বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার

তসলিমা নাসরিন

রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার

প্রিয়াংকা চোপড়া, ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের দেখে বলেছেন, ‘তাদের কোনও ভবিষ্যত নেই। যদিও তারা হাসে, কিন্তু চোখের ভেতর একরাশ শূন্যতা। এই শিশুরা জানে না কাল তাদের কোনও খাবার জুটবে কি না। সামনের বর্ষায় হয়তো ধসে পড়ে যাবে ওদের ঘরবাড়ি। এই শিশুদের কথা ভাবতে হবে। বিশ্বের সবাইকে ভাবতে হবে।  এই শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যত’। ইউনিসেফ ন’ লক্ষ রোহিঙ্গাকে কলেরা থেকে বাঁচার ওষুধপত্র দিয়েছে, অপুষ্টিতে ভুগছে কিনা জানার জন্য আড়াই লাখেরও বেশি শিশুকে পরীক্ষা করেছে।

রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যত বলতে আসলেই কিছু নেই। মায়ানমারে কখনও ফিরে যেতে পারবে কিনা, ঠিক নেই। বাংলাদেশেই যদি বাস করে, তাহলে কী রকম হবে তাদের জীবন? খাদ্য না হয় কোনও না কোনওভাবে জুটবে, বস্ত্র না হয় কেউ না কেউ দান করবে। কিন্তু অন্ন, বস্ত্র আর মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই তো বাঁচা হয় না। বাঁচতে হলে ভালো শিক্ষা চাই, সততা চাই, সচেতনতা চাই, স্বনির্ভরতা চাই, সর্বোপরি ভালো মানুষ হওয়া চাই। তারা কি আদৌ ভালো মানুষ হওয়ার কোনও পরিবেশ পাচ্ছে?

প্রতিদিন ৬০ শিশুর জন্ম হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। যে শরণার্থী নিজেরাই অনিশ্চিত জীবনযাপন করছে, তারা আরো অনিশ্চিত জীবনের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। মিয়ানমারেও তারা রাষ্ট্র নেই, শিক্ষা নেই, অধিকার নেই, স্বাধীনতা নেই—এভাবেই বেঁচেছে। রোহিঙ্গা শিশুরা এর চেয়ে ভালো কোনও জীবন পেয়ে অভ্যস্ত নয়। এ বছর শুনেছি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৫০ হাজার শিশুর জন্ম হবে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু। তার পরও আরো ৫০ হাজার যোগ হতে যাচ্ছে। সেদিন দেখলাম বারো তেরো বছর বয়সী রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। বিবিসির একটা খবরও দেখলাম রোহিঙ্গা মেয়েদের দিয়ে টাকার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করানো হচ্ছে। অভাব মানুষকে পতিতাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য করে। রোহিঙ্গা তরুণী আর শিশুদের গোপনে ঢাকা, কাঠমান্ডু আর কলকাতায় পাচার করা হচ্ছে।

কিশোরী মেয়েদের যখন ইস্কুলে যাওয়ার কথা, যাচ্ছে শরীর বিক্রি করতে, একই রকম বালক কিশোরদের যখন লেখাপড়ায় মন দেওয়ার কথা, নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য বিক্রি করছে। মায়ানমারে এর চেয়ে ভালো জীবন ওদের ছিল না। ভয়ঙ্কর রকম নিষ্পেষণ আর নির্যাতন ছিল। একদিকে ওদের জন্য ভালো যে, ওদের কথা এখন বিশ্ব জানে, নানা দেশ, নানা সাহায্য সংস্থা, এমন কী জাতিসংঘ—রোহিঙ্গারা যেন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর নিরাপত্তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে—তার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও নেমেছে রোহিঙ্গাদের দেখভাল করতে।

প্রায় পঁচিশ হাজার এতিম শিশু আছে শরণার্থী শিবিরে, যাদের অনেকে চোখের সামনে দেখেছে কী করে তাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনকে খুন করা হয়েছে, সেসব বীভৎস দৃশ্য। এই শিশুদের মানসিক আঘাত কাটিয়ে উঠতে জানি না কেউ সাহায্য করছে কি না।

আমার মনে হয় না শরণার্থী শিবির কারও ঠিকানা হওয়া উচিত। ঝড় তুফান সাইক্লোনে উড়ে যাবে ওদের ঘর। মায়ানমারে ফিরে গিয়ে স্থায়ী আবাস কোনও দিন পাবে বলেও মনে হয় না। অনেকে আর ফিরে যেতে চায় না ওদেশে। যে ভয়াবহ নৃশংসতা দেখেছে, কে আর ফিরতে চায় ধ্বংসস্তূপে? তার চেয়ে শরণার্থী শিবিরে না রেখে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হোক রোহিঙ্গাদের। লেখাপড়া করার, মানুষ হওয়ার, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি করার, স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার দেওয়া হোক। বাকি বাংলাদেশিরা যে অধিকার নিয়ে বাঁচে, একই অধিকার রোহিঙ্গাদেরও দেওয়া হোক। তারা মিশে যাক মূলস্রোতে। আর সবার মতো বাঁচুক। যত তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হবে, তত তারা ভুগবে পরিচয়হীনতায়। যত তাদের একঘরে করে রাখা হবে, তত বাড়বে তাদের অপরাধ প্রবণতা। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, দুর্নীতি, দুর্দশা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, নারীবিদ্বেষে এমনিতে ছেয়ে আছে সমাজ। রোহিঙ্গারা বাঙালি সমাজে মিশে গেলে মোটেও বেখাপ্পা দেখাবে না। মূলত তারা তো বাঙালিই, চট্টগ্রামের গ্রামীণ সংস্কৃতিই তাদের সংস্কৃতি। আধুনিক সমাজের তুলনায় রোহিঙ্গারা যত পিছিয়ে আছে, তত পিছিয়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষই আছে। তারাও খেটে খায়, রোহিঙ্গারাও খেটে খাবে। এর মধ্যে কারও কারও প্রতিভা থাকলে ভিন্ন কিছু, বড় কিছু হতে পারবে।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিয়ে নয়, আরসা অর্থাৎ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে নিয়েই সমস্যা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, গত বছর আগস্ট মাসে মায়ানমারের হিন্দুদের গণহত্যা করেছিল রোহিঙ্গা জঙ্গি দল আরসা। মায়ানমারের হিন্দুরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনও অত্যাচার করেনি, অত্যাচার করেছিল মায়ানমারের মিলিটারি বা মায়ানমারের সরকার। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের পুলিশ মিলিটারিদের আক্রমণ করলে অনুমান করতে পারি ওদের নির্যাতনের প্রতিশোধ নিয়েছে, কিন্তু হিন্দুদের গণহত্যা করার কারণ কী? ওরা অমুসলিম বলে? এ কারণেই হয়তো ভারত আশ্রয় দিতে চায়নি রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরসার সদস্য বা সমর্থক হয়তো কেউ আছে, তারা যেন আবার বাংলাদেশের হিন্দুদের অত্যাচার না করে।

দেশের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব দেশের সরকারের। হিন্দুরা যেমন নিরাপত্তার দাবি করতে পারে, একই রকম দাবি এখন রোহিঙ্গারাও করতে পারে। দেশের নাগরিক, বসবাসকারী, পর্যটক, অতিথি, আশ্রিত— সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। রোহিঙ্গাদের দুষ্কর্ম থেকে সাধারণ মানুষের যেমন নিরাপত্তা দরকার, সাধারণ মানুষের ঘৃণা থেকেও নিরাপত্তা দরকার রোহিঙ্গাদের।

বাংলাদেশ ছাড়া এত বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আর কোনও দেশ আশ্রয় দেয়নি। ভারতের মতো দেশ, যে দেশ চিরকাল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, সেই দেশও রোহিঙ্গাদের জন্য দরজা খোলেনি। রোহিঙ্গাদের কোনও সুনাম নেই। তাই এদের কেউ চায় না। বাংলাদেশই যখন উদারতা দেখিয়েছে, আরো উদারতা দেখাক বাংলাদেশ। নিজের সন্তানের মতো রোহিঙ্গাদের কোলে তুলে নিক। সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা পড়ে আছে নো ম্যান্স ল্যান্ডে, ওদের জন্য খুলে দিক বাংলাদেশ তার দরজা। গরিব হলেও উদার, বাংলাদেশকে এভাবেই সম্মান করছে বিশ্ব।

প্রিয়াংকা চোপড়া রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে খেলা করেছেন।  যে আন্তরিকতা তিনি দেখালেন, তার তুলনা হয় না। শিশুরা যেন পৃথিবীর সর্বত্র তাদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বাঁচে। শৈশব খুব মূল্যবান একটি সময়, এই সময়টায় সহানুভূতি, সমবেদনা, আর স্নেহ পেলে জীবনে সঠিক পথে চলতে সুবিধে হয়, আর শৈশব যদি কাটে হিংসে, ভায়োলেন্স, লোভ, লালসা, কুশিক্ষা, কুচিন্তা দেখে, তবে বাকি জীবন এই পাক থেকে বেরোতে খুব কম মানুষই পারে।

শিশুদের কোনও ধর্ম, জাত থাকে না।  শিশুরা নিরীহ। অসহায় শিশুদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার আপনার সবার। আমি আপনি থাকবো না, এই শিশুরাই তখন পৃথিবীতে বিচরণ করবে। আজ যে শিক্ষা তাকে দেবো,  সেই শিক্ষাই তার পাথেয় হবে।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর