সোমবার, ১১ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

সুরতহাল রিপোর্টের গরমিল

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

সুরতহাল রিপোর্টের গরমিল

দুই কর্মঠ সন্তান, স্ত্রী, নাতি-নাতনি নিয়ে ভালোই কাটছিল রহিমা খাতুনের সংসার। একদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষরা তাদের বাস্তুভিটায়  অবৈধ জনতায় দলবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে নিহত হন রহিমা খাতুন।  দুই সন্তান, স্ত্রী-সন্তানরাও আহত হন। প্রতিপক্ষরা তাদের জমিজমা দখল করে নেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা হয়।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা মৃত মায়ের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। এখানে জেনে নেওয়া যাক সুরতহাল রিপোর্ট কী। ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৪ ধারা মোতাবেক কোনো অপমৃত্যুর সংবাদের প্রেক্ষিতে পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে উক্ত মৃত ব্যক্তির পা হতে মাথা পর্যন্ত ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে যে কারণে তার মৃত্যু হয়েছে আপাত দৃষ্টিতে উক্ত মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করার জন্য যে রিপোর্ট তৈরি করা হয় তাকে সুরতহাল রিপোর্ট বলে। (পিআরবি-২৯৯)।

সুরতহাল প্রতিবেদনে মামলার বাদী ছাকু মিয়াসহ অনেকেই টিপসই দেন, কেউ কেউ দস্তখত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত রহিমা খাতুনের বাম চোখের ভ্রুর ওপর কাটা চিহ্ন, চোখের নিচের হাড় ভাঙা, মাথার পেছনে আঘাত। আর ডান দিকের গালে একটি কালসিটে দাগ আছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তাই লিখেন। আর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাতের ধাক্কা ও রক্তক্ষরণের কথাই উল্লেখ করেন। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির ঠিক আধা ঘণ্টা আগে বাদী ছাকু মিয়া থানায় যে এজাহার দাখিল করেন তাতে বলা হয় যে, মৃত ভিকটিমের ডান চোখের ওপর কাটার দাগ। আসামিরা ধারালো অস্ত্র (বেকি) ও ছুরি দিয়ে মৃত রহিমা খাতুনের ডান চোখের ওপর, ডান বুকে ও মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেছে। এজাহারের গর্ভে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের ক্ষতের স্থান হলো ডান চোখের ওপর আর প্রকৃত জখম হলো বাম চোখের ওপর। এ অসঙ্গতি নিয়ে মামলার তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে আসামিদের বেকসুর খালাস দেন। কিন্তু কেন? অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ও প্রধানতম কারণ ছিল মামলার এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থানের সঙ্গে (ডান চোখের ওপর) সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে বর্ণিত আঘাতের স্থানের (বাম চোখের ওপর) গরমিল। পোস্টমর্টেমকে বাংলায় বলা হয় ময়নাতদন্ত। পোস্টমর্টেমের আরেকটি নাম রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে ‘অটপসি’। সাধারণভাবে অটপসি হলো আইনানুগভাবে মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করা। কোন ব্যক্তি কখন, কীভাবে, কোথায়, কীসের দ্বারা মৃত্যুবরণ করেছে বা তার মৃত্যু কি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক এসব তথ্য জানার জন্য মৃতদেহকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক যে বিশেষ পরীক্ষা করা হয় তাকে পোস্টমর্টেম বা ময়নাতদন্ত বলে। যে কোনো হত্যা মামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি যথাযথ না হলে একটি হত্যা মামলা প্রমাণ করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি অপরাধীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্রও মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করেই মামলার বিচারকাজ পরিচালিত হয়। একটি হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর সেখানে প্রথমেই পুলিশ যায়। পুলিশ কর্মকর্তা গিয়েই লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। লাশটির শরীরে কেমন আঘাত, কোথায় আঘাত, চোখ, মুখ, নাক, চুল, মলদ্বার, লিঙ্গ এসবের অবস্থা তিনি যা দেখবেন, সেভাবেই বর্ণনা করবেন। এমনকি ক্ষত বা আঘাত মেপে তাও লিখবেন। ক্রাইমসিন আলামত সংগ্রহ করার পর সেই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য যে কোনো অনুমোদিত হাসপাতালে পাঠাবেন। হাসপাতালের নির্ধারিত চিকিৎসক লাশ গ্রহণের সময় একটি বর্ণনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেবেন। এরপর তিনি ময়নাতদন্ত করবেন। ভিসেরা সংগ্রহ করবেন। যেসব লাশের শরীরে দৃশ্যমান আঘাত থাকে সেগুলোর বিষয় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন চিকিৎসক। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন নেই, এমন লাশের মৃত্যুর কারণ জানতে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজাহারে একটি হত্যা মামলায় যদি দুটি ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ থাকে, সুরতহালেও তা-ই লিখতে হবে। কিন্তু ময়নাতদন্তে যদি রিপোর্ট আসে যে, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তখন ওই মামলা প্রমাণের জন্য গলার ছাপ নিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তারপর জানা যাবে কে বা কারা হত্যা করেছে। এভাবেই মূলত প্রতিটি রিপোর্ট মামলায় প্রভাব ফেলে।

বিচারিক আদালত অত্যন্ত নিপুণভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ ও উপস্থাপিত আলামত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্ত টেনেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যে পুলিশ কর্মকর্তা বাদীকে এজাহার লিখতে সহায়তা করেছেন, সেই কর্মকর্তাই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেই পুলিশ অফিসারই পুরো মামলাটি তদন্ত করেছেন। কিন্তু এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে অভিযোগপত্র দাখিল পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থানসংক্রান্ত গরমিলের সুরাহা করেননি। তার নিজের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদনে যেখানে বলছে মৃতের বাম চোখের ওপর আঘাত তখনো তিনি এজাহারে বর্ণিত ডান চোখের ওপরই ভর করে আছেন এবং অভিযোগপত্রেও ডান চোখের ওপর আঘাতের কথাই লিখে গেছেন। তার অভিযোগপত্রের স্বপক্ষে সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা জবানবন্দিতেও একই ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন।  মামলার তদন্ত ও বিচারিক পর্যায়ে সাক্ষীদের জবানবন্দির নানা অসঙ্গতির মধ্যে প্রধানতম অসঙ্গতি ভিকটিমের চোখের আঘাতের ডান-বামের পাল্লায় পড়েই ‘সন্দেহের সুবিধা’ পুরো অংশই চলে গেছে আসামিদের পক্ষে। তাই তারা  বেকসুর খালাস।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

সর্বশেষ খবর