শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

খুলনায় ভ্রান্ত ধারণার পরাজয়

বিভুরঞ্জন সরকার

খুলনায় ভ্রান্ত ধারণার পরাজয়

১৫ মে সবার চোখ ছিল খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ওপর। স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন হলেও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিসচেতন সবারই আগ্রহ ছিল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দীর্ঘদিন ক্ষমতা ও সংসদীয় রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপির দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ব্যাপক প্রচার ছিল। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন, জিতেছিলেন বিএনপির প্রার্থী। সেজন্য এবারও কারও কারও ধারণা হয়েছিল, এবারের নির্বাচনেও হয়তো বিএনপির প্রার্থীই শেষ হাসি হাসবেন। কিন্তু না, নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। ভোটের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক চোখের জল ফেলে বলেছিলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকা কত সুন্দর একটি এলাকা। মোংলা বন্দর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর। সেই এলাকা ছেড়ে আমাকে প্রধানমন্ত্রী এখানে মনোনয়ন দিয়েছেন খুলনার উন্নয়নের জন্য। সেই কাজ যাতে সম্পন্ন করতে পারি, তার জন্য সবার দোয়া চাই।’

খুলনার মানুষ তালুকদার খালেকের চোখের জলই শুধু মুছে দেননি, একই সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, বিতর্কেরও মীমাংসা করেছেন। খুলনা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও লড়াই যে আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, সে বিষয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। জয়ের ব্যাপারে এ দুই প্রার্থীই আশাবাদী ছিলেন। দুজনই যোগ্য প্রার্থী। বলা যায়, প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে দুই দলই অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে।

তালুকদার আবদুল খালেক আগে খুলনার মেয়র ছিলেন। কিন্তু গত নির্বাচনে তিনি হেরে যান। তারপর মোংলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আগেও তিনি এমপি ছিলেন। এবার খুলনা সিটির মেয়র পদে দাঁড়ানোর ইচ্ছা বা আগ্রহ তার ছিল না। তিনি দলের কাছে মনোনয়ন চাননি। তার পরও দলনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তালুকদার খালেকের হাতেই নৌকা তুলে দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা প্রমাণিত হয়েছে। তাকে প্রার্থী না করে অন্য কাউকে প্রার্থী করলে নৌকা বিজয়ের বন্দরে পৌঁছতে পারত কিনা সন্দেহ। সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র প্রবীণ এই নেতা প্রার্থী হওয়ায় দলের মধ্যে যেমন কোনো বিরোধ তৈরি হয়নি, তেমন সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রার্থীর ইমেজ নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। মেয়র হিসেবে আগেরবার তিনি ব্যর্থ ছিলেন না।

আবার বিএনপিও সিটিং মেয়র মনিরুজ্জামানের বদলে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে প্রার্থী করে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। খুলনায় মঞ্জু বিএনপির একজন জনপ্রিয় নেতা। তিনি ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মানুষের কাছে তিনি ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসেবেই পরিচিত। তাকে প্রার্থী করে বিএনপি আওয়ামী লীগের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এমনও শোনা গেছে, মঞ্জুর পরিবর্তে বিএনপি অন্য কাউকে প্রার্থী করলে তালুকদার খালেককে জয়ের জন্য এত গায়ের ঘাম ঝরাতে হতো না। বিশেষ করে বিদায়ী মেয়র মনিরুজ্জামান প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেসেখেলেই জয় পেতেন। কারণ মনিরুজ্জামান মেয়র হিসেবে নগরবাসীর মনে কোনো দাগ কাটতে পারেননি। তার ব্যর্থতার দায় কিছুটা হলেও মঞ্জুর গায়ে লেগেছে।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে টানটান উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ভোটের দিন পরিবেশ ছিল শান্ত। সামান্য কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি হলেও নির্বাচন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনও নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য বলেই উল্লেখ করেছে। কিছু অনিয়ম যে হয়েছে তা বোঝা যায় তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিতের ঘটনা থেকেই। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন করাটা খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে খুলনা সিটি নির্বাচনে অনিয়মটা এমন পর্যায়ে হয়নি, যা থেকে বলা যায়, এটা তামাশার নির্বাচন হয়েছে। কিছু জাল ভোট বা দু-চারটি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া যায় না। কেবল ভোটের ব্যবধান হয়তো একটু কমবেশি করা যায়। বিএনপি খুলনা সিটি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ চেয়েছে। আর মেয়র পদে পরাজিত ধানের শীষের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ১০৫টি কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। এটা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান।

বিএনপির এই রাজনীতি খুলনার ভোটাররা কি খুব ভালোভাবে নেবেন? তালুকদার খালেককে মানুষ ভোট দেননি? তাকে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের অসম্মানিত করার অধিকার কি কারও আছে? ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে যদি ব্যাপকভাবে বাধাই দেওয়া হতো তাহলে বিএনপি প্রার্থী ১ লাখ ৮ হাজার ভোট পেলেন কী করে? আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রায় ৬৮ হাজার ভোট বেশি পেয়ে জিতেছেন। এই বিপুল পরিমাণ জাল ভোট দেওয়াকে যারা সহজ বলে মনে করেন তারা আসলে সমালোচনার জন্যই সমালোচনা করেন। ভোট কেন্দ্রগুলো যদি ফাঁকা থাকত এবং প্রদত্ত ভোটের হার বাড়িয়ে দেখানো হতো তাহলেও না মেনে নেওয়ার সুযোগ থাকত যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে কারসাজি করে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে!

খুলনার নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তারা একবার সত্তর বছরের গণতন্ত্রের ঐতিহ্যবাহী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন কী প্রক্রিয়ায়, কীভাবে হচ্ছে তার খোঁজখবর নিয়ে দেখতে পারেন। রাজনীতি যেহেতু বর্তমান সময়ে প্রভাব-প্রতিপত্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে, নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে পারাটাই যখন সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দলের অভ্যন্তরে যেখানে গণতন্ত্রচর্চা বা গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণের লেশমাত্র নেই— সে রকম এক অস্থির সময়ে যারা কেবল নির্বাচনের ক্ষেত্রে শতভাগ শুদ্ধতা আশা করেন তাদের উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। তারা আসলে আম গাছে কাঁঠাল আশা করেন।

খুলনায় যে বিএনপিও জেতার আশা করেছিল তা বোঝা যায় শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকায়। এর আগে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও বিএনপি কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল। ফল যখন নিজেদের পক্ষে যায় তখন আর কারচুপির কথা বলেনি। বিএনপি আগে থেকেই খুলনার নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটতে দেওয়া হবে না বলে প্রচার চালিয়ে আসছিল। এটা তাদের কৌশল।

খুলনার নির্বাচনটাকে অনেকেই অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। এ বছরের শেষ দিকে দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে। ওই নির্বাচনের আগে যে কোনো নির্বাচনকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করার পেছনে যুক্তি নেই তা বলা যাবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও যেহেতু এখন দলীয় প্রতীকে হয় সেহেতু এটা মনেই করা হয়, এখন স্থানীয় নির্বাচনও জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়। খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপি স্থানীয় ইস্যুর চেয়ে জাতীয় ইস্যুগুলো সামনে এনেছিল। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যু সামনে এসেছে। বিএনপির এই প্রচারণা মানুষ গ্রহণ করলে নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতো। মানুষ এটা বুঝেছে, খুলনা সিটিতে বিএনপি জিতলেও খালেদা জিয়া কিংবা ‘গণতন্ত্র মুক্তি’ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এক বা একাধিক সিটিতে বিএনপি জিতলেও তাতে সরকার পরিবর্তন হবে না। আর সরকার পরিবর্তন না হলে খালেদা জিয়া কিংবা গণতন্ত্র— কোনোটারই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং মানুষের এটা ভাবাই স্বাভাবিক যে, আগেরবার বিএনপির প্রার্থী মেয়র হওয়ায় খুলনা উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছে। এবার ভোটারদের কাছে উন্নয়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার পেয়েছে। তাই বিএনপির দিকে ভোটারদের ঝুঁকে পড়ার কোনো কারণ ঘটেনি।

মানুষ ন্যূনতম সুযোগ পেলে বিএনপিকেই ভোট দেবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে সারা দেশে একটি প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই প্রচার যে অমূলক ও অহেতুক তাও খুলনায় এবং এর আগে রংপুরে প্রমাণিত হয়েছে। রংপুরে মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে কিন্তু বিএনপিকে ভোট দেয়নি। রংপুরে মানুষ নৌকায় ভোট দেয়নি। আবার ধানের শীষেও দেয়নি। দিয়েছে লাঙলে। এরশাদের জাতীয় পার্টিকে। জাতীয় পার্টি সরকার সমর্থক বিরোধী দল বলেই পরিচিত। খুলনায়ও দেখা গেল মানুষ আওয়ামী লীগের নৌকাকেই বেছে নিয়েছে। সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই বলে যে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বিএনপি বসে আছে, খুলনায় বাস্তবে তার পরাজয় ঘটেছে।

এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ টানা দুই মেয়াদে সরকারে আছে বলে কিছু মানুষের মনে নানা কারণে সরকারবিরোধী নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। সরকারি দলের কিছু কিছু মানুষের বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি ইত্যাদিতে মানুষ কিছুটা ক্ষুব্ধ— তাও সত্য। কিন্তু মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে ভাবে না।

অন্যদিকে, বিএনপির শাসনও মানুষ দেখেছে। হাওয়া ভবন-তারেক রহমানের আতঙ্ক মানুষের মন থেকে দূর হয়নি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যার বিষয়গুলো বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতেই ঘটেছে। আবার বিদ্যুৎ সমস্যা, সার সংকটও ওই শাসনামলেই তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছিল। সুশাসনের ঘাটতি এখনো আছে। তবে বিএনপির দুঃশাসন এখন নেই। আর সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বগুণ প্রয়োজন তা বিএনপিতে নেই। খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান যে শেখ হাসিনার বিকল্প নন, তা যে কোনো মানুষই বোঝে। বিএনপিকে অস্থিরতা পরিহার করতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে। মানুষকে তৈরি হওয়ার সময় দিতে হবে। মানুষ তৈরি হলে সরকার যত মেকানিজমই করুক তাতে মানুষকে দমিয়ে রাখা যাবে না। মালয়েশিয়ায় ক্ষমতাসীনরা কি কম কায়দা-কানুন করেছিল? সফল হয়নি, কারণ মানুষ প্রস্তুত ছিল পরিবর্তনের জন্য। বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে হবে। কৌশলের খেলা বাদ দিয়ে মানুষের কাছে নতুন রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে যেতে হবে। বিএনপিকে তার রাজনীতিটাই বদলাতে হবে। নেতিবাচক রাজনীতি, বিরোধিতার রাজনীতি, বাগাড়ম্বর ও মিথ্যাচার বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগের থেকে তারা কী কী ভালো করবে এবং কীভাবে ও কাদের দিয়ে তা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।

আওয়ামী লীগের জন্যও খুলনার নির্বাচন একটি শিক্ষামূলক বিষয় হওয়া উচিত। এই সরকারের আমলে যত উন্নয়নই ঘটুক না কেন তাতে নির্বাচনী জয় সহজ হবে না। প্রার্থী ভালো হতে হবে। অবিতর্কিত হতে হবে। মানুষ শুধু শেখ হাসিনা ও নৌকা দেখে ভোট দেবে না। প্রার্থীর গুণাগুণও বিচার করবে। দলের ভিতর কোনো ধরনের অনৈক্য থাকা চলবে না। ঘরের শত্রু বিভীষণদের রেখে যুদ্ধজয় কঠিন হবে। অনৈক্য, কোন্দল কঠোরভাবে দমন করতে হবে। সব থেকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে ভোটারদের মন-মেজাজের প্রতি। খুলনায় যেভাবে পরিকল্পনা নিয়ে, সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে তা কি গাজীপুরে করা সম্ভব হবে? এবং সব শেষে সারা দেশে জাতীয় নির্বাচনে?

            লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর