সোমবার, ২১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

নির্বাচনী গণতন্ত্র না গণমানুষের গণতন্ত্র

আলাউদ্দিন মল্লিক

ইদানীং নির্বাচন কেমন হবে, কেমন হবে ভবিষ্যতের সরকার, আগামীর সরকারের জন্য কী কী সমস্যা আর চ্যালেঞ্জ তা নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই।  জনসভা থেকে ঘরোয়া আলোচনা, পত্রিকার পাতা থেকে টেলিভিশনের পর্দা আর তার সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম সর্বত্র চলছে কথা আর জ্ঞানের প্রতিযোগিতা। একটাই সমস্যা-আর তা হলো এখানে প্রত্যেকেই নিজের বিচারক, আর তাই সে নিজেই শুধু বিজয়ী। শিল্প বিপ্লব ব্রিটেনকে একটি পিছিয়ে থাকা দেশ থেকে প্রথম সারিতে নিয়ে আসে। সংস্কৃতিতেও তারা ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় বহু কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার আর নাট্যকারের আর্বিভাব হয়- তাদের অন্যতম উইলিয়াম শেকসপিয়র এ সময়েই জন্ম নিয়েছিলেন। এ সময়কাল সম্পর্কে একটি হাস্যরসাত্মক গল্প প্রচারিত আছে— ব্রিটেনে তখন সবাই লেখালেখিতে মনোযোগী। সবাই লিখছেন। নতুন নতুন লেখকদের জন্য বিষয়টি খবুই নাজুক। অবস্থা এমন সবাই শুধু তার নিজের লেখা পড়তে আর প্রশংসা পেতে ইচ্ছুক। সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের আপ্যায়ন আর পথ খরচ পর্যন্ত দিতে থাকলেন। তাই দুর্বল আর্থিক অবস্থার লেখকরা খুব শিগগিরই পাততাড়ি গুটিয়ে ফেললেন। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, শেকসপিয়র একজন লর্ডকে তার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেয়েছিলেন।

আমাদের বর্তমান অবস্থা এর চেয়ে খুব ভালো নয়। সবাই তো জনগণের স্বার্থকে বাদ দিয়ে নিজ নিজ কল্পনাকে জনগণের ইচ্ছা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। মনে হয়, তাতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হতে বড় বাধা হিসেবে দেখা দেবে। এসব কথামালা কাদের সুবিধা দেবে তা সচেতন সবাই বুঝতে পারছেন।

কলাম লেখক আর বিশেষজ্ঞরা সবাই যা বলেছেন তাতে মনে হয়, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন করে বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসীন করলেই যেন গণতন্ত্র তার পূর্ণমাত্রা পেয়ে যাবে। ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তিনটি এরকম ক্ষমতা হস্তান্তরকারী অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকরী ছিল। মোট তিনবার দুটি দল ক্ষমতাসীন হয়েছে। কিন্তু আমরা কি কোনো সহাবস্থান তৈরির উদাহরণ দেখতে পেয়েছি? নাকি ক্রমাগত ব্যবস্থাটির দুর্বলতা আমাদের জাতীয় জীবনকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে! যারা সে ব্যবস্থায় সমাধান সূত্র খুঁজছেন, তাদের সে প্রচেষ্টা প্রশ্নসাপেক্ষ বলেই প্রতীয়মান হয়। আসল সমস্যা কি নির্বাচন কীভাবে হবে আর ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে তার ওপরই সীমাবদ্ধ? নাকি গণতন্ত্রে ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় সেটা জরুরি। গণতন্ত্রের জন্য এত কথা বলা হচ্ছে, সেটা কি সত্যিকার অর্থে গণমানুষের জন্য, নাকি নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়া আর তা রক্ষা করার জন্য? গণমানুষকে আরও বেশি অংশগ্রহণে উৎসাহিত করাটাই সত্যিকারের গণতন্ত্র। কোনোভাবেই একটি দল বা গোষ্ঠী ক্ষমতায় যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করার চেষ্টায় নয়।

পৃথিবীর গণতন্ত্রের মডেলগুলোর মধ্যে বেশি কার্যকরী সেটাই যার মধ্যে গণমানুষের অংশগ্রহণ বেশি। উন্নত বিশ্বের রোল মডেল দীর্ঘ পথচলার কারণে তৈরি হয়েছে। এর জন্য দুটি উপাদান অপরিহার্য; একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা আর আরেকটি হলো, মানুষের মধ্যকার গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ। এ দুটিই আমাদের দেশে অনুপস্থিত। তাই তাদের প্রেসক্রাইবকৃত গণতন্ত্র আমাদের দেশে কার্যকরী হচ্ছে না।

গণতন্ত্র বিভিন্ন মডেলের হতে পারে। উন্নত বিশ্বে যে গণতন্ত্র তা হলো আপ-টু-বটম গণতন্ত্র এবং তা ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি ছাড়া কার্যকরী হতে পারে না। তার বাইরে আরেকটি মডেল হলো বটম-আপ গণতন্ত্র। পৃথিবীতে মাত্র দুটি জায়গায় এরকম বটম-আপ গণতন্ত্র চালু আছে। একটি সুইজারল্যান্ড আরেকটি উত্তর সিরিয়ার রোজাভা অঞ্চলে।

সুইস গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার সরাসরি নির্বাচন আর মধ্যবর্তী সময়ে গণভোট করার মাধ্যমে কোনো বিষয়ে সামগ্রিক মতামত নেওয়া। ১৮৪৮ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডে বটম-আপ ও সরাসরি গণতন্ত্র চালু আছে। এর কেন্দ্রীয় সরকার দুই কক্ষবিশিষ্ট। একটি স্টেট কাউন্সিল। এখানে ক্যান্টনগুলো তার মোট ৪৬ জন প্রতিনিধি পাঠায়। আর জনসংখ্যা অনুপাতে ২০০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, যারা সরকার গঠন করে। এটি ন্যাশনাল কাউন্সিল। এরা আমাদের দেশের এমপির সমমর্যাদার। এরাই দেশের সরকার তৈরি করে। তবে দুই কক্ষই ভেটো দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন। এ জন্য কোনো আইন করতে হলে দুই কক্ষেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন থাকা দরকার। উত্তর সিরিয়ার রোজাভা বিপ্লবে নতুন ধরনের একটি মডেল তৈরি হয়েছে, যা ২০১২ সাল থেকে কার্যকরী হিসেবে চলমান রয়েছে। নিচ থেকে উপরের দিকে (বটম-আপ) এ গণতন্ত্র গণসংঘতা (ডেমোক্র্যাটিক কনফেডারেলিজম) নামে পরিচিত। তুরস্কের কুর্দি জননেতা আবদুল্লাহ ওসালান এ মডেলের উদ্যোক্তা। তিনি শীর্ষ আমেরিকান পরিবেশবাদী মারে বুকচিনের ‘সোশ্যাল ইকোলজি’কে অন্যতম নিয়ামক ধরে পরিবেশবান্ধব আর লিঙ্গ সমতাকে আরেকটি নির্ণায়ক করে সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মডেল প্রস্তাব করেন।

রোজাভা বিপ্লবের মাধ্যমে এরই বাস্তব প্রয়োগ আমাদের একটি আশার জায়গা তৈরি করেছে। আমাদের মনে হয়, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শাসনকে সমন্বয় করে রোজাভার মডেলটি আমাদের দেশের বাস্তব প্রয়োগ তুলনামূলক অনেক সহজ। কারণ এর শুধু একটিই পূর্বশর্ত- সর্বোচ্চ সংখ্যক গণমানুষের অংশগ্রহণ। প্রতিটি গণঅভ্যুত্থান আর শাসকের বিরুদ্ধে বার বার বিদ্রোহ সর্বোপরি সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশের সৃষ্টি এ আস্থা দেয় যে, আমাদের গণমানুষ এ পদ্ধতি নিজের একান্ত বলেই মনে করবেন।  এ মডেলের মাধ্যমে তারা নিজেরা গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা পুরো সমাজকেই সত্যিকার গণতান্ত্রিক হিসেবে দেখতে আগ্রহী হবেন।

লেখক : সমাজ বিশ্লেষক এবং আপ হোল্ড নাইন-টি-নাইন এর প্রধান উদ্যোক্তা।

[email protected]

সর্বশেষ খবর