সোমবার, ১৬ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার সেই কারাবরণ

অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন

শেখ হাসিনার সেই কারাবরণ

২০০৭ সালের ১৬ জুলাই মিথ্যা মামলায় অযৌক্তিকভাবে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন— এরকম একটি আশঙ্কা দেশবাসী আগে থেকেই করেছিল। অবশেষে আশঙ্কাটি সত্যে পরিণত হলো। ১৬ জুলাই ২০০৭, সোমবার, ভোর ৬টায় শ্রাবণের প্রবল বর্ষণের মধ্যে সুধাসদনে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। সকাল ৭টা ৩২ মিনিটে যৌথবাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সুধাসদন থেকে। সুধাসদনের চতুর্দিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রাখে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। দেশে কি সামরিক শাসন জারি হয়েছে। তেমন কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা। বরং যুদ্ধংদেহী মনোভাবে সাজসাজ রব তুলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়ির বহর হাজির হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে আদালত বসার ঘণ্টা দুয়েক বাকি থাকতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জামিন নামঞ্জুর করে সংসদ ভবনের সাব-জেলে প্রেরণ করে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মতো একজন মর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেতৃত্বকে গ্রেফতার থেকে জেলহাজতে প্রেরণ করা পর্যন্ত পুরো ঘটনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথবাহিনী কোনো সংযমের পরিচয় দেয়নি। সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য রাখেন। সে সময় একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলাম অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। গ্রেফতারের পূর্ব-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে যান। দেশ ও জাতির সংকট মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওই চিঠিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে। উজ্জীবিত হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সমসাময়িককালের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ হাসিনার চিঠিটি একটি অমূল্য দলিল। চিঠিতে শেখ হাসিনা দেশবাসীর প্রতি তার আস্থার কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন। তেমনি গণতন্ত্রের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীদের করণীয় কি তাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। পাঠকদের স্মরণে আনার জন্য চিঠিটি হুবহু উল্লেখ করছি।

প্রিয় দেশবাসী,

আমার ছালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারাজীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোনো অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের উপর আমার ভরসা। আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কাছে আবেদন কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যাহাই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবোই।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু

শেখ হাসিনা

১৬.০৭.২০০৭

এই চিঠির ভাষাই প্রমাণ করে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ গ্রেফতারের আগে যেমনিভাবে চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেছেন, শেখ হাসিনাও তেমনিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরিত নেতৃত্বই পারে সাহসের সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে, সেই সত্য আবারও নতুন করে প্রমাণিত হলো। প্রায় চার দশকের দেশের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় বরাবরই সফল হয়েছেন। পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দী থাকাকালে এদেশের মুক্তিকামী বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, লড়াই করে বিজয় অর্জন করেছে। শেখ হাসিনা ৩৩১ দিন কারাবাসের সময়গুলোতেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তেমনি তার নির্দেশনা অনুযায়ী গণতন্ত্র মুক্তির সংগ্রামে জনমতকে সংগঠিত করেছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, সত্যের জয় হবেই। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এমনকি তার জীবন বিপন্ন করারও অপচেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার সাহসী ভূমিকা ও জনমতের কাছে গণতন্ত্রবিরোধী সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। প্রায় এক বছর কারাবাসের পরে জনতার মাঝে ফিরে আসেন জনগণের নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত সাড়ে নয় বছর বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে। মাথাপিছু আয় এক হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা এখন স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

যে প্রসঙ্গটি দিয়ে আমার লেখার ইতি টানতে চাই, তাহলো বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্যের পাশাপাশি মজ্জাগত কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। আমরা গোল্ডফিশের মতো অনেক কিছুই ভুলে যাই বা ভুলে যেতে ভালোবাসি। গড্ডলিকা প্রবাহে মূল পথটি হারিয়ে ফেলি। যা ’৭১ পরেও ঘটেছে, ’৭৫ পরেও ঘটেছে।  শত্রুকে মিত্রজ্ঞান করি আবার মিত্রকে শত্রুজ্ঞান করি। এ জন্য আমাদের মূল্য দিতে হয়েছে। আমরা যেন ভুলে না যাই আমাদের সেই দুঃসহ অতীতকে। গৌরবের পতাকা হাতে এগিয়ে যেতে চাই।  দৃষ্টি রাখতে হবে, স্মৃতিভ্রমে শত্রুপক্ষ যেন আমাদের পথ আগলে না দাঁড়ায়।

লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর