রবিবার, ২৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

এ দেশের কৃষকের হৃদয় ফুটবলের মাঠ

শাইখ সিরাজ

এ দেশের কৃষকের হৃদয় ফুটবলের মাঠ

এবার ঈদ-আনন্দের সঙ্গে রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপের টানটান উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার। গ্রাম বাংলার মানুষের বুকের ভিতর ফুটবলের জন্য গভীর টান রয়েছে। সাধারণ এই ক্রীড়ামোদীদের কাছে ফুটবল শুধু খেলা নয়, জীবন-মৃত্যুর মতো আবেগ যেন জড়িয়ে আছে তাতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে খেলা ও দল সমর্থন নিয়ে পক্ষ-প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্ব, উত্তেজনাঘন স্ট্যাটাস-ট্রল। শহরই নয় শুধু, গ্রাম-গঞ্জের বাড়িগুলোর ছাদ ভরে গেছে ফুটবল সমর্থকদের ওড়ানো নানান দেশের রংবেরঙের পতাকায়। কার পতাকা বেশি বড় সে নিয়েও রীতিমতো প্রতিযোগিতা। তবে এবার বিদেশি পতাকার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের দেশের পতাকাটাও ওড়াচ্ছেন সবার ওপরে। এই পরিবর্তনটাকে স্বাগত জানাচ্ছি। রেডিও, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, অনলাইন মিডিয়া— সবাই বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে আছে। এসব প্রমাণ করে ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশিদের এক রকমের পাগলামি আছে। অন্যান্য মিডিয়ার মতো চ্যানেল আই টেলিভিশন, রেডিও ভূমি এবং চ্যানেল আই অনলাইনের কর্মীরাও বিশ্বকাপের সমস্ত খবরাখবর ফুটবলমোদীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত। গণমাধ্যমগুলোও ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ দেওয়ার জন্য নতুন সব প্রযুক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খেলাকে বিভিন্ন লেন্সে ফেলে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় চলছে নিরীক্ষণ। সারা পৃথিবীই এখন বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত। এসব দেখে আমাদের ফুটবলের সোনালি দিনের কথা মনে পড়ে। আমি নিশ্চিত আমার সঙ্গে আপনারাও একমত হবেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি অবধি আমাদের দেশীয় ফুটবল ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। আমি এখনো বিশ্বাস করি একদিন আমাদের ফুটবল ঘুরে দাঁড়াবে, আবারও ফুটবলের সোনালি দিন আসবে।

১৫ জুলাই, ২০১৮ পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বকাপ অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে আমরা যেন ফুটবল বিশ্বকাপের দিকে চোখ রেখে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভুলে না যাই। ইতিমধ্যে মৌলভীবাজার, সিলেট অঞ্চলে বন্যা মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। ভেঙে যাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব লিভারপুলের ব্যবস্থাপক বিল সানকি একদা বলেছিলেন, ‘ফুটবল নিয়ে কিছু মানুষের বিশ্বাস, এটি হচ্ছে জন্ম ও মৃত্যুর মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’ আমি এ কথার সঙ্গে একমত এর জনপ্রিয়তা ও আবেগের দিক থেকে, কিন্তু গুরুত্বের দিক বিবেচনা করলে আমার এর সঙ্গে ভীষণভাবে মতানৈক্য রয়েছে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়েই আমি মনে করি জীবন এর চেয়ে বহুগুণ গুরুত্বপূর্ণ।

কাজের প্রয়োজনে সারা দেশেই আমাকে ঘুরতে হয়। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশের গ্রামীণ মানুষের সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে কৃষকের সঙ্গে। আমি আগেই বলেছি, ফুটবল বিশ্বকাপের এ উত্তেজনা শুধু শহরেই নয়, গ্রামের প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় উত্তাপ ছড়িয়েছে। কিন্তু আমরা গণমাধ্যমগুলোয় শুধু শহরবাসী মানুষের উত্তেজনার তাপটুকুই পাই। এটা শুধু যে বিশ্বকাপ ফুটবলের ক্ষেত্রেই ঘটছে তা নয়। টেলিভিশনে কাজ করার শুরু থেকেই আমি এটা দেখে এসেছি। আমার টেলিভিশনে অনুষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্য খুব সাধারণ। আমি চেয়েছি গ্রামীণ মানুষ, বিশেষ করে যারা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের গণমাধ্যমের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করতে। প্রতি বছর ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ আয়োজনের উদ্দেশ্যও একই। টেলিভিশনে ঈদ আনন্দ মানেই শহরের মানুষের গল্প, তাদের ঈদ উদ্যাপন। তারকাদের অংশগ্রহণ। কিন্তু বাংলাদেশের প্রকৃত তারকা কৃষক, যারা শ্রমে ঘামে তৈরি করে দিচ্ছে শহরের মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা, তারা অবহেলিত থেকেছে। নাটক, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র, তারকামেলা, নাচ-গানের নানা অনুষ্ঠানের ভিড়ে ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ কতটুকু স্থান পেয়েছে তা দর্শক বলতে পারবেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৪ সালে ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ শুরুর আগে আমি কৃষকের বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিলাম সিরাজগঞ্জের যমুনার চরে। আর্জেন্টিনার সমর্থক কৃষকদের নিয়ে প্রতীকী আর্জেন্টিনা দল আর ব্রাজিল সমর্থকদের নিয়ে প্রতীকী ব্রাজিল দল। ঠিক বিশ্বকাপের আদলে ফুটবল দুনিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের নিয়ে এই আনন্দ আয়োজন। দুই দলে নয়জন করে খেলোয়াড়। দুই দলেই ছিলেন কোচ, টিম ম্যানেজার। ছিলেন প্রফেশনাল রেফারিও। সবাই মাঠে হাজির হয়েছেন অবিকল বিশ্বকাপের পোশাকে। রাতে ফ্লাডলাইটের আলোয় খেলা চলে। মাঠের পাশের টং থেকে ধারাভাষ্য দিয়েছেন ভাষ্যকার চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফত। বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের প্রায় সবকিছুই স্থান পেয়েছিল ওই মহাযজ্ঞে। ওই খেলার থিম ছিল ‘বিষমুক্ত খাদ্যের বাংলাদেশ’। প্রায় ১০ হাজার দর্শক সারা মাঠ ঘিরে রেখেছে। যেন চরের বুকে বিশাল এক স্টেডিয়াম। আর্জেন্টিনা সমর্থকরা আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে নেমেছিল। তাদের কেউ কেউ মেসি, হিগুইন, আগুয়েরো হয়ে খেলেছিল। অন্যদিকে ব্রাজিল সমর্থকরা নেমেছিল ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দিয়ে। নেইমার, মার্সেলো, থিয়াগো হয়ে তারা লড়েছিল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। খেলার সে কি টানটান উত্তেজনা! কিন্তু সমস্যা বেধেছিল মধ্যবিরতির পর। রাতের খেলার জন্য প্রয়োজন ছিল অনেক আলো। উচ্চক্ষমতার ফ্লাডলাইট জ্বালানোর জন্য ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম উচ্চ শক্তিসম্পন্ন জেনারেটর। হঠাৎ জেনারেটর গেল বন্ধ হয়ে। যান্ত্রিক গোলযোগে অচল জেনারেটর। ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া মেকানিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জেনারেটর ঠিক করতে। চরের চারপাশে ঘন অন্ধকার। আমার হাতে মাইক্রোফোন। সমাগত দর্শকদের অনুরোধ জানালাম, ‘সুধী, আমি জানি আপনাদের সবার হাতেই মোবাইল ফোন আছে। অনুগ্রহ করে মোবাইল ফোনটির আলো জ্বেলে মাঠের দিকে ধরুন।’ উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক. ২০১৪-এর বাংলাদেশে গ্রামীণ মানুষের সক্ষমতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় কতটুকু তা দেখা। দুই. তাত্ক্ষণিক আলো জ্বেলে জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দর্শকদের উত্তেজনা প্রশমন করা। যেই কথা সেই কাজ। হাজারো ফোনের আলো যখন সিরাজগঞ্জের চর মালসাপাড়ায় পড়ল তখন মনে হলো, সত্যি! এ এক অন্য বাংলাদেশ!

ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া মেকানিক শত চেষ্টা চালিয়েও জেনারেটর চালু করতে পারলেন না। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমাদের গাড়িগুলোর হেডলাইট জ্বালিয়ে খেলা শেষ করার চেষ্টা করলাম। তখন এক কৃষক বলল, সে একটু চেষ্টা করতে চায় জেনারেটর চালু করার বিষয়ে। তার নিজের স্যালো মেশিন আছে। সেটা সে নিজেই মেরামত করে। ঢাকা থেকে নেওয়া অভিজ্ঞ মেকানিক যেখানে ব্যর্থ সেখানে এই কৃষক সত্যি সত্যি জেনারেটর চালু করে দিয়েছিল। যার কারণে ম্যাচটি শেষ করা গিয়েছিল। ২০১১ সালে ময়মনসিংহের চরে আয়োজন করেছিলাম কৃষকের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সেও এক দারুণ মজার অভিজ্ঞতা। এবারও আশা আছে কৃষকদের নিয়ে একটা জমকালো কৃষকের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করার।

বাংলাদেশের কৃষক তথ্যের দিক দিয়ে আর পিছিয়ে নেই। তার মুঠোর ভিতর এখন পৃথিবী। কোথায় কী ঘটছে সব খবরই রাখছে সে। বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক কিছুই জানে। মেসি, নেইমার, রোনালদো, সালাহ কে কোন দেশের খেলোয়াড়, কোন ক্লবে খেলছে সব তথ্যই তার জানা। একবার ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’-এ দুটি দলের একটির নাম দিয়েছিলাম নেইমার আর একটির নাম মেসি। দেখলাম বিদেশি খটোমটো নামগুলোও কৃষক বেশ মনে রেখেছে, যেন খুব পরিচিত সেসব নাম তাদের কাছে।

বিশ্বকাপ ফুটবল সারা পৃথিবীকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে। দিয়ে যাবে নতুনভাবে জীবনকে যাপনের অনুপ্রেরণা। আমাদের প্রান্তিক কৃষক সারা বছর মাঠে কাজ করে। এক এক মৌসুমে চাষ করতে হয় মৌসুমি ফসল, এক ফসল তোলে, করে আর এক ফসলের চাষ। এসব আনন্দ আয়োজন সর্বদা ব্যস্ত কৃষককেও দেয় বাঁচার অনুপ্রেরণা, নতুন উদ্যম। বাংলাদেশের কৃষক সব আয়োজনের অংশ হিসেবে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখুক। গড়ে তুলুক আনন্দঘন সমৃদ্ধ জীবন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর