বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

শুরু হোক নতুন ভাবনা

আমিনুল ইসলাম

শুরু হোক নতুন ভাবনা

নতুন ঘরে প্রবেশ করেছে দেশের প্রাচীনতম ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে যে শিশুর জন্ম, ৭০ বছরের পথপরিক্রমায় অন্তত আটটি অস্থায়ী ঘরে শৈশব, কৈশোর, যৌবন কাটিয়ে সে শিশু যখন বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে তখনই তার ঠাঁই হলো নিজ ঘরে। এ যেন বাঙালির শাশ্বত জীবনের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির জীবনে শৈশব-কৈশোর কাটে কষ্টেসৃষ্টে, যৌবন কাটে জীবন সংগ্রামে, কিঞ্চিৎ সুখ ধরা দেয় বার্ধক্যে— আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে। তবে মানুষ এবং সংগঠনের মধ্যে পার্থক্য হলো, মানুষের একসময়ে মৃত্যু ঘটে, কিন্তু পরিকল্পনা, পরিচর্যা ও সময়োপযোগী গঠনমূলক কর্মসূচি দিতে পারলে সংগঠনের মৃত্যু হয় না। আওয়ামী লীগ এর নজির।  নতুন ভবনে আওয়ামী পরিবার নতুন উদ্যমে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যস্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। জনগণও এটি কামনা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো সরকার বাস্তবায়ন করে। দল ও সরকার সমান্তরাল সমীকরণে কাজ করলে রাষ্ট্র উপকৃত হয়। এর ব্যত্যয় রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই এর ঘাটতি দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, সরকারি সম্পত্তি দখল ও নৈরাজ্য সৃষ্টিতে সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনসমূহের একশ্রেণির নেতা-কর্মীর সীমাহীন সংশ্লিষ্টতা কেবল সরকারের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন করে না, জনমনে তা আতঙ্ক, ভীতি, বিতৃষ্ণা এবং সব শেষে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয়; যা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। রাজনৈতিক দলের ভিত্তিই হচ্ছে জনসমর্থন, কোনো সুরম্য অট্টালিকার ইট-পাথরে তা গ্রোথিত নয়। তাই নতুন ভবনে আমরা পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি এক উন্নত ও গতিশীল আওয়ামী লীগকে দেখতে চাই। দলীয় পরিচয়ে এটি যেন কোনো দুর্বৃত্তের বিলাসী আস্তানা হয়ে না ওঠে। দলীয় শৃঙ্খলা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দলের সৎ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান আওয়ামী লীগ মারাত্মকভাবে ব্যর্থ বললে অত্যুক্তি হবে না। নব্য আওয়ামী লীগারদের দাপটে সারা দেশেই ত্যাগী কর্মীরা কোণঠাসা। হাইব্রিড-কাউয়া আমার কথা নয়, দলের সাধারণ সম্পাদকের কথা। যদিও এরপর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণভবনের সবুজ চত্বরে আয়োজিত সভায় দলীয় সভাপতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেছেন, এত উন্নয়নের পরও যদি জনগণ ভোট না দেয় তাহলে বুঝতে হবে সেটা দলীয় নেতা-কর্মীদের ব্যর্থতা, তারা জনগণের কাছে যায়নি, তাদের কাছে সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে পারেনি, জনগণকে বোঝাতে পারেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ কথাটি আগামী নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন, কোন নেতা-কর্মী জনগণের কাছে যাবে? যারা চাঁদাবাজি-দখলদারিত্ব-সন্ত্রাস-নিপীড়ন করেছে তারা আবার জনগণের কাছে ভোট চাইতে যাবে? জনগণও তাদের কথায় ভোট দেবে? অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় আগামী দিনের নির্বাচন অনেক কঠিন হবে। ভোটাররা সচেতন। তাদের প্রায় সবার হাতে মোবাইল ফোন, অনেকের ঘরে টিভি আছে, তারা দেশের খবরাখবর রাখে, নিত্য খবর শোনে। তারা এখন স্বাবলম্বী। অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। কারও কথায় উঠবোস করার দিন শেষ। শেখ হাসিনা তাদের শিখিয়েছেন আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। শেখ হাসিনার এ অভয় বাণী তাদের শক্তি। ইচ্ছা করলেই কেউ তা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন নির্বাচিত হওয়ার দিনও নেই। ভোটারদের কাছে যেতে হবে। বিনয়ের সঙ্গে বলতে হবে গত ১০ বছরে উন্নয়ন দিয়েছি, আগামী ১০ বছরে সুখ, শান্তি ও নিরাপত্তা দেব। সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-দখলদারি আর হবে না— এ নিশ্চয়তা ভোটাররা পেলে নৌকার পালে দক্ষিণা হাওয়া আপনিতেই লাগবে। দলীয় সভাপতি ঠিকই মাঠের চিত্র অনুধাবন করেছেন এবং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এখনো সময় আছে, মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। সে আঙ্গিকে ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের সামনে আনতে হবে। মন্ত্রী, এমপি, জেলা-উপজেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের তল্পিবাহক কর্মীবাহিনী দিয়ে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। জনগণের কাছে সরকারের সাফল্যগাথার পাশাপাশি সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতার চিত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্যের মতো চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস-দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং এসব ক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষ ও কঠোর মনোভাব দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। আজ থেকে প্রায় ৬১ বছর আগে ১৯৫৭ সালের ৩০ মে জাতির জনক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এটি ছিল একটি সাহসী ও ত্যাগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেদিন কেউ কি ভেবেছিল এটিই একদিন ইতিহাসে মোড় বদলকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৯৫৭-৬৬ থেকে একনাগাড়ে নিষ্ঠা, সততা, শ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে দল পরিচালনা করে ’৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে উপস্থাপন করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। আর এ ছয় দফার দাবিতে উল্কার মতো ঘুরে বেড়ান সারা বাংলায়, জেল-জুলুম-হুলিয়া কোনো কিছুই তাঁকে নিবৃত করতে পারেনি। এর পরের কাহিনী আরও বিস্ময়কর। রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর কারাবরণ প্রকারান্তরে তাঁকে বাঙালির মনের কারাগারে ঠাঁই দেয়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির একান্ত আপনজন, বাংলার বন্ধু— বঙ্গবন্ধু। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি, এ ধারাবাহিকতারই চূড়ান্ত বিজয়।

তাই নতুন ভবনে নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে হবে। গতানুগতিকতার দিন শেষ, বাংলাদেশ এখন ডিজিটালাইজড বাংলাদেশ। প্রত্যন্ত গ্রামের কুঁড়েঘরের মিটমিটে বিদ্যুতের আলোয় পল্লী নারী মোবাইলে গান শুনছে, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে কথা বলছে, অনেকে ফেসবুকিংও করছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ জাগরণ বর্তমান সরকারেরই কৃতিত্ব। তাদের এ জাগরণ-সচেতনতা কিন্তু নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে টানতে হলে আরও অনেক কিছুই ভাবনা-চিন্তায় আনতে হবে। আশা করি নতুন ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আওয়ামী নেতৃত্ব সে ভাবনাটুকু ভাববেন।

লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।

ই-মেইল: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর