শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমাদের ক্ষমতা আমাদের অধিকার

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমাদের ক্ষমতা আমাদের অধিকার

১. কিছু দিন আগে আমার সঙ্গে দুই ছাত্রী দেখা করতে এসেছে। রাগে দুঃখে ক্ষোভে তাদের হাউমাউ করে কাঁদার মতো অবস্থা, কিন্তু বড় হয়ে গেছে বলে সেটি করতে পারছে না। তারা দুজনে খুবই ভালো ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্রছাত্রীদের নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার একটা স্বপ্ন থাকে। তবে শিক্ষকতার আবেদন করার জন্য একটা নির্দিষ্ট গ্রেড থাকতে হয়। সেই গ্রেড থেকে কম গ্রেড হলে আবেদনই করা যায় না।  ছাত্রী দুজন আমাকে জানাল, তারা যেন কোনোভাবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করতে না পারে সেই জন্য তাদের একটি কোর্সে খুব হিসাব করে মার্কস কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোর্সের টার্ম টেস্টে তারা কত পেয়েছে সেটাও তাদের জানতে দেওয়া হচ্ছে না। তারা তাদের পরীক্ষার খাতাটি নতুন করে দেখানোর জন্য দোরে দোরে ঘুরেছে, কোনো লাভ হয়নি।

আমি তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেব বুঝতে পারিনি, তাদের কথা শুনে বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় সিস্টেমে বহুদিন থেকে আছি, এই ব্যাপারগুলো এতবার দেখেছি, এতভাবে দেখেছি যে মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে নিজের ওপরই ঘেন্না ধরে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, একজন বা কয়েকজন শিক্ষক মিলে চাইলেই একজন ছাত্র বা ছাত্রীর পুরো জীবনটা ধ্বংস করে দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য একজন শিক্ষকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাক্যটি হচ্ছে, ‘তোমাকে আমি দেখে নিব’। এবং তারা দেখে নেয়।

বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করেছি। এক সময় যখন আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছি তখন আমি অনেকবার ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কথা বলেছি, পরীক্ষার খাতা দেখার ব্যাপারে স্বচ্ছতার কথা বলেছি। মনে আছে একেবারে শুরুর দিকে আমি একাডেমিক কাউন্সিলে প্রস্তাব দিয়েছিলাম পরীক্ষার খাতা দেখার পর শিক্ষকরা যেন খাতাগুলো ছাত্রছাত্রীদের ফেরত দেন, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা জানতে পারবে তারা কোথায় কী ভুল করেছে। আমার কথা শুনে পুরো একাডেমিক কাউন্সিল এমনভাবে হই হই করে উঠেছিল যেন আমি একটা পাগলা গারদ থেকে ছুটে বের হয়ে এখানে চলে এসেছি! কেউ কী জানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে পরীক্ষার খাতা দেখতে হয় খাতাটিতে কলম স্পর্শ না করে? যাই হোক আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করার কোনো পথ নেই। কোনো কোনো শিক্ষক তাদের ওপর এই ভয়ঙ্কর অবিচার করেই যাবে তারা বিচারের জন্য কোথাও যেতে পারবে না। তখন হঠাৎ করে আমার মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের (কিংবা বাংলাদেশের যে কোনো মানুষের) হাতে যে একেবারে কোনো অস্ত্র নেই সেটি সত্যি নয়। এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না যে এই দেশে একটা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রয়োজনীয় আইন আছে যেটা ব্যবহার করে অনেক কিছু করে ফেলা যায়। সেই আইনটি হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯। খুবই সহজ করে বলা যায় এই আইনটি ব্যবহার করে আমরা সরকারের কাছ থেকে সরকারি কাজ সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য জানতে পারি। তথ্য বলতে বোঝানো হচ্ছে সরকারি অফিস কিংবা জনগণের টাকায় চালানো বেসরকারি অফিসে রাখা ফাইলে, দলিলে, কম্পিউটারে রাখা যে কোনো তথ্য। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা এ ধরনের কিছু তথ্য জানা যাবে না কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো জানার কোনো প্রয়োজনও থাকে না— যে তথ্যগুলো জানতে পারলেই কেউ আমাদের ওপর অবিচার করতে পারবে না সেই তথ্যগুলো আমাদের জানার পুরোপুরি অধিকার আছে।

কাজেই আমাদের সেই ছাত্রী দুজন যদি তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাদের পরীক্ষার নম্বর বের করে নিয়ে আসতে পারত তাহলে সত্যিই তাদের ওপর অবিচার করা হয়েছে কিনা সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অমানুষ শিক্ষকরা যদি বুঝতে পারে এতদিন যে অস্বচ্ছ দেয়ালের আড়ালে বসে তারা তাদের কাজকর্ম করে এসেছে সেই দেয়ালটা যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো ছাত্র গুঁড়িয়ে ফেলতে পারবে তাহলে তারা অপকর্ম করার সাহস পাবে না। একটা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী অস্ত্র দেশের একেবারে সাধারণ মানুষের হাতে কখনো এসেছে বলে আমার জানা নেই।

২. বছরখানেক আগে আমার মনে হলো এই তথ্য অধিকার আইন সত্যিই কাজ করে কিনা সেটা একটু পরীক্ষা করে দেখি। আমার জন্য পরীক্ষা করার সবচেয়ে সহজ জায়গা হচ্ছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন এমন একজন ভাইস চ্যান্সেলর রাজত্ব করছেন যিনি ছাত্রলীগের ছাত্রদের ব্যবহার করে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলিয়েছেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্যে প্রায় ঘোষণা দিয়েই টেন্ডারবাজি করে, নানারকম বাণিজ্যের কথা শোনা যায়। তবে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে আমি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অফিসের ফাইলপত্রে রাখা তথ্যটুকু জানতে পারব, সেই তথ্যগুলো কেন এরকম বা তার প্রতিকার চাইতে পারব না।

তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তিনটি ভিন্ন চিঠিতে তিনটি তথ্য জানতে চাইলাম। (১) আগের ভাইস চ্যান্সেলর তাদের নানা মিটিংয়ে কত টাকা সম্মানী নিয়েছেন এবং বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর কত নিচ্ছেন। (২) বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের ছাত্র সংগঠনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে? (৩) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নকল করে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হওয়া একজন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তার সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চিঠি পাঠিয়ে আমি বসে আছি কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। অনেক দিন পার হওয়ার পর আমি আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে আমার আবেদনের ফলাফল জানতে চাইলাম। এবারও কোনো উত্তর নেই। আমি মোটামুটি কাতর গলাতে রেজিস্ট্রার মহোদয়ের কাছে অনুরোধের পর অনুরোধ করতে থাকি, যে অন্ততপক্ষে আপনি যে চিঠিগুলো পেয়েছেন অন্তত তার প্রাপ্তি স্বীকারটুকু করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দফতর পুরোপুরি নীরব। রেজিস্ট্রার মহোদয় আমার বন্ধু স্থানীয় মানুষ, আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকেন, যেতে আসতে দেখা হয়। আমি অন্য সামাজিক কথাবার্তা বলি আমার তথ্য সরবরাহ নিয়ে কথা বলি না। কারণ আমি অনুমান করতে পারি ভাইস চ্যান্সেলর অনুমতি না দিলে তিনি নিজে থেকে কিছুই করতে পারবেন না।

অনেক দিন পার হওয়ার পর আমি তথ্য অধিকার কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেছি যে, আমি কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই তথ্য আমাকে জানাচ্ছে না। আরও কিছু দিন পার হয়ে গেল, তখন হঠাৎ করে তথ্য অধিকার কমিশন থেকে চিঠি এসেছে যে, আমার অভিযোগের কারণে একটা শুনানি হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে ডাকা হয়েছে, আমাকেও ডাকা হয়েছে! রীতিমতো হই চই ব্যাপার!

পুরো ব্যাপারটা দেখার জন্য আমার শুনানিতে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমি এত ব্যস্ত থাকি তার মাঝে সময় বের করা কঠিন। আমি অনুরোধ করলাম আমার অনুপস্থিতিতেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে। তাছাড়া রেজিস্ট্রার মহোদয় আমার আপন মানুষ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জবাবদিহি চাওয়া হচ্ছে সেটা মোটেও ভালো দেখায় না, বিশেষ করে আমি যখন জানি আসলে তার কিছু করার নেই। ভাইস চ্যান্সেলরের অনুমতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক টুকরো কাগজও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় না। শেষ পর্যন্ত শুনানি হয়েছিল, সেখানে কী হয়েছে আমি জানি না। এতদিনে আগের ভাইস চ্যান্সেলর বিদায় নিয়েছেন। নতুন ভাইস চ্যান্সেলর এসেছেন। কাজেই হঠাৎ একদিন রেজিস্ট্রার মহোদয় নিজে এসে আমাকে আমার জানতে চাওয়া তথ্যগুলো দিয়ে গেলেন। কয়দিন পরে একটা বিল এলো, কাগজপত্রগুলো ফটোকপি করতে চার টাকা খরচ হয়েছে। তথ্য অধিকার আইনে এই খরচটুকু আমাকে দিতে হবে। আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে চার টাকার একটি চেক লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিলাম।

এই হচ্ছে তথ্য অধিকার আইন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা। যখন আমি চিঠি চালাচালি করছিলাম তখন আমি অনেক কিছু জানতাম না। তথ্য জানার নিয়মকানুনগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট। এখন চাইলে আমি আরও গুছিয়ে করতে পারব। আমি যেটুকু জানি সেটি সবাইকে জানাতে চাই। আমার ধারণা শুধু তথ্য জেনে কিংবা জানতে চেয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার এরকম সুযোগটি আমাদের সবার ব্যবহার করা দরকার।

৩. তথ্য জানতে চাওয়ার সুনির্দিষ্ট ফরম আছে। ফরমটি এরকম। কারও কাছে যদি ফরমটি না থাকে সাদা কাগজেও এই তথ্যগুলো জানিয়ে আবেদন করা যায়।

তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী তথ্য প্রাপ্তির আবেদনপত্রের ফরমের নমুনা

বরাবর

....................................

.................................... (নাম ও পদবি)

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা,

....................  (দফতরের নাম ও ঠিকানা)

১। আবেদনকারীর নাম            :................

    পিতার নাম             :................

    মাতার নাম             :................

    বর্তমান ঠিকানা               :................

    স্থায়ী ঠিকানা                 :................

ফ্যাক্স, ই-মেইল, টেলিফোন ও মোবাইল ফোন নম্বর (যদি থাকে)

২। কী ধরনের তথ্য (প্রয়োজনে অতিরিক্ত কাগজ ব্যবহার করুন) :.............

৩। কোন পদ্ধতিতে তথ্য পাইতে আগ্রহী (ছাপানো/ফটোকপি :...........

লিখিত/ই-মেইল/ফ্যাক্স/সিডি অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি)

৪। তথ্য গ্রহণকারীর নাম ও ঠিকানা          :................

৫। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সহায়তাকারীর নাম ও ঠিকানা :................

আবেদনের তারিখ :................  

আবেদনকারীর স্বাক্ষর

এই আবেদন করার ২০ থেকে ৩০ দিনের ভিতর তথ্য পেয়ে যাওয়ার কথা। যদি পাওয়া না যায় তাহলে পরবর্তী ৩০ দিনের ভিতরে নিচের ফরম ব্যবহার করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আপিল করতে হবে। আবেদন করার পনের দিনের ভিতর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তথ্য সরবরাহ করার কথা।

আপিল আবেদনপত্রের ফরমের নমুনা

বরাবর

....................................

.................................... (নাম ও পদবি)

আপিল কর্তৃপক্ষ,

.......................... (দফতরের নাম ও ঠিকানা)

১। আপিলকারীর নাম ও ঠিকানা       :................

(যোগাযোগের সহজ মাধ্যমসহ)     

২। আপিলের তারিখ              :................

৩। যে আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে    :................

উহার কপি (যদি থাকে)

৪। যাহার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হইয়াছে :................   

তাহার নামসহ আদেশের বিবরণ (যদি থাকে)

৫। আপিলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ         :................

৬। আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হইবার কারণ (সংক্ষিপ্ত বিবরণ) :................

৭। প্রার্থিত প্রতিকারের যুক্তি/ভিত্তি           :................

৮। আপিলকারী কর্তৃক প্রত্যয়ন        :................

৯। অন্য কোনো তথ্য যাহা আপিল কর্তৃপক্ষের সম্মুখে     :................

উপস্থাপনের জন্য আপিলকারী ইচ্ছা পোষণ করেন

আবেদনের তারিখ :................

আবেদনকারীর স্বাক্ষর

যদি আপিল করার পরও কাজ না হয় তাহলে ৩০ দিনের ভিতরে নিচের ফরম ব্যবহার করে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করতে হবে।

অভিযোগ দায়েরের ফরমের নমুনা

বরাবর

প্রধান তথ্য কমিশনার

তথ্য কমিশন

এফ-৪/এ, আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকা

শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭।

অভিযোগ নং   ......................................             

১. অভিযোগকারীর নাম ও ঠিকানা      :................

(যোগাযোগের সহজ মাধ্যমসমূহ)

২. অভিযোগ দাখিলের তারিখ        :................

৩. যাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হইয়াছে       :................   

তাহার নাম ও ঠিকানা

৪. অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ        :................

(প্রয়োজনে আলাদা কাগজ সন্নিবেশ করা যাইবে)

৫. সংক্ষুব্ধতার কারণ (যদি কোনো আদেশের বিরুদ্ধে         :................

অভিযোগ আনয়ন করা হয় সেই ক্ষেত্রে উহার

কপি সংযুক্ত করিতে হইবে)

৬. প্রার্থিত প্রতিকার ও উহার যৌক্তিকতা       :................

৭. অভিযোগে উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থনে প্রয়োজনীয়    :................   

কাগজপত্রের বর্ণনা (কপি সংযুক্ত করিতে হইবে)

আবেদনের তারিখ :..................................

সত্যপাঠ

আমি/আমরা এই মর্মে হলফপূর্বক ঘোষণা করিতেছি যে, এই অভিযোগের বর্ণিত অভিযোগসমূহ আমার জ্ঞান ও বিশ্বাস মতে সত্য।

(সত্যপাঠকারীর স্বাক্ষর)

তথ্য কমিশন তখন দুই পক্ষকে ডেকে শুনানি করে ৪৫ থেকে ৭৫ দিনের ভিতর অভিযোগ নিষ্পত্তি করে দেবে। আমি যতদূর জানি কমিশনের শুনানি পর্যন্ত যেতে হয় না, এর আগেই তথ্য পেয়ে যাওয়া যায়। আবার মনে করিয়ে দিই, আমাদের অধিকার শুধু তথ্যটি জানার, ‘কেন’ তথ্যটি এরকম সেটি কিন্তু আমরা জানতে পারব না!

৪. সামনের বছর তথ্য অধিকার আইনের ১০ বছর পূর্ণ হবে। ১০ বছরে এটি যেভাবে ব্যবহার করার কথা এখনো সেভাবে ব্যবহার শুরু হয়নি। আগে সরকারের কাছে তথ্য দাবি করতে অনেকেই ভয় পেতেন এখন তারা জানতে শুরু করেছেন এটি তাদের অধিকার, জানতে চাওয়ার মাঝে কোনো ভয় নেই। যারা তথ্য দেবেন তারাও উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করতে শুরু করেছেন। যারা তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করেছেন তাদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলে আমি খুব মজা পেয়েছি, কারণ আসল তথ্য প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার ভয়ে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দ্রুত সমস্যা মিটিয়ে ফেলেছে এরকম উদাহরণ আছে।

তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে কী ধরনের তথ্য জানতে চাওয়া যায় তার কিছু উদাহরণ দিই, তাহলেই এই অসাধারণ আইনটির ক্ষমতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।

(ক) অমুক শিক্ষক স্কুলে আসেন না, বিগত তিন মাস এরকম কতজন শিক্ষক বেআইনিভাবে অনুপস্থিত ছিলেন তার তালিকা এবং তাদের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে দেখতে চাই!

(খ) অমুক প্রতিষ্ঠানের মহিলা শ্রমিক পুরুষ শ্রমিক থেকে কম মজুরি পান, এ ব্যাপারে সরকারি নীতিমালা দেখতে চাই।

(গ) অমুক এনজিও যারা ঋণের কিস্তি সময়মতো শোধ করতে পারেনি তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাই।

(ঘ) গত অর্থবছরে কোন কোন সংসদ সদস্য বিদেশ সফরের জন্য সরকারের কোষাগার থেকে কত টাকা নিয়েছেন জানতে চাই।

(ঙ) অমুক ব্যাংকের গত পাঁচ বছরের ঋণখেলাপির তালিকা পেতে চাই।

(চ) অমুখ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির জন্য কতজনকে সাসপেন্ড বা বরখাস্ত করা হয়েছে তার বিবরণ পেতে চাই।

(ছ) ট্রাফিক পুলিশ কোনো কোনো গাড়িকে নিয়মের বাইরে রাস্তায় মোড় নিতে দেয়, এ ব্যাপারে কোনো নিয়ম আছে কিনা তা জানতে চাই।

(জ) বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিবন্ধীদের কয়টি হোম আছে তার তালিকা জানতে চাই।

(ঝ) মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়ার জন্য কীভাবে আবেদন করতে হয়  জানতে চাই।

(ঞ) আমাদের অঞ্চলে কৃষকদের যে বীজ দেওয়া হয়েছে তার সরকারি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার রিপোর্টের কপি পেতে চাই।

এখানে শুধু অল্প কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া হলো, এরকম অসংখ্য উদাহরণ থাকা সম্ভব। কেউ যেন মনে না করে এটি সরকারি অফিসগুলোকে হয়রানি করার জন্য দেওয়া হয়েছে। মোটেও তা নয়। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘দেশের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ।’

আমরাই যদি ক্ষমতার মালিক হয়ে থাকি তাহলে সরকারি কাজ কীভাবে চলছে সেটা জানার অধিকার আমার আছে। সে জন্যই একটা আইনও আছে। কাজেই আমরা যদি আইনটি ঠিকভাবে ব্যবহার করি তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ হবে সবার জন্য।  এর আগে আমরা কী আমাদের হাতে এত বড় একটা ক্ষমতা কখনো পেয়েছিলাম?  যদি পেয়ে না থাকি তাহলে দেশকে ঠিক করে চালানোর জন্য কেন এটি ব্যবহার করছি না?

(এই লেখাটি লেখার জন্য আমি রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ-এর প্রকাশিত পুস্তিকার সাহায্য নিয়েছি)।

 

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর