শিরোনাম
সোমবার, ৯ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

হলি আর্টিজানের দুই বছরে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

হলি আর্টিজানের দুই বছরে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণের দুই বছর পূর্ণ হলো গত সপ্তাহে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যার পর গুলশানের ওই রেস্টুরেন্টে আহাররত মানুষের ওপর সংঘবদ্ধ জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা ঘটে এবং তাতে ২০ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয়, দুজন বাংলাদেশি এবং একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক।   এ ছাড়া জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে প্রথম ধাক্কায় প্রাণ হারান দুজন নিবেদিত পুলিশ অফিসার। জঙ্গি দমনে বিশ্বের যে কোনো স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একেবারে কম ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে ১১ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে। আক্রমণের টার্গেট নির্ধারণ এবং পরবর্তীতে জঙ্গিদের কথপোকথন থেকে এটা স্পষ্ট ওই দিনের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল বিদেশি নাগরিক, যারা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এতে বোঝা যায়, এই আক্রমণের অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল বিদেশি নাগরিকদের মনে ভীতির সৃষ্টি করা যাতে তারা নিজ নিজ দেশে ফিরে যায় এবং বাংলাদেশকে পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো বড় বড় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সঙ্গত কারণেই হলি আর্টিজানের ঘটনায় বাংলাদেশে তো বটেই, সমগ্র বিশ্বে একটা তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তার অজুহাতে নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে শুরু করে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি একটা চক্র, যারা সেই ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে তারাও উঠেপড়ে লেগে যায় এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য। এই চক্র বিদেশ থেকে দুয়েকজন তথাকথিত নিরাপত্তা বিশ্লেষককে ভাড়া করে এনে পাঁচ তারকা হোটেলে থাকাসহ খানাপিনা ও আনন্দ ফুর্তির সুযোগ দিয়ে তাদের মুখ থেকে বলিয়ে নেন বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি আছে এবং তার জন্য সরকারের উচিত হবে বিদেশি সাহায্য নেওয়া। এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, দেশি-বিদেশি ওই চক্র যেন জোর করে হলেও বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করবে বাংলাদেশে আইএস আছে। এটা যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কত বড় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র ছিল তা একটু তলিয়ে দেখলে যে কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রই আঁতকে উঠবেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই চক্রান্ত ধরা পড়ে যায় এবং চক্রান্তকারীরা হালে পানি পায় না। নিঃসন্দেহে হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটা বিভীষিকাময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে এবং আগামীতে জঙ্গি পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণে অনেক শিক্ষণীয় দিকনির্দেশনা এখান থেকে পাওয়া যাবে। তাই আজকে এই বিভীষিকাময় ঘটনার দুই বছরের মাথায় এসে আমাদের দেখার বিষয় জঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা কোথা থেকে এখন কোথায় এসে দাঁড়ালাম। এখন আমরা কেমন আছি এবং ভবিষ্যতের জন্য করণীয় কী। প্রথমত, হলি আর্টিজান ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবং তার দেড়-দুই বছর আগ থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি আক্রমণে একের পর এক নিরীহ মানুষের প্রাণ হারানোর ফলে দেশের অভ্যন্তরে ভীত-সন্ত্রস্ত ও নিরাপত্তাহীনতার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু হলি আর্টিজানের পর গত দুই বছরে বাংলাদেশ ওই পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। শুধু ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এখন রোল মডেলের দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। হলি আর্টিজানের পর দুই বছর যাবৎ জঙ্গিরা একের পর এক বড় আকারে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে, বড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে, যার সবই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ করে দিয়েছে  এবং জঙ্গিদের নিহত, আহত ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। অপারেশনে নিহত হয়েছে ২৮ জন, গ্রেফতার হয়েছে ৭০০-এর অধিক। হলি আর্টিজানের প্রধান আসামি সারওয়ার জাহান, ইব্রাহিমসহ জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রক্ষাকারী নব্য জেএমবির নেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডা নাগরিক তামিম চৌধুরী নিহত হয়েছেন।

বলা যায়, এতদিনে জঙ্গিদের কোমর ভেঙে গেছে। আর কোনো হলি আর্টিজান তারা ঘটাতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ আবার একটা স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে। ওই ঘটনার পর যেসব বিদেশি ফিরে গিয়েছিলেন তারা সবাই আবার ফিরে এসে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছেন। দুরভিসন্ধিকারীদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দরদি মা জঙ্গি সন্তানের লাশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইতিপূর্বে যারা জঙ্গিদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং নানা ছদ্মবেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে তারাও এতদিনে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই বছরে দ্বিতীয় বড় অর্জন হলো, দেশি-বিদেশি যে গোষ্ঠী আইএসের উপস্থিতি প্রমাণ করে বাংলাদেশকে একটা জঙ্গি রাষ্ট্রের তকমা দিতে চেয়েছিল তাদের সব প্রচেষ্টা জলে গেছে। এই চক্রান্তকারীদের দেশি গোষ্ঠী রাজনৈতিক বিদ্বেষবশত খাল কেটে কুমির আনার জন্য বিদেশি প্রভুদের সঙ্গে কোরাস মিলিয়ে ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশমা গুণে এবং দূরদর্শিতার ফলে কেউ সুবিধা করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র জাতি তখন মাঠে নেমেছে। তৃতীয়ত, এ ঘটনাটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ছিল প্রচণ্ড একটা ওয়েকআপ কল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতি যদি তুলনা করি তাহলে বলতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সক্ষমতা, বিশেষ করে জঙ্গি দমনের সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হয়েছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সংযোগ এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়েছে। এত বড় অগ্রগতি ও অর্জনের পরও বলতে হবে আমরা এখনো চিন্তামুক্ত নই এবং বড় বড় চ্যালেঞ্জিং আমাদের সামনে রয়েছে। যেমন—  এক. গ্রেফতার জঙ্গিদের বিচার প্রক্রিয়ায় ভয়ানক দুর্বলতা রয়েছে। শত শত জঙ্গি জামিন নিয়ে বাইরে যাচ্ছে এবং পুনরায় জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হচ্ছে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকছে, বিচার সম্পন্ন হচ্ছে না। তদন্ত এবং প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কথা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় আসে। বিচার প্রক্রিয়ার জায়গাটি সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো দরকার। দুই. জেলখানার ভিতরে জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার যে চিত্র পত্রিকায় আসছে তাকে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক বলা যায়। শোনা যায় জঙ্গিরা অবাধে নিজেদের মধ্যে মেলামেশা করছে এবং সলাপরামর্শের মাধ্যমে বাইরে থাকা জঙ্গিদের মোবাইল ফোনে নতুন নতুন কৌশল বাতলিয়ে দিচ্ছে। জেএমবি প্রধান মাওলানা সাঈদুর রহমান ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রাহমানির একসঙ্গে বসে সলাপরামর্শ করার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এটা কত বড় বিপজ্জনক তা তো সবাই বোঝেন। এমন খবরও পত্রিকায় এসেছে, বাইরে থাকা জঙ্গিরা ছদ্মবেশে জেলখানায় তাদের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে নিয়মিত নির্দেশনা গ্রহণ করছে। তিন. এটা এখন সবাই জানেন জঙ্গিরা একটা মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একেবারে উন্মাদ, অন্ধ ও নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো আত্মহননের পথ বেছে নিতে পিছপা হচ্ছে না। তাদের এই মতাদর্শ যে ভ্রান্ত, ধর্মের নামে অধর্ম এবং ধর্মের চরম মিথ্যাচার তা সঠিক ও গ্রহণযোগ্য যুক্তিসহকারে উন্নতমানের মতাদর্শ তুলে ধরে ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের উদ্যোগ গ্রহণে আমরা অনেক পেছনে আছি। এই জায়গায় সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন। হলি আর্টিজান ঘটনার পর আলেম সমাজের পক্ষ থেকে মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে একটা মহতী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার কার্যক্রম এখন আর চোখে পড়ে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে। পাঁচ লক্ষাধিক মসজিদের ইমাম এবং এক লাখেরও অধিক এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষককে সঠিকভাবে ও পন্থায় কাজে লাগাতে পারলে ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের কার্যক্রমটি অনেক বেশি কার্যকর হতো এবং ইসলামের ভ্রান্ত ব্যাখ্যার কবল থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখা সম্ভব হতো।

চার. জঙ্গি নির্মূলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ধর্মান্ধ উগ্রবাদী রাজনীতি। আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান। এই স্লোগান দেওয়ারা এখনো উন্মুক্ত রাজনীতিতে বহাল এবং বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ। পাঁচ. প্রায় ১২ লাখের মতো অসহায় ও নির্যাতিত রোহিঙ্গার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান ভবিষ্যতে জঙ্গি তৈরি ও বিস্তারের পথকে প্রসারিত করবে। এটা বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত একটা ঝুঁকি সৃষ্টি করে রেখেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সেটি চীনসহ পুরো অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ছয়. বাংলাদেশকে ঘিরে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির যে সমীকরণটি বর্তমানে বিদ্যমান, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো রাষ্ট্র জঙ্গি ইস্যুতে অনেক সময় সর্প হয়ে দংশন আর ওঝা হয়ে ঝাড়ার নীতি অনুসরণ করছে, যা জঙ্গি দমনে অনেক সময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।  তবে উপসংহারে এ কথা বলা যায়, হলি আর্টিজান ঘটনার দুই বছরের মাথায় এসে সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ আজ অনেক নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত। কিন্তু বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো  মোকাবিলায় ব্যর্থ হলে আবার বিপদ আসতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর