনযাপন করছে। গুম, খুন, অপহরণ নাগরিক জীবনকে ভয়ঙ্করভাবে আতঙ্কিত করে তুলছে। গণতন্ত্রের সংকট দিনে দিনে ঘনীভূত হচ্ছে। সরকার আস্থাহীনতার বাণে ইতিমধ্যে মারাত্মকভাবে বিদ্ধ। এতসব প্রতিকূল পরিবেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮-১৯ সেশনের জাতীয় বাজেট জনপ্রতিনিধিহীন, বিরোধী দলশূন্য ও অকার্যকর সংসদে কিছুদিনের মধ্যে উপস্থাপন হতে যাচ্ছে।

সরকারের উচিত হবে বাজেটকে কল্পনার ফানুসে আকাশে উড়তে না দিয়ে কঠিন বাস্তবমুখিতায় ধরায় নামিয়ে আনা। শূন্যে অট্টালিকা তৈরি না করে স্বীয় অর্থনীতির বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তাকে শক্তিশালী করা। ঋণং কৃতঃ ঘৃতং পিবেত মানসিকতা পরিহার করা। সরকারের উচিত হবে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের মূল উৎপাটনের অতীতের অঙ্গীকারকে ভুলে না গিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তৎপর হওয়া। উচিত হবে দুদককে কাগুজে বাঘে পরিণত না করে তার কর্মকাণ্ড বেগবান করা। কার্যকর, শক্তিশালী ও স্বাধীন করা। প্রয়োজন জাতীয় ও সমাজ জীবনে আজ যে ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে, বিলাস ও জৌলুস জীবনে বিত্তবানরা মাদকের মতো আসক্ত হয়ে গোটা জাতিকে সংক্রমিত করছে, তাকে রোধ করা, সাধারণ জীবনযাপন ও কৃচ্ছসাধনে উৎসাহিত করা। প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ের বিশাল অপচয়ের প্লাবন বন্ধ করা। আর এর সূচনা হতে হবে রাষ্ট্রীয় ও সমাজের নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে। মাত্র কয়েক শ যোজন দূরে অবস্থিত পাশের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অথবা তার পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এবং তাদের স্ব-স্ব দলীয় রাজনৈতিক সহকর্মীরা সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই তাদের মতোই অতিসাধারণ জীবনযাপন করেন। সততার মানদণ্ডে প্রশ্নাতীত ও সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেন। তেমনি দেখেছি পাশের ত্রিপুরা রাজ্যের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে, যার এখন নিজস্ব বাসগৃহও নেই।

বলা হয়, বাংলাদেশের বড় বড় ধনাঢ্য ব্যক্তির সাফল্যগাথার পেছনে আছে বড় বড় অপরাধের কাহিনী। তাদের প্রাসাদতম অট্টালিকার গোপন প্রকোষ্ঠে দেখা যাবে মানুষের কঙ্কাল। অর্থমন্ত্রী একবার স্বীকার করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের যত টাকা সঞ্চালিত হচ্ছে তার ৭০ শতাংশই কালো টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত অপ্রদর্শিতভাবে গচ্ছিত টাকা। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, যদি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়, যদি জাতীয় গণপ্রশাসনকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় তাহলে আমাদের জিডিপি আরও ৩% বেড়ে যাওয়া সম্ভব।’ দেশে ইতিমধ্যে গজিয়ে চলেছে ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র বেসরকারি ব্যাংক। আমরা লক্ষ্য করেছি ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি কোনো অর্থনৈতিক বিবেচনায় হয় না, সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। সেগুলো ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও শক্তিশালী অপরাধী চক্রের হাতে।

অর্থমন্ত্রীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও বিদ্বান ব্যক্তি হিসেবে শ্রদ্ধা করি। তিনি সাদাসিধে জীবনযাপনে ও উচ্চ চিন্তায় বিশ্বাসী। তিনি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের কথা বলেন। বাংলাদেশের বাজেট অর্থনীতির জটিল ধাঁধার অধরা সমাধান পেতে গণিতের সমাবেশ বিন্যাসের অনুশীলনের বিপরীতে গণিতের ‘শুভঙ্কর’ জাদুকরের শরণাপন্ন হওয়ার পরিবর্তে তার প্রতি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার আন্তরিক পরামর্শ হলো— অনুগ্রহ করে লাগামহীনভাবে ঋণ করবেন না। ঘি খাওয়ার জন্য ঋণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। ঋণং কৃতঃ ঘৃতং পিবেক বর্জনীয়। সততাই সর্বোত্তম পন্থা— এ নীতিই অনুগ্রহ করে মেনে চলুন। গায়ের জামা সেলাই করুন গায়ের মাপেই। সামর্থ্যের মধ্যে বাজেট করুন। যেন তা ম্যানেজ করা যায়। লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ করুন। বন্ধ করুন বিলাসবহুল গাড়ি, অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিলাসসামগ্রী ও জীবনাভ্যাস। জীবনের সর্বস্তরে, সব জাতীয় খাতে মিতব্যয় ও পরিমিতি বোধকে উৎসাহিত করুন। সম্পদের অপব্যয় বরদাশত করবেন না। কালো টাকা সাদা করার কোনো বিধান রাখবেন না। কালো কালোই, সাদা সাদাই। ম্যাজিক দিয়ে কালো সাদা হয় না, করা যায় না। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া অন্যায়, অনৈতিক ও অবৈধ। জাতীয় সংসদ ধর্মীয় উপাসনালয়ের পরে একটি পবিত্র স্থান। এই মহান প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাহানি ঘটে, অবমাননা হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া কখনই উচিত নয়। কিন্তু দেখে আসছি সরকার-নির্বিশেষে প্রতি বছর সুদূর ও নিকট অতীতে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখার মধ্যে সংসদের মর্যাদাহানির চর্চার বার বার পুনরাবৃত্তি চলেছে। কিন্তু enough is enough— যথেষ্ট হয়েছে। এখনই আমাদের এসব বন্ধ করা উচিত। এমন কিছু করা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত যা করলে দুর্নীতিগ্রস্ত অনৈতিকতার দেশ হিসেবে আমাদের বিশ্বসভায় পরিচয় চিরস্থায়ী রূপ লাভ করে।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সুদূর ও অদূর অতীতের প্রতিটি বাজেটেই কমবেশি থেকেছে। জাতীয় বাজেটকে দুষ্টচক্রের বাইরে আনতে হবে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য ও তার বৈধকরণের সংসদীয় স্বীকৃতি জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে। এর সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের জাতীয় ও সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমরা দুর্নীতি বিস্তারিত হতে দেখছি। দুর্নীতির অভিযোগে অদূর অতীতে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রমাণসহ অভিযোগ এসেছিল স্বয়ং যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। রেলমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও তেমন অভিযোগ উঠেছিল এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ওকাদা সে সময় সফরে এসে বাংলাদেশের দুর্নীতির বিস্তার ও ব্যাপকতায় গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলেন এবং সরকারকে দুর্নীতি দমনে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কালো টাকার উৎস দুর্নীতি এবং একমাত্র দুর্নীতি যা আজ দেশে দানবীয় রূপ ধারণ করেছে। প্রবহমান কালো টাকার বিষাক্ত কালো স্রোত আজকের মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গা নদীর মতো গোটা জাতীয় অর্থনীতিকে হত্যা করে চলেছে এবং তা জাতীয় সংসদের স্বীকৃতি নিয়ে, বৈধতাপ্রাপ্ত হয়ে। এমন অনৈতিক ও অন্যায় কর্মকাণ্ড আমাদের জাতিকে বার বার কলঙ্ক লেপন করছে। অতীতের বছরগুলোতেও অর্থমন্ত্রী বাজেট উপস্থাপনের আগে কালো টাকার সুযোগ থাকবে না— বার বার এমন কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনো কথা রাখেননি। সুনীল গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনটি ‘কেউ কথা রাখেনি’ অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে কথা না রাখতে হয়তো উৎসাহিত করে থাকবে।

জাতীয় বাজেটে অগ্রাধিকার খাতগুলো হওয়া উচিত প্রথম কৃষি, দ্বিতীয় শিক্ষা, তৃতীয় জাতীয় নিরাপত্তা। ১৬ কোটি মানুষ আমাদের দেশে। আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষক। কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষিতে আমাদের অনেক অর্জন আছে কিন্তু এখনো অনেক কিছু করার আছে। সম্ভাবনা বিপুল। আমাদের কৃষি উৎপাদন চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম আশপাশের এসব দেশ থেকে অনেক কম। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনে আরও বাড়াতে হবে। সার, বীজ, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং তার মূল্যে অনেক সাশ্রয় আনতে হবে, সহজলভ্য করতে হবে। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্য কৃষকস্বার্থের অনুকূল হতে হবে। কৃষকের যথেষ্ট incentive থাকতে হবে।

শিক্ষা : শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে আরও ব্যাপক করা আজ জাতীয় প্রয়োজন। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির সংযোজন অত্যন্ত জরুরি। শ্রীলঙ্কা সার্কভুক্ত একটি দেশ। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ভীষণ অস্থিরতার মধ্যেও সেখানে শিক্ষার হার ছিল ৯৭%। আমাদের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন দুর্বার গতির সঞ্চার করে দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধুয়েমুছে সাফ করা, পবিত্র করা। থাকবে না সেখানে সংকীর্ণ রাজনীতির বিষাক্ত পরিবেশ, থাকবে না হানাহানি, সংঘাত আর অস্ত্রের ঝনঝনানি। এটা একটা বিরাট জাতীয় চ্যালেঞ্জ। সুশিক্ষিত, সভ্য ও প্রগতিশীল একটি জাতি নির্মাণে স্পষ্ট ও দৃঢ়প্রতিশ্রুতি বাজেটে থাকা প্রয়োজন।

জাতীয় নিরাপত্তা : বাংলাদেশের ভূগোল, তার ভূ-অর্থনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত অবস্থান আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ড তিন দিকেই প্রতিবেশী ভারতবেষ্টিত। ৪ হাজার ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারতের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত। দেশের মোট আয়তনের তুলনায় মাত্র একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে এত দীর্ঘ সীমান্তের দেশ পৃথিবীতে বিরল। নিকট অতীতের এক মহাদুর্যোগে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বিডিআরের সমগ্র সংগঠন তছনছ হয়ে গেছে। পরিবর্তিত সীমান্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বিজিবি সংগঠিত হচ্ছে। এই নতুন বাহিনীকে একটি পেশাদক্ষ আধাসামরিক বাহিনীর উৎকর্ষতায় ও পূর্ণতায় গড়ে তুলতে, লোকবলে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে, সমরসম্ভারে সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত করতে সরকার এখনো পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। বিষয়টি অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ, বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার। ভুলে গেলে চলবে না, সীমান্তে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের মানুষ বিএসএফের গুলি খেয়ে হত্যা হচ্ছে। সীমান্তে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। অরক্ষিত সীমান্তবাসী নিরাপত্তাহীনতায় বিনিদ্র রজনী যাপন করছে। বিজিবিকে আরও প্রশিক্ষিত, আরও সুদক্ষ ও সুসংহত করতে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মানচিত্রের পুরো দক্ষিণ দিকজুড়ে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর। আমাদের সমুদ্রসীমা ভারতের সঙ্গে এখন নির্ধারিত। ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত ইটলসের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমার সমস্যাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। আমাদের প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও আধুনিক নৌবাহিনীর। এই নৌবাহিনীকে হতে হবে ত্রিমাত্রিক (three dimensional)। সেখানে থাকবে নৌবাহিনীর নিজস্ব বিমান শাখায় নৌঅপারেশন উপযোগী আধুনিক উড্ডীয়মান বিমান, থাকবে পানিতে ভাসমান আধুনিক যুদ্ধজাহাজের বহর আর গভীর সমুদ্রের তলদেশে থাকবে সাবমেরিনের ক্লাস্টার। আমাদের নৌবাহিনী আজ একটি উপকূলীয় নৌবাহিনী মাত্র, সুবিস্তীর্ণ সাগরের নীল জলের নৌবাহিনী (blue water navy) মোটেই নয়। আমাদের সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব যদি নিশ্চিত করতে হয়, মূল্যবান সমুদ্রসম্পদগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হয়, আহরণ করতে হয় তাহলে গোটা বঙ্গোপসাগর দাপিয়ে রাখা, সবাইকে জানান দেওয়া দৃশ্যমান একটি ত্রিমাত্রিক আধুনিক শক্তিশালী নৌবাহিনী অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প নেই। এ বছরের বাজেটে সরকারের এ বিষয়ে দৃঢ়প্রতিশ্রুতি ও দিকনির্দেশনা থাকতে হবে এবং বাজেটে তা প্রতিফলিত হতে হবে। আমাদের সামরিক বাহিনীর অন্য দুই অঙ্গবাহিনী সেনা ও বিমানকেও যুগোপযোগী, আধুনিক ও শক্তিশালী করা আজ সময়ের দাবি। বাজেটে তারও প্রতিফলন প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবে না ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা গোটা এশিয়া মহাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হওয়ার জন্য তার গুরুত্বকে অতিগুরুত্বপূর্ণ করেছে। আর তাই জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজ একদম সামনে চলে এসেছে। এখানে উল্লেখ করতে চাই বাজেটে অনেকে সামরিক খাতকে অনুন্নয়ন খাত বলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। বলা নিষ্প্র্রয়োজন, আমাদের সামরিক বাহিনী জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনে এক বৃহৎ ভূমিকা পালন করে চলেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিশ্বের সর্বোচ্চ সেনা প্রদানকারী দেশ হিসেবে নিয়োজিত থেকে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলীয় মেরিন ড্রাইভসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগব্যবস্থা, রাস্তা, সেতু (বৃহত্তম পদ্মা সেতুসহ), বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন হাইওয়ে, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল সড়কসহ মহানগরজুড়ে অনেক ফ্লাইওভার ও আগামী পদ্মা সেতু নির্মাণ কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর বিশাল ভূমিকা পালন করে চলেছে। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণ এশিয়ার এ পুরো অঞ্চলে তথা সারা বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ জনসংখ্যার আকার ও সীমান্তের বিস্তৃতির প্রেক্ষাপটে যার প্রতিরক্ষা ব্যয় সর্বনিম্ন, জিডিপির মাত্র ২% এবং সমগ্র জাতীয় বাজেটের মাত্র ৬-৭%। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে তাই বলা যায় বিশ্বের অন্যতম ন্যূন ব্যয়বহুল (least costly) সামরিক বাহিনী। আশা করি বিষয়টি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হবে।

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর