বুধবার, ২০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা চায় তাদের মর্যাদা

অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর বলেছিলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন করবেন এবং এমন এক ধরনের সার্টিফিকেট ও পরিচয়পত্র প্রদান করবেন—যা নকল করা তো দূরের কথা ফটোকপিও করা যাবে না। তিনি দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু করেছিলেন। আমরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বারবার বলেছি—এটা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করার জন্য সব মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনকে নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক করতে। সেখান থেকে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ গ্রহণ করে প্রতিটি জেলায় একটি করে উপজেলাকে পাইলট প্রকল্প বেছে নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করতে। যেহেতু এখনো অন্তত ৫০% প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, সেহেতু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে শনাক্তকরণ এবং ভারতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা ভোটার তালিকা, গেজেট তালিকা, মুক্তিবার্তা তালিকাগুলো সমন্বয় ও পর্যালোচনা করলেই কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করা মোটেও অসম্ভব বা আহামরি কিছু নয়। কেননা, বাস্তবতার আলোকে এটা সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মাণ যে, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের অর্থই হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও ব্যক্তি শত্রুতার কারণে কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে বাদ দেওয়া এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানো।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর আরেকটি সরকারি কারখানা হচ্ছে—‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল’ বা ‘জামুকা’। বিএনপির আমলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন রেজওয়ান আহমেদ। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিমন্ত্রী তাদের দলের ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গণহারে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ডকে নির্দেশ দিলে কেন্দ্রীয় কমান্ড তা মানতে অস্বীকার করে। প্রতিমন্ত্রী রেজওয়ান আহমেদ সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়ে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল’ বা ‘জামুকা’ গঠন করান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বা জামুকা পরিচালনায় কোনো মুক্তিযোদ্ধার স্থান নেই। এটি ভুয়া ও অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা তৈরির একটি সরকারি কারখানা। এর অধীনেই নিবন্ধন নিতে হয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ সব মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলোকে। অথচ ‘জামুকা’ প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় এলেও এখন পর্যন্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরির কারখানা ‘জামুকা’ বহাল তবিয়তেই তাদের উৎপাদন কাজ অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে আজ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলেই প্রশ্ন চলে আসে ‘আপনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা’, না ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব কথা হৃদয়ে কী ধরনের রক্তক্ষরণ ঘটায় তা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই অনুধাবন করতে পারেন। এসবের অবসান হওয়া উচিত। নতুবা সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন কোয়ান্টিটি থিওরি অব মানির ন্যায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পাঁয়তারা করবে। আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সন্তানরাই তাদের শরীরে ‘আমি রাজাকার’ লিখে নাচছে-গাইছে—আর আমাদের হাজার হাজার সন্তানরা তার তালে তাল মিলিয়ে নেচে গেয়ে দেশকে অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। তাদের আচরণে বঙ্গবন্ধু কন্যাও কষ্ট পেয়ে কোটাপদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন ‘ইয়াবা’ ব্যবসায়ীরাও যদি কোটা বিরোধীদের মতো রাজপথে নেমে বলে, তাদের গ্রেফতার বা হয়রানি করা যাবে না, তাদের প্রকাশ্যে ইয়াবা বিক্রির অধিকার দিতে হবে। সেদিনও কি তাদের দাবি সরকার মেনে নেবে?  এ অবস্থা চলতে থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন লাখ লাখ নব্য রাজাকার ‘আমরা রাজাকার’ বলে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে কী করতে পারব জানি না। কেননা, খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবও একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে আমাদের জানা নেই।

সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের বিয়য়ে কৃপণতা ও কালক্ষেপণের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে—একটি মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন গত চার বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহনির্মাণের ১০ লাখ টাকা ঋণপ্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সুপারিশসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করে। ঋণ পরিশোধের জন্য স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সম্মানীভাতার অর্থ থেকে ৫০% অর্থ কর্তন সাপেক্ষে এ ঋণের অর্থ সমন্বয় করা হবে। ‘এত টাকা কোথা থেকে পাব’—এই অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহঋণ বাবদ ১০ লাখ টাকা প্রদানের প্রস্তাবটি এখন পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রেরণ করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। অথচ বাংলাদেশে ১৮ লাখ সরকারি কর্মচারীর গৃহনির্মাণ নীতিমালা-২০১৮ এর আওতায় গ্রেড ভেদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের কর্মচারীদের ঋণ দেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ৫% সুদে সর্বোচ্চ এক কোটি ও সর্বনিম্ন ৬০ লাখ টাকার ঋণ নেওয়ার প্রজ্ঞাপন অতি সম্প্রতি জারি করা হয়েছে। ১৮ লাখ সরকারি কর্মচারীদের লাখো কোটি টাকা ঋণ দিতে সরকারের অর্থের অভাব নেই, অভাব শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে। এভাবেই চলছে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চরম অবহেলা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয় অনুরোধ দেশের সূর্যসন্তানদের নিয়ে যেন কেউ কটূক্তি বা ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে না পারে সে জন্য এমন একটি নীতিমালার আলোকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়ন করে তা জাতীয় সংসদ থেকে পাস করিয়ে নিয়ে একটি গেজেট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা প্রণয়ন ও প্রকাশ করতে।

লেখক : ৭ নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা।

সর্বশেষ খবর