শনিবার, ১৯ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা

মহান রব্বুল আলামিন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের যাবতীয় প্রয়োজনের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর নিয়ামত সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন।  বান্দার শত অপরাধের পরও তার জন্য বরাদ্দ ‘নিয়ামতে আম্মা’ অর্থাৎ ব্যাপক নিয়ামত তিনি বন্ধ করেন না। বান্দার দোষ-ত্রুটি মানুষের মধ্যে প্রকাশ করেন না। বান্দাকে সঠিক রাস্তায় ফিরে আসার সুযোগ দেন। আর মানব জাতিকে কড়া ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে তারা যেন মানুষের দোষ-ত্রুটি সমাজে প্রকাশ করে না বেড়ায়। কারণ, মানুষের দোষ-ত্রুটি সমাজে প্রকাশ করার দ্বারা দুনিয়ায় ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়। এ সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যেসব লোক চায়, ইমানদার লোকদের মধ্যে নির্লজ্জতা-বেহায়াপনা বিস্তার লাভ করুক, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন, তোমরা জানো না।’ সূরা নূর : ১৯। এ সম্পর্কে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য-অগণিত হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তার থেকে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো। এক. মুসলিম শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে বান্দা অন্য বান্দার দোষ-ত্রুটি এ পার্থিব জীবনে গোপন রাখবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’ দুই. বুখারি ও মুসলিমের অন্য জায়গায় অন্য একটি হাদিস এসেছে। হাদিসটি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আমার সব উম্মতের গুনাহ মাফ হবে। কিন্তু দোষ-ত্রুটি প্রকাশকারীর গুনাহ মাফ হবে না। দোষ-ত্রুটি এভাবে প্রকাশ করা হয় : কোনো ব্যক্তি রাতের বেলা কোনো কাজ করবে। অতঃপর সকাল হবে। মহান আল্লাহ তার এ কাজ গোপন রাখবেন। সে (সকালবেলা) বলবে, হে অমুক! আমি গত রাতে এই এই কাজ করেছি। অথচ সে রাতযাপন করেছিল এমন অবস্থায় যে মহান আল্লাহ তার কাজগুলো গোপন রেখেছিলেন আর সকালবেলা আল্লাহর এই আড়ালকে সে সরিয়ে দিল।’ তিন. অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তিকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ধরে নিয়ে আসা হলো। সে শরাব পান করেছিল। তিনি হুকুম দিলেন, তাকে মারধর কর। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমাদের মধ্যে কেউ তাকে হাত দিয়ে, কেউ তাকে জুতা দিয়ে এবং কেউ কাপড় দিয়ে মারধর করল। যখন সে ফিরে গেল, কিছু লোক বলল, আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করেছেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এরূপ বলো না, শয়তানকে তার ওপর বিজয়ী করো না। বুখারি। উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হলো যে, কোনো মুসলিম অন্য কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে বেড়াতে পারবে না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নবুয়তি জিন্দেগিতে মানবজাতিকে আখলাক শিক্ষা দিয়েছেন। অপরাধ মার্জনার তালিম ও মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষাই বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা। মানবজাতি এ শিক্ষা গ্রহণ করলে সমাজে বিবাদ-বিসম্বাদ সৃষ্টি হবে না। মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে না। তৈরি হবে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পরস্পর মায়া-মহব্বত। প্রিয় পাঠক! হাদিসের ভাষার প্রতি লক্ষ্য করুন। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত দয়া ও মায়াভরা কণ্ঠে উল্লেখ করেছেন। ‘তোমরা যদি ময়দানে মাহশারে নিজেদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখতে চাও তাহলে দুনিয়ায় মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখো।’ সেই বিপদের দিন যেখানে কেউ কারও পরিচয় দেবে না। বড় কঠিন দিন। সেই দিন যদি আমার দোষ-ত্রুটি আল্লাহ প্রকাশ করে দেন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেন, তাহলে নাজাতের কোনোই উপায় থাকবে না। এ সম্পর্কে মিশকাতে একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যার থেকে হিসাব নেওয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ এখানে ধ্বংস হওয়ার মানে জাহান্নাম তার জন্য অবধারিত। প্রিয় পাঠক! কয়েক দিন আগে আল্লাহর রহমতে আমরা পবিত্র লাইলাতুল বরাতে ইবাদত করেছি। অনেকে এই ওয়াদা করেছি, আল্লাহ! আমরা যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন তোমার নাফরমানি করব না। মানুষের গিবত-শেকায়েত, পরনিন্দা ও মানুষের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকব। এই কৃত ওয়াদাকে সবসময় স্মরণ রাখব। সেই অনুযায়ী পথ চলব ইনশা আল্লাহ। একটু চিন্তা করলে দেখা যায় দৈনিক আমি নিজেই তো কত দোষ-ত্রুটি করি। আল্লাহ দয়া করে আমার সেই দোষ-ত্রুটি গোপন রেখেছেন। সমাজে আমাকে সম্মান দিয়েছেন। আহারাদির ব্যবস্থা করেছেন। সমাজের মানুষের সামনে আমাকে কখনো লজ্জিত করেন না। তাহলে আমি কেন অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে তাকে লজ্জিত ও ছোট করব।  হাদিসে এও বলা হয়েছে, আল্লাহ সব অপরাধ ক্ষমা করবেন, কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে তা তিনি ক্ষমা করবেন না।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর