রবিবার, ২৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সমস্যা যখন একাকিত্ব

তপন কুমার ঘোষ

সমস্যা যখন একাকিত্ব

স্বামী প্রয়াত। সন্তানরা থাকে অন্য গোলার্ধে। ছেলেটা পড়াশোনা করতে বিদেশে গিয়ে ওখানেই থিতু হয়েছে। বিয়ের পর মেয়েটা স্বামীর সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে বিদেশে অবস্থান করছে। ওখানে আবার কী একটা কোর্সে ভর্তিও হয়েছে। ওরা সবাই ব্যস্ত। ব্যস্ততার মাঝেও মেয়েটা প্রতিদিনই টেলিফোনে মায়ের খোঁজ নেয়। ছেলেটা মাঝেমধ্যে। পুত্রবধূ একদমই সময় পায় না। সারা দিন ছেলেমেয়ের চিন্তায় সময় কাটে ষাটোর্ধ্ব নন্দিতা চক্রবর্তীর। স্বামী চলে যাওয়ার পর বড় একা হয়ে পড়েছেন। ইদানীং শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। হঠাৎ যদি কিছু ঘটে যায়? সারাক্ষণ এ আশঙ্কা মাথায় ঘুরপাক খায়। বিপদাপদ হলে কাজের মেয়ে বা প্রতিবেশীই একমাত্র ভরসা। কিন্তু পরিবারের সদস্যরাই যেখানে কেউ কারও খবর রাখে না সেখানে প্রতিবেশীরা কে কার খবর নেয়! সন্তানরা মানুষ হয়েছে, নিরাপদে আছে, এটাই মায়ের সান্ত্বনা। মেয়েটা বৃদ্ধাশ্রমের কথা বলে। কিন্তু মায়ের মন সায় দেয় না। না, নন্দিতা চক্রবর্তী নামে কাউকে আমি চিনি না। এটি কাল্পনিক নাম। তবে এটা কোনো কল্পকাহিনী নয়। দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এ সময়ের অন্যতম বড় সমস্যা হলো একাকিত্ব। জীবনের গোধূলিবেলায় একাকিত্বকে সঙ্গী করে দিন কাটাচ্ছেন বহু দম্পতি। কেউ একদম একা। শিশুরাও একাকিত্বে ভুগছে। একাকিত্বের শিকার তরুণ প্রজন্মও।

আধুনিক জীবনের বাস্তবতা হলো নিঃসঙ্গতা। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। যুক্তরাজ্যে একাকিত্ব এমনই এক গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে যে, সরকার এ-সংক্রান্ত একটি মন্ত্রণালয়ই সৃষ্টি করেছে। চীনে নারীর তুলনায় বেড়ে গেছে পুরুষের সংখ্যা। পুরুষের একাকিত্ব ঘোচাতে নারীর আদলে ‘স্মার্ট’ পুতুল তৈরি করছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক নারী চিকিৎসক বিয়ে না করেই এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী নিজের হাসপাতালের স্পার্ম ব্যাংক থেকে শুক্রাণু নিয়ে প্রবেশ করানো হয় তার শরীরে। একাকিত্ব ঘোচাতে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান ৩৯ বছর বয়সী ওই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। একসময় যৌথ পরিবারে তিন প্রজন্ম একসঙ্গে বসবাস করতেন। পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। বার্ধক্যের একাকিত্ব ছিল বিরল ঘটনা। কিন্তু নগরায়ণের ফলে যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। পড়াশোনা অথবা ভাগ্যের সন্ধানে পরিবার ছেড়ে অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন শহরে বা অন্য দেশে। বিচ্ছিন্নতা সেই থেকে শুরু।

বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা দুঃসহ। কাজকর্ম নেই। ব্যস্ততা নেই। নেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। শরীরের ফিটনেস কমছে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। অনেক আগেই ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। উচ্চ রক্তচাপ এ বয়সে স্বাভাবিক। কোমর বা হাঁটুর ব্যথা ভোগাচ্ছে। সন্তানরা বড় হয়ে যার যার মতো আলাদা জগৎ গড়ে তুলেছে। কেউ দেশে, কেউ বিদেশে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। পরিবারে গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে। মনের কথা শোনার কেউ নেই। ডাকলেও কেউ কাছে আসে না। সামাজিক সম্পর্কের সমীকরণ কিছুতেই মিলছে না। বড্ড একা লাগে। চেনা পৃথিবীটা হয়ে যায় অচেনা। এ পরিবর্তন অনেকের পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বার্ধক্যের একাকিত্ব দূর করতে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করুন যাদের কাছে মনের কথাগুলো খুলে বলতে পারেন। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালো বন্ধু হতে পারেন আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষ। কেবল পত্রপত্রিকা পড়ে বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে বা ফেসবুক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় কাটালে একাকিত্ব দূর হবে না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসুন। প্রকৃতির নির্জনতা উপভোগ করুন। সমুদ্রের কাছে যান। সমুদ্রের বিশালতায় মন ভরে যাবে। আশপাশের মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করুন। এতে সম্পর্কের উন্নতি হবে। একসময় উপলব্ধি করবেন, পৃথিবীতে আপনি একা নন। যে কাজটি করতে ভালো লাগে তাই করুন। গান শুনুন। বাগানের পরিচর্যা করুন। প্রার্থনা করুন। মন পবিত্র হবে। সেবামূলক বা সৃজনশীল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করুন। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ত্যাগ করুন। শরীরটাকে ফিট রাখতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও হালকা ব্যায়াম করার পরামর্শ চিকিৎসকদের। কিন্তু মন চাইলেও শরীর যে সব সময় সায় দেয় না, এ কথাও ঠিক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একাকিত্বের কারণে শিশুদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটছে। অস্বাভাবিক আচরণ করছে শিশুরা। আমাদের সমাজে শিশুবান্ধব পরিবেশ অনুপস্থিত। শিশুদের মাথার ওপর খোলা আকাশ নেই, খেলার মাঠ নেই। ঠাকুরমার ঝুলি নেই। সূর্যিমামা, চাঁদমামা নেই। কাজলাদিদি নেই। সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ নেই। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী জীবন। দিনের অনেকটা সময় বাবা-মায়ের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত।

তরুণ প্রজন্মের একাকিত্ববোধের বড় কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি। এতে সময় কাটে। কিন্তু একাকিত্ব ঘোচে না। দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতে ইন্টারনেট-আসক্তি কমিয়ে বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। বার্ধক্য জীবনেরই অংশ; যা অনিবার্য তা সহজভাবে মেনে নিতে হয়। কিন্তু সবাই এটা পারেন না। দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বয়স্করা একটু জেদি এবং অভিমানী হন। একাকিত্বের যন্ত্রণা ও অবহেলা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। স্বীকার করতে হয়, বয়স্কদের ব্যাপারে আমাদের সংবেদনশীলতার অভাব আছে। তাদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা আমরা করি না। উল্টো পরিবারের বোঝা মনে করি। বয়স্ক মানুষদের দেখভাল করার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে আমরা প্রায়শ বিচ্যুত হই। এ বিচ্যুতি অমানবিক, ক্ষমার অযোগ্য। সবার জীবনেই বার্ধক্য আসে— এ সত্য আমরা যেন বিস্মৃত না হই।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর