শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান সফল হতেই হবে

প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান সফল হতেই হবে

আমেরিকান উপন্যাস লেখক ফিলিপ কে ডিকের বর্ণনায়, ‘মাদকের অপব্যবহার কোনো রোগ নয়, এটা একটা সিদ্ধান্ত। এটা একটা চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো। এটাকে আপনি রোগ বলতে পারেন না, বলতে পারেন চরম একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা গ্রহণ করলে ব্যক্তির কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটে। মাদক একটি গ্লোবাল বা বৈশ্বিক সমস্যা। এর শিকার বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও অনুন্নত দেশ। মাদকের কারণে আর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশে আফিম ও ভাংয়ের প্রচলন সুপ্রাচীন। বিগত তিন দশকে হেরোইন, এম্ফিটামিন, কোকেন ও নানা ভেষজ ওষুধ রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে প্রবেশ করেছে। একসময় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল অর্থাৎ মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড কিংবা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অর্থাৎ আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ ড্রাগ পাচারে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবতা হলো, আজ বাংলাদেশই মাদকের বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। কোনো কোনো সংস্থার মতে ৭০ লাখ, নব্বইয়ের দশকে যার পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১০ লাখেরও কম। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তার ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত।

বর্তমানে যে মাদকটিতে দেশ সয়লাব তা হলো ইয়াবা। এর আগে এ স্থানটি ছিল ফেনসিডিলের দখলে। ইয়াবা আসার পর ফেনসিডিলের নাম খুব বেশি শোনা যায় না। ইয়াবার বাজার এমনই সহজলভ্য যে, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও এটা খুব অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছে। যদিও প্রতিদিন লাখ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে তথাপিও এর বাজার কমেনি একটুও। বরং মাদকের নেটওয়ার্ক প্রতিনিয়ত বিস্তার লাভ করারই খবর পাওয়া যায়। পত্রিকার রিপোর্ট ও জরিপ সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দিন দিন ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। উচ্চ ও মাধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে এই ঝোঁক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাদকাসক্ততা বেশির ভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে।

তরুণসমাজ সাধারণত কৌতূহল থেকেই মাদকের সংস্পর্শে আসে। সিগারেট-গাঁজা দিয়ে এর হাতেখড়ি। এরপর সহজলভ্য ওষুধপণ্যের অপব্যবহার দিয়ে তার এই নেশার জগতে যাত্রা হয়। অপব্যবহার থেকে ব্যাপারটা তার অভ্যাসে দাঁড়ায় যা পরে আসক্তিতে রূপ নেয়। এই তরুণসমাজের অবক্ষয় আমাদের চিন্তার কারণ। এদেরই আমরা আগামী দিনের কাণ্ডারি মনে করি, মনে করি দেশ গড়ার কারিগর। দেশের সম্পদ এই তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে গেলে দেশের সমৃদ্ধতার গতি আমরা ধরে রাখতে পারব না। কোনো একটি পরিবারের আদরের সন্তান যখন নেশাগ্রস্ত হয় তখন ওই পরিবারটিকে চরম অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

আমরা ঐশীর ঘটনা দেখেছি। বাবা পুলিশের স্পেশাল  ব্রাঞ্চের (পলিটিক্যাল শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান আর মা স্বপ্না রহমানকে হত্যা করে ঐশী। নেশা তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে আপনজন বাবা-মাকে হত্যার মতো চরম নিষ্ঠুরতার পথে চলতে শিখিয়েছিল। ঐশীর মতো অসংখ্য সন্তান আজ বাবা-মায়ের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বনাশা মাদক থেকে এই তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন, বিভিন্ন এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। জ্যামাইকান সংগীতশিল্পী বব মার্লে বলেন, ‘ওষুধ মানুষকে সুস্থ করে, কিন্তু অ্যালকোহল পুরো জাতিকে ধ্বংস করে।’ যাদের নিয়ে জাতি স্বপ্ন দেখে সেই তরুণসমাজ যখন বিপদগামী, মাদকের করাল গ্রাসে নিপতিত তখন জাতিকে এটা নিয়ে ভাবতেই হবে। মাদকের কারণে পুরো সমাজটা পচে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তরুণরা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য অর্থের জন্য বন্ধুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে কুপিয়ে হত্যার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটাচ্ছে এই মাদকাসক্ত তরুণরা। এই সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে।

সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা, সমাজপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকতে দেখা যায় মাদক ব্যবসায়। সমাজের প্রভাবশালী এই অংশ গড়ে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য (ইনভিসিবল) সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট দেশের শহর-নগর, মফস্বল, গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে প্রতিটি জনপদে গড়ে তুলেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। তারা এ ব্যবসায় কাজে লাগাচ্ছে নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরকেও। প্রতিনিয়ত এই নেটওয়ার্ক যে দারুণভাবে বিস্তার লাভ করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশে মাদকাসক্তের ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী।’ ওই প্রতিবেদনের অন্যত্র বলা হয়, ‘বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে এ সংখ্যা ১৫ শতাংশ।’ অথচ মাদক বিক্রয়ে কঠোর আইন রয়েছে। খবরে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ব্যবসায় জড়িত সন্দেহে যাদের ধৃত হওয়ার খবর পাওয়া যায় তাদের অধিকাংশই হলো চুনোপুঁটি। রাঘব-বোয়ালরা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাদক আইনে মামলা হয়েছে ১১ হাজার ৬১২টি। ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩ হাজার ২৮৯টি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা প্রকাশ করে, ‘২০১৭ সালে ২ হাজার ৫৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ১৬টি মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। আর আসামি খালাস পেয়েছে ১ হাজার ৫২৮টি মামলায়।’ মাদকবিরোধী আইনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।

২৮ মে দেশের জনপ্রিয় একটি দৈনিক (ইত্তেফাক) ‘রাজধানীতে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ১৩৮৪ জন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘রাজধানীতে তালিকাভুক্ত ১৩৮৪ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। ৪৯টি থানা এলাকায় নিজস্ব জোন ভাগ করে তারা দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। এসব মাদক ব্যবসায়ীর কাছে টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে মাদকের বড় বড় চালান চলে আসছে। সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথ দিয়েও রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে মাদক পৌঁছায়। তবে রাজধানীতে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত উেকাচ নিচ্ছেন কিছু রাজনীতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একশ্রেণির কর্মকর্তা।’ শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনটির তথ্যমতে ‘মাদকের টাকা থানার কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনীতিক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা নিয়মিত পাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাগ না দিয়ে মাদক ব্যবসা করা অসম্ভব। রাজধানীর অনেক পুলিশ সদস্যের বাসা ভাড়ার টাকা মাদক ব্যবসায়ী বহন করেন। শুধু তাই নয়, পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার মাদক ব্যবসায়ীরা বহন করেন।’

এ প্রতিবেদনটি আমাদের উদ্বিগ্ন করে। যারা ডাক্তার, যারা রোগীর অসুখ নিরাময় করবেন, তারা নিজেরাই যখন রোগাক্রান্ত তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। প্রশাসন যখন মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে তখন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে আগেই খবর পৌঁছে যায়। ফলে নিরাপদ দূরত্বেই থেকে যায় অপরাধীরা।

মাদকের মরণ ছোবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষায় সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিশেষ কোনো কার্যকর উদ্যোগ ইতিমধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। এ সম্পর্কিত দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর’ ছকবাঁধা কিছু রুটিন কাজের মধ্যেই নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিল। আশার দিক হলো, রাষ্ট্র দেরিতে হলেও এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, ‘মাদক তৈরি, বিক্রি, পরিবহন এবং সেবনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাই সমানভাবে দোষী বলে প্রধানমন্ত্রী অভিমত ব্যক্ত করেছেন।’ মূলত প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশেই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে আজ সোচ্চার। মাদকের ভয়াবহ পরিণাম থেকে দেশকে রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাই প্রমাণ করে ব্যাপারটিতে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২২ মে, ২০১৮ সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।’ আমরা সারা দেশের মানুষ এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সম্প্রতি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) পক্ষ থেকে জাতীয় পত্রিকায় প্রজ্ঞাপন দিয়ে তাদের মাদকবিরোধী অভিযানের কথা জানানো হয়। এ প্রজ্ঞাপনের স্লোগান ছিল— ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’। মূলত ৪ মে থেকে র‌্যাব মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযানে নামে। রাজধানীতে ১ হাজার ৩৮৪ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা ধরে চলছে অভিযান। সারা দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা নিয়েও কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‌্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, মাসব্যাপী ৮৩৭টি অভিযানে গ্রেফতার হন ১ হাজার ২৬ জন। উদ্ধার করা হয়েছে শত কোটি টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য। মোবাইল কোর্টে তাত্ক্ষণিকভাবে বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও দেওয়া হয়েছে অনেককে। গত বছরের নভেম্বরে র‌্যাব সদর দফতরে র‌্যাব মহাপরিচালকের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলাম। সেদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের মাঝে কথা হয়। ভেজালবিরোধী অভিযানে তাঁর সফলতায় আমি তাঁকে সাধুবাদ জানাই এবং দেশে মাদকদ্রব্যের বিস্তার ও এর ভয়াবহতা নিয়ে তাঁকে আমার উদ্বেগ প্রকাশ করি। সেদিন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের কণ্ঠে আমি মাদকের বিরুদ্ধে যে দৃঢ় অবস্থান লক্ষ্য করেছিলাম তা সত্যিই আমাকে আশা জাগিয়েছিল। আজ এর বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি। ত্বরিতকর্মা লোক হিসেবে বেনজীর আহমেদ শুধু আমার কাছেই নন, সারা দেশের সচেতন সমাজের কাছেই প্রশংসিত। এই মানুষটির প্রতি আমার বিশেষ মুগ্ধতা রয়েছে। আমি এ অভিযানে ভেজালবিরোধী অভিযানের মতোই সফলতা কামনা করি।

এ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জীবন বাজি রেখে অপরাধী দমনে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হচ্ছে। চিহ্নিত গডফাদারদের বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন কেউ কেউ। ক্রসফায়ারের এ ঘটনায় নিন্দা জানাচ্ছেন কোনো কোনো সামাজিক সংগঠন কিংবা সুশীলসমাজের কেউ কেউ।

আমরা কেউই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে নই। বিশেষ করে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। ২৬ মে টেকনাফে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে তিনি নিহত হন। একরামুল হক আদৌ দোষী কিনা তা আমরা জানি না। তার মেয়ের আহাজারি আমরা শুনেছি। এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। একটি ভুল একটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে নষ্ট করে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কিছু ইস্যু সামনে এনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলে এ অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রয়াস পাচ্ছে। ইতিমধ্যে এ অভিযানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির একটি পরিবেশও আমরা দেখতে পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি বা আমরা কেউই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না। কিন্তু একটা বিষয় আমি বিশ্বাস করি, তা হলো— মাদকের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে পরাজিত হলে ফিরে আসার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এবার ছাড় পেয়ে গেলে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কোনো বাঁধনেই আর বাঁধা যাবে না। কাজেই সতর্ক থাকতে হবে, অপপ্রচারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যেন কেউ ফায়দা লুটতে না পারে। শুধু শত্রুতার কারণে যেন কোনো ব্যক্তি বা পরিবার ক্ষতির শিকার না হয়, তাও লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ অভিযানকে যেন কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। দেশের কোনো রুটেই যেন মাদকদ্রব্য অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অব্যাহত রাখতে হবে মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিক্ষক ও গার্ডিয়ানরা গাইড করবেন শিক্ষার্থীদের। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে হবে। মাদকবিষয়ক দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রশাসনে লুকিয়ে থাকা অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

আমেরিকান নভেলিস্ট ওয়েনডেল বেরি তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য আর্ট অব দ্য কমন প্লেস’-এ ড্রাগের ব্যবহার বৃদ্ধি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মানুষ বৈধ বা অবৈধভাবে ড্রাগ গ্রহণ করছে কেননা তাদের জীবন অসহিষ্ণুভাবে বেদনাদায়ক নির্জীব। তারা তাদের কাজ ঘৃণা করে কারণ তারা দেখে তাদের কোনো অবসর সময় নেই। তারা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের থেকে বিতাড়িত।’ উল্লিখিত উক্তিটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের কাজের সঙ্গে সঙ্গে নির্মল বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজকে খেলাধুলাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

আমাদের ছোট্ট এই দেশটি আয়তনে ছোট হলেও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। অপার সম্ভাবনার এই দেশটি নিয়ে আমরা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলেছে। আমাদের অনেক অর্জন। শুধু মাদকের কারণে আমাদের এসব অর্জন ব্যর্থ হতে পারে না। সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই এই মাদককে নির্মূল করতে হবে। আসুন জাতি-ধর্ম, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সবাই মিলে এই আন্দোলনে শামিল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে সরকারের পাশে থাকি।

 

লেখক : প্রফেসর, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি খুলনা। চেয়ারম্যান, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ট্রাস্ট।

সর্বশেষ খবর