শনিবার, ২৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রমজানে খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও আমাদের মূল্যবোধ

মুনতাকিম আশরাফ

রমজানে খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও আমাদের মূল্যবোধ

পবিত্র রমজান মাসে ইফতারিসহ সব খাদ্য ভেজালমুক্ত করার দাবি দেশের আপামর জনসাধারণের। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন (২০১৫)  দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই দাবির অনেকটাই পূরণ হতে পারে। আর সাধারণ ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষা হবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন (২০০৯) কঠোরভাবে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারলে। একই সঙ্গে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থাও করতে হবে। সরকার কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অনেকটাই উদার। সরকারি পদক্ষেপ থেমে নেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইন বাস্তবায়নে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারক ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪-এর ২৫(গ) ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী আমলাতন্ত্রকে। কেননা, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিষ ও ভেজালমুক্ত এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। যার পুরোটাই বাস্তবায়িত হয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দিয়ে। কিন্তু নানাবিধ জটিলতায় তা আটকে যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না ঠিকমতো। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দেশের জনগণকে। যার ব্যর্থতার প্রচ্ছন্ন দায়ভার এসে পড়ছে সরকারের ওপরই। এতে যেমন এক শ্রেণির মুনাফাখোর ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছে। তেমনি ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার থেকে।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যেই এখন ফরমালিনসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল নামের নীরব ঘাতক বিষ মেশানো হচ্ছে। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রতিটি স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে এই বিষ। এদিকে ভালো খবর হলো, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, রমজান মাসে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য ও পানীয় প্রস্তুত এবং বিপণন বন্ধে বিএসটিআই ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাজধানীতে অতিরিক্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। রমজান মাসে ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও এ মাসে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও বেশি সতর্ক ও চালু হয়ে ওঠে। ইফতারের অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন মুড়ি, খেজুর, ফল ও এ জাতীয় পণ্যে ভেজাল দেওয়া হয় অসহনীয় মাত্রায়। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী, মুড়ি উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রো সালফায়েড, যা হাইড্রোজ হিসেবে পরিচিত। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও এ নিয়ে তেমন সাড়া-শব্দ নেই। হাইড্রোজ মেশানোর ফলে মুড়ি ফুলে-ফেঁপে ওঠে বলে ব্যবসাও ভালো হয়। এই ভালো ব্যবসার তাগিদ থেকে অসাধুরা এ কাজটি আরও আগ্রহ নিয়ে করে থাকেন। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির খবরে দেখানো হয়, কীভাবে চিনি দিয়ে তৈরি হচ্ছে গুড়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, চিনি ও মেডিসিন দিয়ে তৈরি হয়েছে এসব। যতই আগ্রহ নিয়ে ভেজালবিরোধী অভিযানের কথা বলা হোক না কেন, প্রকৃত অর্থে ছোটখাটো অভিযান ও সামান্য জেল-জরিমানায় বড় বড় এসব অসাধু ব্যবসায়ীর যে তেমন কিছু হয় না, তা আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ দেখে আসছি। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের কথা ছাড়াও ১৪ বছরের জেলের বিধান থাকলেও এগুলো কার্যত খাতা-কলমে রয়ে গেছে। আমরা যদি শাস্তির আওতা ও প্রয়োগ বাড়াতে না পারি, তবে শুধু মৌখিক হুমকি-ধমকি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। একটি সভ্য দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি থাকতে পারে না। মানুষকে এ ধরনের জিম্মি দশা থেকে বের করে আনতে সরকার দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তবুও মাঝেমধ্যে যেন মনে হয় এই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সরকার ও সরকারি আইনকানুনকে তোয়াক্কা করেন না। মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের এক গবেষণা বলছে, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সারা দেশ থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্যদ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এক গবেষণায় বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। পরিসংখ্যান যে তথ্য আমাদের সামনে হাজির করছে তা নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর। আমরা যদি এখনই এই ভেজালের লাগাম টেনে ধরতে না পারি, তবে ভবিষ্যতে নানা ধরনের অসুখ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি রয়েছে। আমাদের যারা ব্যবসায়ী মহল রয়েছেন, তাদের কর্তব্য হলো অসাধুদের তাদের ফোরাম ও গোত্র থেকে বের করে দেওয়া। সরকারকেও এ অসাধু ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বন্ধসহ কঠোর শাস্তি বিধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একটি স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কারসাজিতে সেই উদ্যোগকে ব্যাহত হতে দেওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানে এই অসাধু ব্যবসায়ীদের অসততায় কোটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা মোটেই সমীচীন নয়। তাই, সরকারি উদ্যোগকে যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সুস্বাস্থ্যের ও স্বনির্ভর জাতি গঠনে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজের দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হতে হবে। তবেই সম্ভব একটি সুখী সমৃদ্ধ জাতির নিশ্চয়তা।  যা প্রধানমন্ত্রীর ভিশন টোয়েন্টিওয়ানের  অন্যতম প্রতিপাদ্য।

লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন এফবিসিসিআই।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর