বুধবার, ১৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম রোজা

মাওলানা মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাধ্যম রোজা

প্রত্যেক মানুষের ভিতর দুটি স্বভাব রয়েছে। ফেরেশতার স্বভাব যা মানুষকে আনুগত্যের পথে পরিচালিত করে। অপরটি পশুর স্বভাব, যা মানুষকে অবাধ্যতা ও গুনাহের পথে পরিচালিত করে। এটাই হলো কুপ্রবৃত্তি। যাকে নফসে আম্মারা বলা হয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন— ‘অর্থাৎ, নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন’ (সূরা ইফসুফ-৫৩)।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবিতে একটি হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে। রসুল (সা.) একদা সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করলেন, এরূপ সাথী সম্পর্কে তোমাদের মতামত কী, যাকে সমাদর করা হলে অর্থাৎ অন্ন ও বস্ত্র দিলে সে তোমাদের বিপদে ফেলে দেবে। পক্ষান্তরে তাকে অবমাননা করা হলে অর্থাৎ, তাকে ক্ষুধার্ত ও উলঙ্গ রাখা হলে সে তোমাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.)! এর চাইতে খারাপ দুনিয়াতে আর কেউ হতে পারে না। রসুল (সা.) বললেন, ওই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের বুকের ভিতর যে অন্তরটি আছে সে-ই এ ধরনের সাথী।

কুরতুবিতে উদ্ধৃত অন্য একটি হাদিসে আছে—রসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের প্রধান শত্রু তোমাদের অন্তর। সে তোমাদের মন্দ কাজে লিপ্ত করে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে এবং নানাবিধ বিপদে জড়িত করে দেয়।

মানুষের এ আত্মাকে পরিচ্ছন্ন এবং তার কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার অন্যতম মাধ্যম রোজা। এটি অত্যন্ত মহৎ নেক আমল। মানুষের পশুসুলভ স্বভাবকে দুর্বল করে ফেরেশতার স্বভাব জোরদার করার ক্ষেত্রে রোজার মতো ফলপ্রসূ অন্য কোনো আমল নেই। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন—অর্থাৎ, “হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’ (সূরা বাকারা-১৮৩)।

রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তিকে দমন করে এক ধরনের রুহানি শক্তি অর্জিত হয়। আর এটাই হলো তাকওয়া বা পরহেজগারি। হাদিস শরিফে এসেছে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা মুমিনের ঢাল স্বরূপ’।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রোজা মানুষের আত্মাকে পরিচ্ছন্ন এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে মানুষ আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি পালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এভাবে দিনের পর দিন রোজা রাখার মাধ্যমে আত্মা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এ পরিশুদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত আত্মার ম্যাধমে মানুষ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে পারে।

সহিহ মুশতাদরাকে হাকেম কিতাবে এসেছে, কাব বিন আজরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসুল (সা.) আমাদের বললেন, তোমরা সবাই মিম্বরের কাছাকাছি এসে উপস্থিত হও। অতঃপর আমরা উপস্থিত হলাম। তিনি মিম্বরের প্রথম ধাপে উঠে বললেন, আমিন। দ্বিতীয় ধাপে উঠে বললেন, আমিন। অতঃপর তৃতীয় ধাপে উঠেও বললেন, আমিন। মিম্বর হতে অবতরণের পর আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমরা আজ আপনার থেকে এমন কথা শুনলাম যা এর আগে কখনো শুনিনি। তখন তিনি বললেন, আমি মিম্বরে ওঠার সময় জিব্রাইল (আ.) এসে বলল, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেল অথচ গুনাহ মাফ করে নিতে পারেনি সে ধ্বংস হোক। আমি বললাম, আমিন। আমি দ্বিতীয় ধাপে ওঠার পর সে বলল, যার সামনে আপনার নাম আলোচনা করা হয় অথচ সে আপনার ওপর দুরুদ পাঠ করে না সে ধ্বংস হোক, আমি বললাম, আমিন। অতঃপর আমি তৃতীয় ধাপে ওঠার পর সে বলল, যে ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে পেল অথচ তাদের সেবা করে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারেনি, সে ধ্বংস হোক, আমি বললাম, আমিন (মুশতাদরাকে হাকেম)।

রসুল (সা.)-এর এই হাদিসটি গভীর মনে একটু ভাবুন। আমার আপনার জন্য আল্লাহতায়ালা যে হায়াত নির্ধারণ করে রেখেছেন তা প্রতিটি মুহূর্তে বরফের মতো গলে কমে যাচ্ছে। আমরা আমাদের জীবনে বহুবার রমজান মাস পেয়েছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে বয়স অনুপাতে কেউ জীবনে ৭০ বার রমজান পেয়েছি, কেউ পেয়েছি ৫০ বার। কেউ হয়তো এর চেয়ে কম বা বেশিও পেয়েছি। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় রমজান পাওয়া সত্ত্বেও আমি-আপনি নিজেদের আত্মাকে কতটুকু পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করতে পেয়েছি? আমি-আপনি কি পশুত্বের স্বভাব থেকে ফেরেশতার স্বভাবে উন্নিত হতে পেরেছি? আমরা কীভাবে আমাদের জীবনকে অতিবাহিত করছি? মন চাহি জীবন, না রব; চাহি জীবন? আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে গণিমত মনে করে নেক আমল করা দরকার। এ নেক আমলই পরকালে আমার-আপনার কাজে লাগবে। এ হায়াতের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সময়ের কসম করে বলেন; অর্থাৎ, ‘সময়ের কসম। নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ (সূরা আসর-১ ও ২)।

তাফসিরে কবির প্রণেতা ইমাম রাজি (রহ.) বলেন, এখানে সময়ের কসম করে মহান আল্লাহ মানুষকে তাদের হায়াতের প্রতি সতর্ক করেছেন। কেননা, মানুষের হায়াত বছর, মাস, সপ্তাহ, দিবারাত্র এবং ঘণ্টা ও মিনিটের আবর্তনের মাধ্যমে গণনা করা হয়। আমি আপনি একটি ঘণ্টা অতিবাহিত করা মানে আমার আপনার হায়াত থেকে একটি ঘণ্টা কমে যাওয়া।

ইমাম রাজি (রহ.) বলেন, আমি এক বরফ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এ আয়াতের তাফসির বুঝেছি। তিনি বলেন, আমি একবার এক বাজারে গেলাম। সেখানে দেখলাম, এক বরফ ব্যবসায়ী একটি খোলা পাত্রে কিছু বরফ রেখে বাজারের অলিতে-গলিতে মানুষদের ডেকে ডেকে বলছে, ‘ওই ব্যক্তির প্রতি একটু দয়া কর, যার পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ আমি চিন্তা করে দেখলাম, তার পুঁজি হলো বরফ। যা বাতাসে ক্রমান্বয়ে গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার এ কথা শুনে বুঝলাম এটাই হচ্ছে অত্র আয়াতদ্বয়ের মর্মার্থ।

লেখক : ইসলামী গবেষক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর