শিরোনাম
সোমবার, ২ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

বীর-এ-তদবির

হানিফ সংকেত

বীর-এ-তদবির

২০০২ সালের গোড়ার দিকে যানবাহনের পেছনে লেখা বিভিন্ন স্লোগানের ওপর সামাজিক প্রভাব নিয়ে আমরা ইত্যাদিতে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। কারণ তখন রাস্তায় যেসব বাস, মিনিবাস, ট্রাক, বেবিট্যাক্সি কিংবা খুদে যান ‘মিশুক’ দেখা যেত সেগুলোর পেছনে কিছু কথা লেখা থাকত। এর কিছু ছিল কৌতুককর, কিছু ভয়ঙ্কর, কিছু অবান্তর এবং কিছু ছিল অরুচিকর। সেখানে কয়েকটি লেখা ছিল এরকম— ‘এই দুষ্টু কাছে এসো না’, ‘বহুদূর যানা হে মে’, ‘সাবধান-যদি লাইগ্যা যায়’, ‘আমাকে ছুঁয়ো না’, ‘ছিঃ ছিঃ তুমি এত কাছে’, ‘আমি ছোট, আমাকে মারবেন না’, ‘রোড কিং’, ‘লাগলে খবর আছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে ‘লাগলে খবর আছে’ জাতীয় লেখাগুলো রীতিমতো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল এবং ভীতিপ্রদ। যেহেতু যানবাহন দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়, তাই এ ধরনের অবান্তর ও অরুচিকর কথার প্রসার না ঘটিয়ে আমরা ইত্যাদির মাধ্যমে কিছু শিক্ষামূলক লেখার প্রসার ঘটানোর উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, সড়ক পরিবহন সমিতি, বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন চালক সমিতি আমাদের সহযোগিতা করেন। সে সময় আমরা যে স্লোগানগুলো দিয়েছিলাম তার কয়েকটি ছিল, ‘শিক্ষাই শক্তি-শিক্ষায় মুক্তি’, ‘সন্ত্রাসী কারও আপন নয়-ঘৃণ্য তাদের পরিচয়’, ‘আপনার শিশুকে স্কুলে দিন’, ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন’, ‘অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিন’, ‘গাছ লাগান-দেশ বাঁচান’, ‘ঘুষ দেবেন না-ঘুষ নেবেন না’ ইত্যাদি ইত্যাদি। উপরোক্ত সংগঠনগুলো তাদের পুরনো স্লোগানগুলো পরিবর্তন করে ইত্যাদির দেওয়া স্লোগানগুলো তাদের যানবাহনের গায়ে লেখেন এবং ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত যানবাহনে এই স্লোগানগুলো লিখে দেবেন বলে কথা দেন। বলা বাহুল্য, তারা তাদের কথা রেখেছেন। ইত্যাদির দর্শক যারা ওই অনুষ্ঠানটি দেখেছেন তারা অবশ্যই বাস-ট্রাকের গায়ে লেখার এই দৃশ্যমান পরিবর্তনটি অনুধাবন করতে পারছেন। স্লোগান বদলের ধারাবাহিকতায় ইদানীং কিছু কিছু যানবাহনের গায়ে কিছু নতুন ও অর্থবহ স্লোগানও দেখা যায়।

কদিন আগে একটি ট্রাকের পেছনে তেমনি একটি স্লোগান দেখে আমি বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছি। আমার আজকের লেখার সূত্রপাত সেখান থেকেই। স্লোগানটি ছিল—‘মানুষ সাজা সহজ কিন্তু মানুষ হওয়া কঠিন’-আসলেই কথাটি ঠিক। সে জন্যই বলে, পৃথিবীতে দুটি জিনিস দুষ্প্রাপ্য-এক, মনের মতো মানুষ এবং দুই, মানুষের মন। সে জন্যই আমরা প্রায়শই ইত্যাদিতে এবং আমার কলামেও লিখি—‘আসলে মানুষ যদি মানুষ হয়, তবে সে ভালো মানুষই হয়, নইলে তো সে মানুষ হতো না-হতো অমানুষ।’ আমাদের দেশে নানান চরিত্রের মানুষ আছে কিন্তু বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না কে কেমন, কোন চরিত্রের। লেখায় এবং বলায়, ছলায়-কলায় পারদর্শী লোক আমাদের চারদিকেই আছে। এদের নানা মত, নানা পথ। কেউ কেউ আবার এমন ভাব ধরে থাকেন, দেখলে মনে হয় তিনি শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট। এই লেজেরও আবার প্রকার ভেদ আছে। আমাদের দেশে অনেকের সঙ্গেই লেজ যুক্ত আছে। এসব লেজে নানান পদবি, নানান বিশেষণ, নানান টাইটেল। এসব লেজের বিশেষ ক্ষমতা আছে। কোনো কোনো লেজ না বুঝে ধরলে বিপদ- পদে পদে। লেজের আকার-প্রকারও ভিন্ন ভিন্ন। এ নিয়ে একটি লেখা পড়েছিলাম, যেখানে বিভিন্ন প্রাণীর লেজ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রথমেই মাছের লেজ-কারণ কুকুর, বানর, শিয়াল, গরু, ছাগল এগুলোর লেজ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, সমস্যাও নেই। পাখি বা টিকটিকির লেজ নিয়েও কোনো ঝামেলা নেই। কারণ এদের শরীরের কোন অংশটুকু লেজ সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না। কিন্তু মাছের লেজ শরীরের কোন অংশ থেকে শুরু তা বোঝা মুশকিল। তবে যেসব মাছের পেটি হয় (অর্থাৎ রুই, ইলিশ ইত্যাদি) তাদের পেটির পর থেকে লেজ। আর শিং, মাগুর জাতীয় পেটিহীন মাছের শরীরের পেছন দিকের অর্থাৎ লেজের দিকের এক-পঞ্চমাংশ লেজ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সাপ নিয়ে। সাপের তো পেটি, গাদা কিছুই নেই। তার লেজের দৈর্ঘ্য কীভাবে মাপা যাবে? অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা, গবেষণা করেও লেখক এর উত্তর খুঁজে পাননি। এই লেজ কাহিনী বর্ণনা করার একটি কারণ আছে। আমাদের দেশে কিছু কিছু সর্পলেজ বিশিষ্ট মানুষ আছে, যাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে লেজের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করা সাপের মতোই কঠিন। এদের লেজে পাড়া পড়লেই সাপের মতো ফুঁসে ওঠেন। কারণ এদের নানা দিকের শক্তি আছে। আমাদের দেশে আজকাল তরুণ-তরুণীরা আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি শব্দ করে থাকে ‘ওয়াও’। এই ওয়াও এবং মিঁয়াও এর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য না থাকলেও একটি বিড়ালের স্বভাবগত ডাক আর অন্যটি স্বভাবের অভাবগত অনুকারীদের হাঁক। স্বভাবের অভাবে এই হাঁকাহাঁকি পাকাপাকিভাবে অনেক অবান্তর দৃশ্যের অবতারণাও করতে পারে। কারণ নানা চরিত্রের লোক আছে আমাদের সমাজে। যাদের চেনা মুশকিল। তবে এ ব্যাপারে ইত্যাদির নাতি একটি চমৎকার কথা বলেছে—‘আমাদের দেশে ডগ স্কোয়াডের কুকুরগুলো দেখে তার এক অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এসেছে, আর তা হলো ডগ স্কোয়াডের বিশেষ কুকুরগুলো তো কখনো মাদক গ্রহণ করেনি, ইয়াবা, গাঁজা, মদ বা অন্য কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেনি কিংবা তারা কখনো সোনার জিনিসও ব্যবহার করেনি। তথাপিও এই কুকুরগুলো ঠিকই খুঁজে খুঁজে ওইসব অবৈধ জিনিস বের করে ফেলে।’

নানী তখন বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘ওইসব কুত্তা ঘ্রাণ শুঁইকাই কইয়া দিতে পারে, কোনটা কী জিনিস।’ নাতি তখন বলে ওঠে, ‘আমার কথাও ওইখানে। অবৈধ জিনিসের মতো ওই কুত্তাগুলো যদি শুঁইকা শুঁইকা কইয়া দিতে পারত কার চরিত্র কেমন, কে অসৎ, কে ভণ্ড, কে দুর্নীতিবাজ, কে চোরাচালানি, কে ভেজালকারী, কে ব্যাংকের টাকা মারছে, কে বিদেশে টাকা পাচার করছে- তাইলেই তো দেশটা ১০০% খাঁটি হইয়া যাইতো। আর অনেক ডিপার্টমেন্টের কাজও তখন কইমা যাইতো। এত মামলা-মোকদ্দমার দরকার হইতো না। সে জন্য বিভিন্ন অফিস-আদালতে ডেইলি এই জাতীয় ২-৪টা কুত্তা ছাইড়া দেওয়া উচিত, তাইলে দেখতা অচল ফাইলগুলো কেমনে সচল হইতাছে।’ নাতির উক্তিতে যুক্তি আছে।

কে খারাপ, কে ভালো তা গায়ে লেখা থাকে না। এদের মধ্যে ভালো মানুষের মুখোশ আঁটা মুশোখধারীরা ভাবেন তাদের কেউ চিনবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের আচরণের ধরনই স্মরণ করিয়ে দেয় তিনি কে এবং কেমন? এদের মধ্যে কেউ দুর্নীতিবাজ, কেউ চাঁদাবাজ, কেউ চালবাজ, কেউ আবার তদবিরবাজ। আমাদের দেশে পানি বিশেষজ্ঞ, খাদ্য বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞের মতো তদবিরেরও বিশেষজ্ঞ রয়েছে। কারণ এটিও এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কখনো কখনো তদবিরের ওপর নির্ভর করে আপনার জীবনের উত্থান-পতন, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানসহ নানান সামাজিক মর্যাদা। অর্থাৎ সংক্ষেপে আপনার পদ-পদবি-পদক, এই তিনটি বিষয়ের জন্য তদবির অপরিহার্য। আপনি একজন ভণ্ড সমাজকর্মী হতে পারেন, একজন ভণ্ড বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, নকল লেখক হতে পারেন, বিতর্কিত ব্যক্তি হতে পারেন। কিন্তু তদবির গুণে আপনি হতে পারেন পুরস্কৃত-সম্মানিত। আপনার চেয়ে অনেক যোগ্য মানুষ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা প্রচার পায় না-প্রচার চায়ও না। যাদের সম্পর্কে কিছু বলতে হলে এদের খুঁজে নিতে হবে কষ্ট করে-যেটা আমরা ইত্যাদির মাধ্যমে করতে চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন করে কেউ খুঁজে এনে তাদের পুরস্কৃত করেনি। প্রতিভাগুণে এবং আমাদের প্রচার কল্যাণে তাদের মধ্যে কয়েকজন রাষ্ট্রীয় সম্মানও পেয়েছেন। অথচ তাদের চেয়েও অনেক অযোগ্য ও বিতর্কিত প্রচার কাঙাল মানুষ তাদের প্রচার চাতুর্যতা এবং তদবির গুণে অযোগ্য হয়েও পুরস্কৃত হয়েছেন এবং পরবর্তীতে সেই পুরস্কার বিতর্কিতও হয়েছে। এ প্রসঙ্গ পরে-তার আগে একটু তদবির প্রসঙ্গে আসি। একটি কথা অনেকেই বলেন, তদবির ছাড়া তকদির মেলে না। এই তদবির কী? কেন? কার কাছে? কার জন্য? কারা করে? কেন করে? প্রথমত, তদবির এবং তকদির দুটোই আরবি শব্দ। তদবিরের নানান অর্থ রয়েছে। উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলম্বন, উপায়, কার্যলাভের সুপারিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর তকদির অর্থ ভাগ্য। তদবির অনেক পুরনো সংস্কৃতি হলেও আমাদের দেশে এর প্রচলন এখন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। যখন নিয়মবহির্ভূত কিছু করতে হয় কিংবা বলা হয়, যখন অনিয়মই নিয়মিত নিয়ম হয়ে যায়, তখন অনেকেই ছোটেন এই অনিয়মের পেছনে। আর সেই অনিয়মের একটি অন্যতম পন্থা এই তদবির। এই তদবিরে অনেকের তকদির বা ভাগ্য ফেরে। আর এই সুযোগ গ্রহণ করে পদ-পদবি-পদক লাভ করে কিছু অযোগ্য ও বিতর্কিত মানুষ। কিন্তু দুঃখ হয় তখন-যখন দেখা যায় দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননার ক্ষেত্রেও তদবির গুণে অনেকে এসব পদক লাভ করেন। এক সময় বলা হতো-নিজের ওজন বুঝে চলবে, ওজন বুঝে কথা বলবে। কারণ তখন ওজন মানেই ছিল গুরুত্ব। তখন মানুষের সাফল্যের মাপকাঠিই ছিল তার ওজন। আর এখন ওজন বললেই অনেকে শারীরিক ওজন বোঝেন। সবাই চান একটু স্লিম হতে, কারণ অতিরিক্ত দেহভার শরীরের জীবনীশক্তি ও কর্মশক্তি কমিয়ে দেয়। বুঝুন, কোন ওজন কোথায় এসে দাঁড়াল!

এবারে আসা যাক-কারা তদবির করে? কেন করে? কাদের কাছে করে? তদবির যে যেখানে যে কারণেই করুক না কেন তার জন্য প্রয়োজন শক্তি। কী ধরনের শক্তি? ইদানীং অনেক নতুন নুতন শক্তির উদ্ভব হয়েছে। এসব শক্তির মধ্যে ক্যামেরা শক্তি, অর্থ শক্তি, অস্ত্র শক্তি ও স্বজন শক্তি প্রধান। স্বজন শক্তি প্রয়োগ হয় বিশেষত চাকরি প্রাপ্তি-বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। পদ-পদবি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তদবির হয় অর্থ শক্তিতে। আর টেন্ডার বা সরকারি কর্মপ্রাপ্তিতে স্বজন শক্তির পাশাপাশি অস্ত্র শক্তির তদবিরও হয় অন্যদের ঠেকাতে। আর পদক প্রাপ্তিতে প্রাধান্য পায় ক্যামেরা শক্তি। এই তদবিরের প্রভাবে মিডিয়ায় বিচরণকারী বিতর্কিত ব্যক্তিরাও মাঝে মাঝে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়ে যান। যা নিয়ে নাম ঘোষণার আগে এবং নাম ঘোষণার পরেও অনেক বিতর্ক হয় এবং হয়েছে। পুরস্কার হচ্ছে মানুষের সাফল্য বা কর্মস্বীকৃতির জন্য দেওয়া পদক কিংবা সম্মাননা। এখন সম্মান তো দূরের কথা পুরস্কারের মান নিয়েই উঠেছে নানান প্রশ্ন। এই ক্যামেরা শক্তির প্রভাবে গুণবিচারী না হয়েও যারা এই তদবির গুণে এসব পুরস্কার পান দেশবাসী তা জেনে যান। যদিও পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি আনন্দে ডুগডুগি বাজান এবং লোক হাসান।

এ বছর স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটল। কিছু কিছু অনলাইনে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা পুরস্কারের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। শুধু অনলাইনে নয় ফেসবুকে, এমনকি টিভি টকশোতেও এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। টকশোর বিশিষ্টজনদের মন্তব্য থেকেই উঠে এসেছে এসব তদবিরবাজ কতটা বেপরোয়া। তবে যিনি বা যারা যার জন্য তদবির করেন তাদেরও হয়তো মিডিয়ার সমর্থন প্রয়োজন। নইলে অযোগ্য লোকের জন্য তদবির করবেন কেন? আর কিছু লোক আছেন যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এখন তাদের কোনো কাজ নেই, বসে বসে কথা বলা ছাড়া। এরাও ওইসব মিডিয়ার কৃপা লাভের আশায় অযোগ্যকে যোগ্য বলে সনদপত্র প্রদান করেন কাগজে এবং ক্যামেরার সামনে। এ এক বিস্ময়কর ও ক্ষতিকারক তোষামোদ। তাও আবার এই বয়সে, যা অত্যন্ত শ্রুতিকটু এবং দৃষ্টিকটু তো বটেই। প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের ব্যক্তিদের এই জাতীয় প্রতিভাদের(!) জন্য তদবির করার প্রয়োজনটা কী?

শুধু এটাই নয়, এ বছর বিতর্কের মুখে পড়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা নৃত্য পরিচালক হিসেবে যাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তিনি নিজেই বলেছেন নৃত্য পরিচালনা করা তো দূরের কথা এই ছবির কোনো কাজের সঙ্গেই তিনি যুক্ত ছিলেন না। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের গর্ব বাংলা একাডেমির পুরস্কারও ইদানীং বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। অভিযোগ এই পুরস্কারও গুণবিচারী না হয়ে তদবির বিচারী হয়ে উঠেছে। এ নিয়েও পত্রপত্রিকায়, ফেসবুকে অনেক লেখালেখি হয়েছে। গুণী ও সৃজনশীল লেখক পুরস্কৃত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এমন কিছু নবীন ও বিতর্কিত ব্যক্তির নাম দেখা যায় যা বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত নয়। তারপরও কেন এমন হয়? প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি করে প্রশ্নবোধক এসে যায়, তাই এই প্রশ্নবোধকের সংখ্যা আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। শুধু চাই সব কিছু স্বচ্ছ হোক, সততার সঙ্গে হোক অন্তত শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। পুরস্কার নিয়ে আক্ষেপ করে বিশিষ্ট কবি ও সম্পাদক অমিত গোস্বামী লিখেছেন, ‘আমরা যারা লিখি তাদের একটাই মন্ত্র হওয়া উচিত-পদক নয়, পঙিক্তর জয় হোক। কারণ সৃষ্টিই থেকে যায় পদক নয়।’ পুরস্কার নিয়ে এদের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি গল্প মনে পড়ে গেল।

একবার আমেরিকাতে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। প্রতিযোগিতার বিষয়কে সবচেয়ে ভালো চার্লি চ্যাপলিনের অনুকরণ করতে পারে। চার্লিকে প্রধান বিচারক হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি সময়ের অভাবে রাজি হতে পারেননি। তবে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন। যাই হোক, প্রতিযোগিতা শেষ হলো।

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকার করল তিনজন। আয়োজকরা চার্লির, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীদের নাম জানিয়ে তাকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের জন্য বাণী পাঠাতে অনুরোধ জানাল। চার্লি সে অনুরোধ রেখেছিলেন কিন্তু বাণীর শেষে একটা লাইন লিখেছেন—‘আপনাদের অনুষ্ঠানের রিপোর্ট পেয়ে খুশি হলাম কিন্তু দুঃখ একটাই যে আমি প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কারটি পেলাম না, আমিও প্রতিযোগীদের একজন ছিলাম।’ একবার এক রিপোর্টার একজন তদবির বিশেষজ্ঞকে এক বীর-এ-তদবির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, আসন্ন ঈদে এদের ভূমিকা কী? উত্তরে বিশেষজ্ঞ বললেন—ঈদেও তো নানান পুরস্কার আছে, উপহার আছে, লটারি আছে। এখানে এই তদবিরবাজরা হানা দিতে পারে কারণ যে করেই হোক যে কোনো পুরস্কার নেওয়া এদের টার্গেট। সুতরাং বিভিন্ন দোকানের লটারি-আকর্ষণীয় উপহার-প্লেনের টিকিটও এরা পেয়ে যেতে পারেন। এদের বলা হয় পুরস্কার কাঙাল মানুষ। তাই তিরস্কারে এদের কিছু যায়-আসে না। তদবিরের গুণে সেটাও তারা কাটিয়ে উঠতে পারেন। কারণ এদের পক্ষে কথা বলার জন্যও একশ্রেণির সুবিধাবাদী মানুষ আছেন যাদের ভাব থাকলেও বোধের অভাব আছে। যারা এই তদবিরকে অনেকটা শিল্পে(!) পরিণত করেছেন।

পরিশেষে দুজন বড় কবির কথা দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ’। আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আরও সরাসরি বলেছেন, ‘সাহেব কহেন, ‘চমৎকার! সে চমৎকার!’ মোসাহেব বলে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে যে! হুজুরের মতে অমত কার?’।

এই জাতীয় লোকদের কেউ বলেন মোসাহেব, কেউ বলেন চাটুকার, কেউ বলেন তোষামোদকারী, অন্য অর্থে তদবিরবাজ। আর এ তদবির-এ-বীর সারাক্ষণ অস্থির, কোথায় কোন সুযোগ যায়, থাবা দিয়ে ধরতে চায় এটাই তার স্বভাব, কারণ সততার অভাব। প্রচারের প্রাচুর্যতা না থাকলেও যা সত্য তা নিভৃত নিরালাতেও সত্যই থাকে। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না। তার প্রমাণ তো আমরা অনেক পেলাম। কথায় আছে, ‘দশে মিলে করি কাজ-হারি জিতি নাহি লাজ’। কিন্তু কোন কাজ? অন্যকে জিরো বানিয়ে নিজে হিরো হওয়ার কাজ নয়, অন্যের প্রতিভাকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজে বড় হওয়ার কাজ নয়, তদবির করে সম্মান খুঁজে নেওয়ার কাজ নয়-সৎ কাজ, শুভ কাজ। দেশের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, প্রতিটি প্রাণে প্রাণে মানুষ শুভ কাজ, সৎকাজ করতে উদ্যোগী হয়ে উঠুক এই কামনা করছি।

            লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর