শুক্রবার, ১৩ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ছাত্রলীগ হৃদয় ক্যানভাসে প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি

নূরে আলম সিদ্দিকী

ছাত্রলীগ হৃদয় ক্যানভাসে প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি

শেখ হাসিনা কার্যত সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনায় দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাষ্ট্র ও দল পরিচালনায় তার কথাই শেষ কথা। অথচ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলতেন, দেশ শাসনের প্রশ্নে জনগণই মূল শক্তি। তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথাটি শতভাগ সত্য হলেও বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি আজ সুদূরপরাহত নিষ্ফল বাণী। আজকের প্রান্তিক জনতা ভোটপ্রদানের নিমিত্ত মাত্র। ক্ষেত্রবিশেষে সেটিও তাদের কপালে জোটে না। অনেক সময় ভোটাররা খবর পান, কষ্ট করে হুড়হাঙ্গামার মধ্যে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার এবং ভোটপ্রদানের বিড়ম্বনা বা ধকল সহ্য করার তার প্রয়োজন নেই। অন্য কেউ (!) বোধ করি সরকারি দলের কোনো বলবান তত্পর হিতৈষী তার হয়ে ভোটের সিলটি মেরে দেবেন বা দিয়েছেন। এতে ভোটারের বিড়ম্বনা কমল না হৃদয়ের যন্ত্রণা বাড়ল সেটি বিশ্লেষণের পর্যায়ও ক্রমান্বয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক বিধিমালায় গ্রহণযোগ্য না হলেও প্রান্তিক জনতার কাছে এটা অনেকটা গা-সওয়া পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। তবুও ভোট তো ভোটই। অকার্যকর ও অর্থহীন হলেও ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকার গঠিত হয়। যদিও বিগত নির্বাচনে জাতীয় সংসদে ১৫৩ জনপ্রতিনিধি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন! এ বিরল সৌভাগ্যের অধিকারীরা আজ ততখানি লজ্জিত নন। এর আগের বিভিন্ন নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা, বিশেষ করে ৮৮র নির্বাচনে যে ক’জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা ভগ্নসংকুল হৃদয়ে তটস্থ থাকতেন, কখন না আদালতের রায়ে তাদের সদস্য পদটি খোয়া যায়। সমাজে, বন্ধুমহলে এমনকি আপন পরিবারেও তারা যেন একটুখানি সংকুচিত থাকতেন। অন্তত প্রাণখোলা উচ্ছ্বসিত হৃদয়ে তারা সময় কাটাতে পারতেন না। কেমন যেন একটা জড়তা, দ্বিধাগ্রস্ততা তাদের মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। কার্তিকের ভরদুপুরে মনটা যেমন একটু হলেও নিঃসঙ্গতা অনুভব করে, তেমনই ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে নির্বাচিত হওয়ার কারণে কোথায় যেন একটু সংকোচবোধ তাদের মধ্যে কাজ করত।

১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসনের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিশেষ করে ওয়াপদার কিছু প্রকৌশলী তাদের নিজেদের উদ্যোগে আমাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে চেয়েছিলেন। আমি প্রস্তাবটি গ্রহণ করিনি। কারণ, আমি সুনিশ্চিত ছিলাম, প্রচণ্ডভাবে বলপ্রয়োগ না করলেও এটা স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বসম্মত কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না। কিছু কলকাঠি নাড়া লাগত বিধায় বিষয়টি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য তো নয়ই, নিতান্তই অগণতান্ত্রিক, অমর্যাদাকর ও ষড়যন্ত্রমূলক মনে হয়েছে। কুটিল এমনকি প্রতিপক্ষের কাউকে কাউকে উেকাচ প্রদানেরও পরিকল্পনা ছিল। আমি আমার প্রকৌশলী বন্ধুদের অত্যন্ত রূঢ়ভাবে এ পথে হাঁটতে নিষেধ করেছিলাম। এখানে উল্লেখ্য, মুজিব ভাই একটি পরিস্থিতির শিকার হয়ে হঠাৎ করেই আমার ওপর মনোনয়নটি চাপিয়ে দেন। ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নিয়ে সর্বান্তকরণে যুবলীগ সংগঠিত করার জন্য সবে আত্মনিয়োগ করেছি। মণি ভাই ও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সার্বক্ষণিকভাবে যুবলীগ করার জন্য এবং সংসদ নির্বাচন না করাই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে যুবলীগের বর্ধিত সভা চলছিল। তুমুল ও তুখোড় আলোচনার ঝড় বইছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। ওখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাক পেয়ে পুরানা পল্টনে গিয়ে নির্বাচন করার আদেশ পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ফেরত এসে মণি ভাইকে বিষয়টি বিস্তারিত জানালাম। মনে প্রচণ্ড ভয় ছিল, মণি ভাইয়ের কড়া বকুনি খাওয়ার। কিন্তু বিস্ময়াভিভূত হয়ে লক্ষ্য করলাম, মণি ভাই রেগে তো গেলেনই না (মণি ভাই খুব রগচটা লোক ছিলেন) বরং ধীরস্থির কণ্ঠে আমাকে বললেন, মামাকে ক্ষেপিয়ে কোনো লাভ নেই, তোকে তো বটেই, আমাকেও প্রচণ্ডভাবে ভুল বুঝবেন। বরং আমাকে একটা চৌকস বুদ্ধি দিলেন— মামা তোর প্রতি প্রচণ্ডভাবে দুর্বল। এ সুযোগে মাখনসহ যতগুলো সম্ভব যুবলীগের নেতা-কর্মীদের মনোনয়ন চেয়ে নে। তাতে সংসদেও আমাদের একটা অবস্থান তৈরি হবে। আমি বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম, কোনো ক্লেদ নেই, ক্রোধ নেই; হাস্যোজ্জ্বল প্রভাতের সূর্যরশ্মির মতো নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ তার মুখমণ্ডল। আমি নির্ভয়ে তাকে বলেছিলাম, সেক্ষেত্রে আপনিও নির্বাচন করুন। তিনি অবিচলভাবে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তার যুক্তিও ছিল কঠিন। একই সঙ্গে সাংবাদিকতা, নব্য সংগঠন যুবলীগ সংগঠিত করা এবং সংসদের কার্যে অংশ নেওয়া আমার জন্য দুরূহ ও দুঃসাধ্য হবে। তিনি বললেন, একটু দাঁড়া, আমি যুবলীগ নেতৃত্বের কিছু নামের একটা তালিকা তোকে দিয়ে দিচ্ছি। আবদুল কুদ্দুস মাখন, ঢাকা হলের শফিউল্লাহ, নারায়ণগঞ্জের মোবারকসহ আট/নয়টি নামের তালিকা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। এরমধ্যে চার/পাঁচজনের মনোনয়ন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলাম। যুবলীগের সদস্যদের সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন লাভের এই দর কষাকষিতে মণি ভাই আমাকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, মাখনের মনোনয়নটি নিতে অজ্ঞাত কারণে খুবই বেগ পেতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মণি ভাইকে এ নিয়ে ভীষণ জেদ ধরতে হয়েছিল। যখন আমি অনেকটা নিরাশ হওয়ার উপক্রম, তখন মণি ভাই সুকৌশলে মনোনয়নটি আদায় করতে পেরেছিলেন। মণি ভাই আমার শত পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও ৭৩-এর নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হননি। আমার ধারণা, তার স্বপ্ন ছিল মানিক ভাই হওয়া। নেতৃত্বের সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি মুজিব ভাইয়ের জনপ্রিয়তার কাছাকাছি আসতে পারবেন না, এটা বোধহয় তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল। তার পরিচিতিটাই ছিল শেখ মুজিবের ভাগ্নে। তাই শেখ মুজিব হওয়ার চাইতে মানিক মিয়ার কাছাকাছি যাওয়ার সাধনা করাটাই তার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিল।

আমার ভাগ্যটাই এমন, সবসময় স্রোতের বিপরীতে আমাকে কেন জানি না, রাজনীতি করতে হয়েছে। আমি ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার সময়কালে ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতৃ-চতুষ্টয় কেন জানি না, আদাজল খেয়ে আমার সভাপতি হওয়ার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। এমনিতে দেখলে মনে হতো আমার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসায় তারা গদগদ। অথচ বিরোধিতা করার সময় ন্যূনতম সহানুভূতিবোধও তাদের থাকত না। তবুও আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো সসম্মানে উতরে যেতাম বিস্ময়করভাবে। এই তো সেদিনের কথা; ছাত্রলীগে সংগঠনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নিয়ে বিপ্লবীদের ঠেকিয়ে সভা পরিচালনা করাই আমার জন্য একটা দুঃসাধ্য বিষয় ছিল। তবুও তখনকার রাজনীতিতে সহনশীলতা ও পরস্পরের মতকে সম্মান দেখানোর একটা সংস্কৃতি চালু ছিল। আমার সঙ্গে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিপ্লবী অংশের অগ্রজ নেতৃত্ব কাজী আরেফের বন্ধুত্বের গভীরতা এবং রব, শাজাহান সিরাজ, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, মণি (জাসদপন্থিরা তাকে মার্শাল মণি বলতেন), এমনকি বিপ্লবীদের গুরুতর তাত্ত্বিক মরহুম আ ফ ম মাহবুব, একরাম ও রেজাউল হক মোস্তাকের সঙ্গে আমার একটা আন্তরিক সুসম্পর্ক ছিল। কৌতুক করে কিনা জানি না, বিতর্ক যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে যেত, এমনকি দল যখন বিভক্তির অতি সন্নিকটে এসে দাঁড়াত, তখন অনেকটা দৈবক্রমে তারা আওয়াজ তুলতেন, ‘প্রেসিডেন্ট রাইট অর রঙ’। অর্থাৎ যথেষ্ট রগড়ানো হয়েছে, এখন তাকে ছাড় দিয়ে দাও। ক্লান্ত-শ্রান্ত, ভগ্ন, তিক্ত হৃদয়ে আমি তখন একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচতাম। কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ও বর্ধিত সভা পরিচালনা করতে গিয়ে এতটাই যন্ত্রণাক্লিষ্ট অভিজ্ঞতা হতো যে, মাঝে মাঝে পদত্যাগেরও ইচ্ছা তৈরি হতো। আত্মসম্মান ও সংগঠনের বিভক্তি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কার্যত আমি পদত্যাগ করিনি। পল্টন থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলায় ও থানায় সংগঠনের যে কোনো প্রকাশ্য জনসভায় তারা যেভাবে আমাকে সম্মান প্রদর্শন করতেন, আমাকে অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করতেন তাতে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা, সব ক্লান্তি ও অবসন্নতা দূর হয়ে আমি যেন একটা নতুন প্রাণের সন্ধান খুঁজে পেতাম। সে এক অভূতপূর্ব ও অবর্ণনীয় আনন্দের উৎসারিত স্বাদ। এভাবেই আমার ছাত্রলীগের সভাপতির জীবন কেটেছে।

বঙ্গবন্ধু আমাকে বুক উজাড় করে ভালোবাসলেও আমার এসব কষ্টের উৎসও তিনিই। কারণ, সম্মেলনের রাতে আমার হাতে ওই কমিটি ধরিয়ে না দিলে, বাধ্য হয়ে ঢেঁকি গেলার মতো গ্রহণ করতে বাধ্য না করলে ছাত্রলীগ পরিচালনার এ দুঃসহ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আমার পেতে হতো না। তবুও ছাত্রলীগই আমার আত্মার সবটুকু জুড়ে আছে। ছাত্রলীগই আমার স্বপ্ন, জীবনের সবচেয়ে স্বপ্নীল মুহূর্তগুলো ছাত্রলীগই আমাকে উপহার দিয়েছে। ৭০-এর নির্বাচনে ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংঘটিত করার জন্য ছাত্রলীগই স্বর্ণের সিংহদ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করেছে। লাখ লাখ জনতার উত্তাল তরঙ্গমালায় আমাকে ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে উঠতে শিখিয়েছে। আমি বুকভরা বেদনার বহিঃপ্রকাশ করতে পেরেছি, কেঁদেছি, লাখ লাখ মানুষকে কাঁদিয়েছি, আমার চেতনার উচ্ছ্বসিত স্রোতধারায় সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার মতো প্রান্তিক জনতাকে তরঙ্গায়িত করেছি, ভাসিয়ে নিয়ে গেছি। সেই আনন্দ, সেই প্রাপ্তি, সেই সফলতা পৃথিবীর অন্য কোনো পদ-পদবিই আমাকে এনে দিতে পারত না— সারা বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার হৃদয়ের সন্নিকটে আমাকে নিতে পারত না। মানুষের কাছে সেদিন আবির মাখানো ভালোবাসার যে রং রূপ ও স্বাদ আমি অনুভব করেছি— সেটি আজকের প্রজন্মের কাছে স্বপ্নেরও অতীত।

রাজনীতিতে আমার অনেক সহকর্মী রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, অনেক অনুজপ্রতিম আজকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রচণ্ড শক্তিধর ব্যক্তিত্ব। তবুও আমার হৃদয়ভরা প্রশান্তি— আমি যা পেয়েছি তা অনেককিছুর চেয়ে বেশি গৌরবোজ্জ্বল ও প্রশান্তির। এবং হৃদয়ের প্রাপ্তি-প্রত্যাশাকে কানায় কানায় ভরিয়ে রাখার। আমি শতভাগ নিশ্চিত, এটা আমার আত্ম-সান্ত্বনা নয়। ইতিহাসও একদিন বিপুল গৌরবে এ কথাটি প্রতিস্থাপিত করবে।

অতি বিপ্লবীরা বিপ্লব চূড়ান্ত করার মানসিকতা নিয়ে বিপ্লবের সফলতা আনতে চেয়ে সরকার পতনের অভিলাষে ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও করে এবং রক্ষীবাহিনীর গুলিতে রমনা পার্কে কয়েকজন জাসদকর্মী নিহত হয়। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে তার বক্ষে দাড়ি ঘষছিলেন এবং মুজিব ভাইকে আশ্বস্ত করছিলেন, এটা জলিল-রবের হটকারিতা। আপনি এদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেবেন, আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইয়ের পিঠে হাত বুলাচ্ছিলেন। আমি দৃশ্যটি দেখে স্তম্ভিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা হলো, দুজনের কেউই আমাকে দেখতে পাননি। 

ছাত্রলীগ আমার প্রাণের স্পন্দন, রক্তের অনুরণন, হৃদয়ের ধড়কানি। জীবনসায়াহ্নে তো বটেই মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত প্রচণ্ড সফলতার স্বস্তি ছাত্রলীগ আজও আমাকে দান করে। না পাওয়ার কোনো বেদনাই আমার চেতনাকে স্পর্শ করতে পারে না। বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় ছাত্রলীগ আমাকে অংশীদারিত্বের যে গৌরব দিয়েছে, আমার অনুভূতির বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ের চেয়েও তা অনেক অনেক বেশি পরিতৃপ্তির। অনেকে ভাবতে পারেন, রাজনীতিতে আজ আমি নিষ্ক্রিয় কেন? আজকের রাজনীতিতে যে অপসংস্কৃতির বিস্তার, তার বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও আমি বলতে পারি, আমি আজকে সক্রিয় রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে হলেও সার্বিক সত্তায় আমি রাজনীতিক। সবরকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব। নিষ্প্রভ তো নই-ই, একটা আশ্চর্যজনক দ্যুতি আমার হৃদয়কে আজও উদ্ভাসিত করে রেখেছে। কোনো অতৃপ্তির বেদনা আমার হৃদয়ের ক্যানভাসে নেই। 

এখনকার রাজনীতিকদের মতো ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশা কখনোই আমার হৃদয়কে প্রভাবিত করেনি। সত্য ও সুন্দরের সাধনায়ই আমার হৃদয় এক স্বাপ্নিক জগতে বিচরণ করত। আমার চিত্ত, মননশীলতা, অনুভূতি, অভিব্যক্তি— সবকিছুই মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার পবিত্র আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত থাকত। হৃদয়ের সেই তৃষ্ণা আল্লাহ মিটিয়েছেনও প্রচণ্ডভাবে। প্রান্তিক জনতার ভালোবাসার উত্তাল তরঙ্গমালায় কী প্রচণ্ডভাবেই না আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছি বারবার। পদ-পদবির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকিনি বলেই, গণতন্ত্রের প্রতি বিন্দুমাত্র আঘাত আসলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অকুতোভয়ে রুখে দাঁড়ানোর যে অজেয় মানসিকতা— এটিই আমার সম্পদ, এটিই আমার শক্তি। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রকৃতি ভিন্ন। কেউ পদ-পদবি পেয়ে তুষ্ট থাকে। তার জন্য প্রয়োজনে নিজেরই বিবেকের টুঁটি চেপে ধরে, গতানুগতিকতার স্রোতধারায় গা ভাসিয়ে দেয় নির্বিঘ্নে। আবার কেউ কেউ সত্যের সাগরে অবগাহন করে, স্বতঃসিদ্ধ মানসিকতায় অকুতোভয়ে যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়ায়। তাতে কী যে হারাল, তার পরোয়া করে না। জীবনের স্বাভাবিক অঙ্কে মনে হবে এরা হয় নির্বোধ, নয়তো প্রাপ্তি-প্রত্যাশার হিসাব বোঝে না। সত্যিই তো তাই। নইলে বাকশালের বিরোধিতা করে খ্যাতির আকাশ থেকে বিচ্যুত নক্ষত্রের মতো নিষ্প্রভ হয়ে যেতে হবে কেন আমাকে? বাকশালের এ বিরোধিতাই তো আমাকে রাজনীতির মূল ধারা থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার আজও বিশ্বাস, আমার প্রাণের মুজিব ভাই ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে চলে না গেলে হয়তো আমার পরবর্তী জীবনের স্বরলিপি অন্যভাবে লেখা হতে পারত। অন্তত মণি ভাই বেঁচে থাকলেও নিঃসঙ্গতার এ যন্ত্রণা আমাকে বয়ে বেড়াতে হতো না। ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানোর অভিযোগ যারা আমার ওপর আনেন, তারা হৃদয়ের যন্ত্রণা তো বোঝেনই না, কৈশোর থেকে রাজনীতির পথপরিক্রমণের এক অভিযাত্রীক রাজনীতির পথচলা থেকে নিবৃত্ত হতে বাধ্য হলে তার হৃদয়ের যে অব্যক্ত যন্ত্রণা— ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য ও বৈভব কোনোকিছুই তা মেটাতে পারে না। রাজনীতিতে সত্য ও সুন্দরের সাধক একজন রাজনৈতিক কর্মীর রাজনৈতিক পথচলাতেই আনন্দ। 

আজকাল সংবাদমাধ্যমে ছাত্রলীগের কিছু কর্মকাণ্ডের সংবাদ আমার হৃদয়ের অনুভূতিকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। আমাদের সময়ের সঙ্গে এটাকে একেবারেই মেলাতে পারি না বলেই কখনো কখনো হৃদয়টা ক্ষোভে-দুঃখে ক্ষতবিক্ষত হয়। আজকের ছাত্ররাজনীতিটাই যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট; ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তিতে নিয়োজিত। তবুও জীবনসায়াহ্নে আশার প্রদীপটি এ বিশ্বাস নিয়ে প্রজ্ব্বলিত রেখেছি, বাঙালি জাতির সত্যিকার বিপদে ছাত্রলীগই একদিন বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠবে। ছাত্রলীগের অতীত ঐতিহ্যই আমাকে এ নিশ্চিত আশ্বাস প্রদান করে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর