বৃহস্পতিবার, ১২ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইমাম আবু হানিফার জীবনদর্শন

মুফতি মাওলানা এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

ইমাম আবু হানিফার জীবনদর্শন

আল্লাহতায়ালা আল কোরআনে বলেন, ‘এই রসুল প্রেরিত হয়েছেন অন্য আরও লোকের জন্য, যারা এখনো তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি।’ (সূরা জুমুয়াহ : ৩)।

সূরা জুমুয়াহর এ আয়াতের তাফসিরে ইমাম বুখারি (রহ.) বুখারির দ্বিতীয় খণ্ডের ৭২৭ পৃষ্ঠায় কিতাবুত তাফসিরে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রসুল (সা.)-এর কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় তাঁর ওপর অবতীর্ণ হলো সূরা জুমুয়াহ, যার একটি আয়াত হলো— ‘এবং তাদের অন্যান্যের জন্যও যারা এখনো তাদের সঙ্গে মিলিত হয়নি।’ তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? তিনবার এ কথা জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। আমাদের মাঝে হজরত সালমান ফারসি (রা.)ও উপস্থিত ছিলেন। রসুলুল্লাহ (সা.) সালমান ফারসি (রা.)-এর ওপর হাত রেখে বললেন, ইমান সুরাইয়া নক্ষত্রের কাছে থাকলেও আমাদের কতক লোক অথবা তাদের এক ব্যক্তি তা অবশ্যই অর্জন করতে সক্ষম। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নম্বর ৪৫৩৩)। মুসলিমেও কিছুটা এই হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দীন আকাশের সুরাইয়া নক্ষত্রের কাছে চলে গেলেও পারস্যবাসীর মধ্যে অথবা তিনি বলেছেন পারসি সন্তানদের মধ্যে এক ব্যক্তি সেখান থেকে তা গ্রহণ করবে। (মুসলিম, হাদিস নম্বর ৬৬৬১)। এই আয়াত ও হাদিসে বলা হয়েছে কোরআন বিশেষজ্ঞ, শ্রেষ্ঠ কালাম শাস্ত্রবিদ, হাফিজুল হাদিস, শ্রেষ্ঠতম মুজতাহিদ, ফকিহ, তাবেয়ি, হানাফি মাজহাবের প্রবর্তক ইমামকুল শিরোমণি ইমাম আবু হানিফা নোমান বিন সাবিত (রহ.) সম্পর্কে। ইমাম ইবনে হাজার হায়তামি তাঁর আল ‘খায়রাতুল হিসান’ কিতাবের একটি অধ্যায়ে লিখেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, এর দ্বারা ইমাম আবু হানিফা উদ্দেশ্য। কেননা, তাঁর সমসাময়িক পারস্যবাসীর মধ্যে কোনো ব্যক্তি তাঁর জ্ঞানের সীমায় এমনকি তাঁর ছাত্রদের জ্ঞানের সীমা পর্যন্ত কেউ পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি। (ইবনে হাজার হায়তামি, পৃ. ২৪)। ইমাম জালালুদ্দিন সুউতি (রহ.) বলেন, এ হাদিস দিয়ে ইমাম আজম আবু হানিফার কথা বোঝানো হয়েছে। (তাবয়িদুস সহিফা, পৃ. ১১)।

আল কোরআন ও হাদিসে যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান যার সূত্র ধরে সুন্নতে নববীর পথে চলছে, আসুন সেই মহান ইমামের জীবনীর ওপর সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি। ইমাম আজম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ বা ৮০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম নুমান ইবনে সাবিত ইবনে জুতি। আবু হানিফা তার ডাকনাম। শৈশবে তিনি পবিত্র কোরআন হেফজ করার মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে ইলমে হাদিস, ইলমে ফিকাহ, শরিয়ত ও তরিকতের বিভিন্ন স্তরে তিনি ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

তিনি বেশ কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) বলেন, ‘ইমাম আবু হানিফা (রহ.) নিঃসন্দেহে তাবিয়ি ছিলেন। তিনি হজরত আনাস ইবনে মালিককে দেখেছেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা.), ওয়াসিলা ইবনে আসকা (রা.), আবুল হারিসা (রা.)সহ বেশ কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ব্যবসার কাজে তাঁকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবি (রহ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবি আবু হানিফার চেহারার মধ্যে প্রতিভা লক্ষ্য করেছিলেন। এ সময় আবু হানিফার বয়স ছিল ১৯ বা ২০ বছর।

অল্প সময়েই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কোরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞান আয়ত্ত করেন। মেধা ও চিন্তার ফলে মানুষের কাছে ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন তিন। তাঁর শিক্ষক হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের ইন্তেকালের পর তিনি ওস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হন। প্রায় ৩০ বছর তিনি ইলম চর্চা করে তার চিন্তাধারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি ৪০ হাজার হাদিস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আসার, আল ফিকহুল আকবার, আবসাত, মুসনাদু ইমাম আজম আবু হানিফাসহ অনেক কিতাব রচনা করেন। জীবনীকাররা লিখেছেন, একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছাড়া আর কোনো তাবিয়ি জীবদ্দশায় এত খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি পাননি।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন ইবাদতগুজার মানুষ। তিনি জীবনভর নফল সালাত ও সিয়ামে মশগুল ছিলেন। তিনি নরম মনের মানুষ ছিলেন। একই সঙ্গে সত্যের ব্যাপারে, দীনের ব্যাপারে ছিলেন কঠোর ও আপসহীন। তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ‘দীনবিরোধী সবকিছু তিনি কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতেন। তিনি ছিলেন খুব পরহেজগার ও আল্লাহভীরু। তিনি জ্ঞান ও সম্পদ মানুষের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। (আখবারু আবু হানিফা : পৃ. ৩১)।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাজহাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো— প্রতিটি বিষয়ই আল কোরআন ও সুন্নাহ সমর্থিত। জীবনে তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ আদায় করেছিলেন।

এই মহান ইমাম ৭০ বছর বয়সে ১৫০ হিজরির শবেবরাতে (রাতে) বাগদাদের কারাগারে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের খাইজুরান করবস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন।

লেখক : খতিব, মণিপুর বাইতুর রওশন জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর