বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

জঙ্গিরা কোনো ভালো মানুষকে বাঁচতে দেবে না

তসলিমা নাসরিন

জঙ্গিরা কোনো ভালো মানুষকে বাঁচতে দেবে না

মুন্সীগঞ্জের শাহজাহান বাচ্চুকে কে হত্যা করেছে? আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি কে হত্যা করেছে। তাঁর আত্মীয় স্বজন, গ্রামবাসী, এমনকী পুলিশও অনুমান করছেন জঙ্গিরাই বাচ্চুকে খুন করেছে। জঙ্গিরা কেন খুন করবে বাচ্চুকে? খুন করেছে কারণ বাচ্চু এমন কিছু কথা ফেসবুকে লিখেছেন, যা জঙ্গিদের বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে না। জঙ্গিরা ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। এ আমরা সেই নব্বই দশকের শুরু থেকে দেখে আসছি। আমাকে নির্বাসনে যেতে হলো, কারণ মৌলবাদীরা আমার ভিন্নমত পছন্দ করছিল না বলে আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল। লক্ষ লক্ষ ধর্মীয় উগ্রবাদী রাস্তায় নেমেছিল আমার ফাঁসির দাবিতে। নব্বই দশকের শুরুতে যারা ফাঁসির দাবি করতো, তারাই বা তাদের যোগ্য সন্তানেরাই চাপাতি হাতে নিয়েছে সভ্য এবং প্রগতিশীল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশে। এক এক করে লেখক সাহিত্যিক ব্লগারকে হত্যা করেছে তারা।

কে ছিলেন শাহজাহান বাচ্চু? তিনি কোনো এক সময় মুন্সীগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিশাখা প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাতেন, সেখান থেকে অন্তত ৬০০ কবিতার বই বের করেছেন। ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করতেন। শুনেছি খুব সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তাঁর সঙ্গে কারও ভূসম্পত্তি, ব্যবসা বা ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল না। তাঁর বিশাখা প্রকাশনীর ব্যবসাটি নিজের কন্যাকে দিয়ে দিয়েছেন কয়েক বছর আগেই। বৈষয়িক বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। পড়াশোনা, আড্ডা, লেখালেখি— এসব নিয়েই থাকতেন। তাঁর সঙ্গে মতাদর্শ ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে কারও বিরোধ ছিল না। কী করতেন শাহজাহান বাচ্চু? বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে যা জেনেছি তা হলো : ‘তিনি অনেকটা অবসর জীবনযাপন করতেন। নিজের বাড়ি, ইছাপুরা বাজারের জয়ন্ত ঘোষের মিষ্টির দোকান, পূর্ব কাকালদি মোড়ে আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকান বা এসব বাজারে আরও কিছু দোকানের মধ্যেই সীমিত ছিল তাঁর আনাগোনা। সম্প্রতি আনোয়ারের দোকানে আড্ডা দেওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন বাচ্চু। তিনি থাকলে বেচা-বিক্রি কম হতো— দোকান মালিকের এমন অনুযোগের পরে আনোয়ার হোসেনের দোকানে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি নিজেই ফোন করে কাকলদি মোড়ে আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকানে আড্ডা দিতে যান। সেখানেই তিনি হত্যার শিকার হন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আনোয়ারের দোকানে বসে চা পান করেন শাহজাহান বাচ্চু। চা খাওয়ান দোকান মালিক আনোয়ার হোসেন। কথা ছিল শাহজাহান বাচ্চু সিগারেট খাওয়াবেন। সেইমতো চা পান শেষে সিগারেট কিনতে পাশের দোকানের সামনে যাওয়া মাত্রই হেলমেট পরা দুই আততায়ী তাঁর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরপর তারা পরপর দুটি বোমা ফাটিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে করে নিমতলির দিকে চলে যায়। ২০১৫ সালে যখন একের পর এক ব্লগার হত্যা করা হচ্ছিল, তখন শাহজাহান বাচ্চু প্রচুর হুমকি পেতেন। জীবন বাঁচাতে বেশ কিছুদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা জঙ্গি-নিধন অভিযানে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেন তিনি। তিন বছর আগে দেশে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক ও মুক্তবুদ্ধির লেখকদের ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটেছিল, তার সঙ্গে এ ঘটনার মিল দেখছেন ঢাকার পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, আনসারুল্লাহ বা সমমতাদর্শের কেউ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হতে পারে।

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে তখন গণজোয়ার। এ হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথম জানাজানি হয় সালাফি মতাদর্শের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) বা আনসার আল ইসলাম নামের সংগঠনের কথা। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে আবার হত্যাকাণ্ড শুরু করে আনসারুল্লাহ। আনসারুল্লাহ বা আনসার আল ইসলাম এ পর্যন্ত ১৩ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এঁদের বেশির ভাগই ব্লগার। এর বাইরে রয়েছেন প্রকাশক, শিক্ষক ও সমকামীদের অধিকারকর্মী। শাহজাহান বাচ্চুর স্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আমাদের বিক্রমপুর’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার চেষ্টা করছিলেন শাহজাহান বাচ্চু। দীর্ঘদিন থেকেই যে কোনো সময় হত্যার শিকার হতে পারেন— এমন আশঙ্কার কথা বলতেন। ফোনে ফেসবুকে হুমকি পেতেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘শাহজাহান বাচ্চুর লেখালেখির ধরন বা প্রোফাইল থেকে ধারণা করা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বা আনসার আল ইসলামের টার্গেট হতে পারেন তিনি। তবে আনসারুল্লাহ জঙ্গিরা সাধারণত হত্যার ক্ষেত্রে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। হামলায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ব্যবহৃত হাতে তৈরি গ্রেনেডের ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা জেএমবির কাজ। এটাকে জঙ্গিদের কাজ বলেই ভাবছেন তাঁরা।’

জেএমবি বা আনসারুল্লাহ-জঙ্গি মাত্রই ভাই ভাই, যে দলই খুন করুক না কেন, তারা একই উদ্দেশে খুন করে। তারা সভ্য আর প্রগতিশীল মানুষকে বাঁচতে দিতে চায় না। দেশ থেকে প্রায় সব ব্লগার পালিয়েছেন। তাঁরা এখন নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা ইত্যাদি দেশে বাস করছেন। তাঁদের সবার নাম হয়তো খুনিরা যে তালিকা বানিয়েছিল, সেই তালিকায় ছিল না, কিন্তু আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন প্রায় সবাই। আতঙ্কে ভুগতেন শাহজাহান বাচ্চুও। কিন্তু শাহজাহান বাচ্চুর পালানো হয়নি। কেন? তিনি ষাট পার হয়েছিলেন বলেই কি তাঁকে বাঁচানোর জন্য কেউ চেষ্টা করেনি? তাঁকে নিরাপদ কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা কেউ করেনি, যদিও তাঁর নাম জঙ্গিদের তৈরি করা ওই কালো তালিকায় ছিল। বয়স হয়েছে বলেই কি তাঁর বাঁচার প্রয়োজন ছিল না? এমন বয়স বৈষম্য মানতে পারি না।

কিন্তু পালিয়ে গেলেই দেশ চলবে? দেশে কি সভ্য মানুষ, চিন্তাশীল প্রগতিশীল, ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের জায়গা হবে না? সরকারের চোখের সামনে দেশ থেকে পালাচ্ছে সভ্য মানুষেরা, তারপরও সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দিতে রাজি নয়। শাহজাহান বাচ্চুকে কেন নিরাপত্তা দেয়নি সরকার জেনেও যে মানুষটিকে যে কোনো সময় খুন করতে পারে জঙ্গিরা?

শুধু জঙ্গি নিধন করেই জঙ্গি নির্মূল করা যায় না। চিন্তাশীল লোকদের নির্মূল করার জঙ্গি পরিকল্পনা যে অন্ধ বিশ্বাস থেকে আসে, সমাজে সেই অন্ধ বিশ্বাস অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। এই বিশ্বাস যতদিন থাকবে, ততদিন জঙ্গি থাকবে। ক্রসফায়ারে এদের উপড়ে ফেলা যায় না। জঙ্গিদের থেকে দেশকে, সমাজকে, মানুষকে বাঁচাতে হলে ওই অন্ধ বিশ্বাসকে চিরতরে সরিয়ে দিতে হবে। ওটি সরাতে হলে চাই যুক্তিবুদ্ধির চর্চা এবং সুশিক্ষা। সেটি চালু করতে সরকারের আপত্তি। সরকারের জন্য সহজ হলো জঙ্গিদের মতো আচরণ, গুলি করে মানুষ মেরে ফেলা।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর