শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঢোলের শব্দ এবং নাচুনে বুড়ি বৃত্তান্ত!

গোলাম মাওলা রনি

ঢোলের শব্দ এবং নাচুনে বুড়ি বৃত্তান্ত!

ঢোলের শব্দ শুনলে বুড়ির কেন নাচতে ইচ্ছা করে অথবা বুড়িকে দেখলে ঢোলেরই বা কেন বাজতে ইচ্ছা করে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমার জীবনের সাম্প্রতিক কিছু দুঃখের কাহিনী বলে নিই। পৃথিবীর লাখো কোটি পুরুষ মানুষের মতো আমারও একটি সংসার আছে এবং সেই সংসারে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা রয়েছে। সংসারকেন্দ্রিক হাসি-কান্না, ক্রীড়া-কৌতুক এবং নানাবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনা দ্বারা আমিও নিয়ত তাড়িত হই অন্যসব মানুষের মতো। আমার স্ত্রীর ধারণা— আমার বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো না— অধিকন্তু বেহিসাবি চালচলন, কুঁড়েমি ও গোঁয়ার্তুমির কারণে আমি এখন এক অদ্ভুত মানুষে পরিণত হয়েছি যে একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কোনো মহিলার পক্ষে আমার সঙ্গে ঘর করা সম্ভব ছিল না। তার কথার জবাবে অন্য পুরুষদের মতো আমি যখন আরও একটি বিয়ের হুমকি দিয়ে তার মুখ বন্ধ করার নির্বুদ্ধিতা প্রদর্শন করতাম তখন তিনি কীসব বলতেন তা আমার মতো সংসারধর্ম পালন করা লোকজন কমবেশি আন্দাজ করতে পারেন।

আমার দাম্পত্যের প্রথম ৩৩ বছর অন্যসব মানুষের মতো চলার পর গত এক বছর ধরে অদ্ভুত এক উৎপাত শুরু হয়েছে। ঝগড়াঝাঁটি, বাগিবতণ্ডা নেই বললেই চলে। অধিকন্তু স্ত্রীমণি সুযোগ পেলেই খোঁটা দিয়ে বলেন, কই গো! তুমি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছ! তাড়াতাড়ি আরও একটি বিয়ে করে আমায় একটি সতীন এনে দাও না। তার কথা শুনে সন্তানরাও হাসতে আরম্ভ করে। ইদানীংকালে লক্ষ্য করছি, আমার ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেলেই আমার সঙ্গে মজা করে এবং আমাকে কোনো অবস্থাতেই তাদের জন্য হুমকি বলে মনে করে না। তারা মনে করছে, আমি সম্ভবত খুব দুঃখের মধ্যে আছি এবং অসহায় হয়ে পড়ছি। তাই তারা করুণা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের পাশাপাশি আমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে চলেছে। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি ততক্ষণ তারা একটু আড়ালে-আবডালে থেকে আমার কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করে। তাদের ধারণা আমার হয়তো দুঃখের তাড়নায় মতিভ্রম ঘটেছে এবং খুব তাড়াতাড়ি আমি হয়তো বা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাব। তা না হলে আমি কেন সময় পেলে ওমনটি করছি।

সাম্প্রতিক এক সকালের ঘটনা বললেই আপনারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন। সেদিন খুব সকালে আমি যখন গান শুনতে শুনতে শেভ করছিলাম তখন হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে ডাইনিং টেবিলে অধ্যয়নরত আমার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে এবং তার স্কুলপড়ুয়া কিশোর ভাইটির দিকে তাকালাম। দেখলাম তারা চুপি চুপি কী যেন বলছে আর হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তাদের সেই হাস্যরস যে আমাকে নিয়ে হচ্ছে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তাই কোনো ভণিতা না করে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে নিয়ে হাসছ কেন! তারা সহাস্যে বলল, বাবা! তুমি থ্রি ইডিয়টস ছবির সেই প্রিন্সিপাল স্যারের মতো হয়ে যাচ্ছ। এই যুগে কেউ উচ্চাঙ্গ সংগীত বাজিয়ে চোখ বুজে শেভ করে তা তোমাকে না দেখলে এবং ওই পাগলা প্রিন্সিপালকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। আমি তাদের কথা শুনে বেশ তৃপ্তি পেলাম এবং বাথরুমের আয়নার সামনে গিয়ে পুনরায় শেভ আরম্ভ করার আগে ওস্তাদ বড় গুলাম আলী খান পরিবেশিত দরবারি রাগসংগীতের ভলিউমটি আরও বাড়িয়ে দিলাম।

সম্মানিত পাঠক! নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, ইদানীংকালে উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভক্ত হয়ে পড়ার কারণে আমার পরিবারের লোকজন আমাকে বিশেষভাবে করুণা করতে আরম্ভ করেছে। শান্তশিষ্ট গোবেচারার মতো চুপচাপ বসে অথবা শুয়ে চোখ বুজে উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে শুনতে আমার চেহারার মধ্যে এক ধরনের ভাব চলে আসছে। আমার কথাবার্তা, চালচলন, কাজকর্ম ইত্যাদিতে অস্থিরতা, হাঁকডাক এবং হম্বিতম্বির পরিবর্তে এক ধরনের নীরবতা, নির্জনতা এবং পরিমিতিবোধ যুক্ত হয়েছে। অনর্থক রংতামাশা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অহেতুক আড্ডাবাজি, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা, ঘোরাফেরা এবং খানাপিনা আমায় আর আকৃষ্ট করছে না। নিজের রুটিন কাজকর্মের বাইরে যে সময়টুকু পাই তা ইবাদত-বন্দেগি, শরীরচর্চা, অধ্যয়ন এবং উচ্চাঙ্গ সংগীত শ্রবণের মাধ্যমে কাটিয়ে দিই। ইউটিউবে খোঁজ করে পৃথিবীর নামকরা সব উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীর শিল্পকর্ম শ্রবণ করি এবং সাধ্যমতো চুপচাপ থাকি। ফলে আমার পরিবার আমার এই হঠাৎ পরিবর্তনে কতটা চিন্তিত তা আমি ভাষায় বুঝতে পারব না।

আলোচনার এই পর্যায়ে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, উচ্চাঙ্গ সংগীত শ্রবণের মধ্যে এমন কী মাহাত্ম্য রয়েছে যা নিয়ে দেশের একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখতে হবে এবং তা আবার আমাদের কষ্ট করে পড়তে হবে। আপনার এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে একটি কথা বলে নেওয়া আবশ্যক যে, আরও অনেক মানুষের মতো আমিও উচ্চাঙ্গ সংগীত পছন্দ করতাম না, বরং যারা শুনতেন ও যারা গাইতেন তাদের পাগল মনে করতাম। জীবনের বালকবেলায় পল্লীগীতি, যাত্রাগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারিসারি, মুর্শিদি প্রভৃতি গান আমার ভালো লাগত। কলেজে পড়ার সময় রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গানের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি রক ও পপ গান শুনতাম। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও দেশি-বিদেশি রাগনির্ভর কোনো উচ্চাঙ্গ সংগীতের ছায়াটি পর্যন্ত মাড়াতাম না। এ অবস্থায় বছরখানেক আগে মানবশরীর ও মনের অতিপ্রাকৃত বিষয়াদি নিয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে যা জানলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার উপক্রম হলো।

মানবশরীরের অভ্যন্তরে রক্ত চলাচল এবং এক অঙ্গ থেকে অন্য অঙ্গের কাছে তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য যে শিরা-উপশিরার সুবিশাল ও বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে তা লম্বালম্বিভাবে একটির সঙ্গে অন্যটি জোড়া লাগালে যে দৈর্ঘের সৃষ্টি হবে তা দিয়ে পুরো পৃথিবীর ব্যাস একবার পেঁচানো যাবে। শিরা-উপশিরার মাধ্যমে বর্তমান-কালের ফাইবার অপটিকের মতো তথ্য আদান-প্রদান ও রক্ত সঞ্চালন করা ছাড়াও মানুষের শরীরে তারবিহীন যোগাযোগের জন্য অসংখ্য মোবাইল ফোনের টাওয়ার, কম্পিউটার, নেটওয়ার্কের জন্য রাউটার কিংবা ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের ল্যানকার্ডের মতো বেইজ স্টেশন রয়েছে। এসব স্টেশন পরস্পরের সঙ্গে এক ধরনের শব্দতরঙ্গ, উত্তাপ ও রশ্মির মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবশরীরের এই মোবাইল নেটওয়ার্ক একটি শরীর ভেদ করে অন্য শরীরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদান করে। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা-সন্তান ছাড়াও প্রাণের বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, ওস্তাদ, সাগরেদ প্রমুখের সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত, দুনিয়া থেকে আসমান এবং আসমান থেকে কবর পর্যন্ত বিনা তারের সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম।

মানুষের শরীরের সুস্থতা, কর্মক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও অন্যান্য জৈব রাসায়নিক কর্মের জন্য হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী, তথা পরিপাকতন্ত্র, রেচনতন্ত্র ও মস্তিষ্ক পরস্পরের সঙ্গে শিরা-উপশিরা ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। এ ছাড়া মানুষের মন, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে দেহের আন্তযোগাযোগের পুরোটাই ঘটে মোবাইল নেটওয়ার্ক তথা ইথারের মাধ্যমে। মানুষের শরীরে যদি কোনো রোগ হয় কিংবা কোথাও অস্ত্রোপচারের দরকার হয় তবে আমাদের বিজ্ঞান এযাবৎকালে মানবশরীরের শত কোটি ভাগের এক ভাগের ওপরও কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। শরীরের বেশির ভাগ রোগ নিরাময় হয় প্রাকৃতিক আলো, বাতাস ও শব্দের মাধ্যমে। যে মানুষ তার শরীর ও মনের জন্য আলো, বাতাস ও শব্দকে যত সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে পারে তারাই সুখ-শান্তি ও সুস্থতার এক অনাবিল স্পর্শে রাজকীয় জীবন-যাপন করতে পারে।

আমরা কমবেশি সবাই এ কথা খুব ভালো করে জানি যে, পৃথিবীর সব সৃষ্টি ও ধ্বংসের মূলে রয়েছে শব্দ। শব্দের মাধ্যমে মানবশরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরার মধ্যকার রোগবালাই দূর করা যায় কোনো রকম ওষুধ প্রয়োগ কিংবা অস্ত্রোপচার ছাড়াই। একইভাবে শরীরের মোবাইল স্টেশনগুলোর রোগ কেবল শব্দ দ্বারাই দূর করা সম্ভব। রোগবালাই ছাড়াও শব্দ প্রয়োগ বা সাউন্ড থেরাপির মাধ্যমে শিরা-উপশিরা ও বেইজ স্টেশনগুলোর কর্মক্ষমতা এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এর ফলে মানুষ যেমন প্রফুল্লময় কর্মশক্তি ও সৃজনশীল উদ্ভাবনীময় চিন্তাশক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে তেমন সমগ্র আত্মীয়স্বজন, সমাজ, সংসার এবং বিশ্বমানবতার সঙ্গে আন্তসংযোগ স্থাপন করে পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, সাগরের গর্জন, পাকপাখালির কলতান, মেঘের গর্জন প্রভৃতি প্রাকৃতিক শব্দের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুরলহরি মানব মন-মস্তিষ্ক ও শরীরের জন্য অব্যর্থ মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। মহাকালের সব অতিমানব এবং মহামানব প্রকৃতির শব্দ ও সংগীতের সুরলহরি দ্বারা পার্থিব জীবনে বিস্ময়কর সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সম্রাট আকবর, সম্রাট সুলেমান, সম্রাট মাইয়াস, সম্রাট দারায়ুস ছাড়াও আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন বোনাপাট এবং হিটলারের মতো মানুষ উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতেন রাতের পর রাত জেগে। আমাদের পাক-ভারতে আদি যুগে অর্থাৎ আর্যদের আগমনের আগে থেকেই রাগনির্ভর উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চিত হয়ে আসছিল। তবে মুঘল সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় মিয়া তানসেনের দ্বারা যে হিন্দুস্থানি রাগসংগীতের প্রচলন ঘটে তা-ই আজ সারা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধজনকে বিমুগ্ধ করে রাখছে। তানসেনের পর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, আকবর আলী খাঁ, বিসমিল্লাহ খাঁ, বড় গুলাম আলী, বেগম মুখতার, ওস্তাদ আল্লারাখা খান ও পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া প্রমুখ বিস্ময়কর প্রতিভাধর সংগীতজ্ঞের হাতের ছোঁয়া ও কণ্ঠের লালিত্যে বিশ্বসংগীতের ভাণ্ডারে যে অমৃত সঞ্চিত হয়েছে যার স্বাদ গ্রহণ করে বিগদ্ধ মানবমণ্ডলী কীভাবে উপকৃত হয় তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব।

আমাদের শরীরের মধ্যে একটি স্বয়ংক্রিয় ও ছন্দময় শব্দতরঙ্গ রয়েছে। মূলত হৃৎপিণ্ডকে কেন্দ্র করে এ শব্দতরঙ্গ প্রতিটি শিরা-উপশিরা, মোবাইল বেইজ স্টেশন ও শরীরের বহির্ভাগের অগণিত কোষকে একই তালে আন্দোলিত করে। মানুষের রোগবালাই, দুঃখ-কষ্ট, যাতনা-বেদনা, অধিক পরিশ্রম, অনাহার-অর্ধাহার, অপুষ্টি, শীত, তাপ প্রভৃতি কারণে যদি শরীরের কোনো অংশে কম্পনের ছন্দপতন হয় তবেই সেখানে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যার ফলে মানুষ উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে। অন্যদিকে, কোনো অংশের কম্পন যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে সেই অংশের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এর ফলে স্মৃতি হারানো, অবশ হওয়া, বুদ্ধিহীন হয়ে পড়া থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া কিডনি নষ্ট হওয়া, ক্যান্সার, টিউমার হওয়ার পাশাপাশি পিত্তথলি, কিডনি প্রভৃতি স্থানে পাথর সৃষ্টি হয়ে মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়। মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা, কোষ ও নিউরনে সঠিক ছন্দে কম্পন না হলে মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি-প্রজ্ঞা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব ও আচরণে অসামঞ্জস্য দেখা দেয় এবং তারা নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের শরীরের ছন্দ বাইরের শব্দ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। শব্দ প্রয়োগ করে তাত্ক্ষণিকভাবে শরীরের ভিতরকার বিষব্যথা দূর করার পদ্ধতি যেমন বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে তেমন শব্দের মাধ্যমে কিডনির পাথর, পিত্তথলির পাথর থেকে শুরু করে ক্যান্সারের কোষ পর্যন্ত ভেঙে ফেলার মেশিন আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা ও কোষসমূহের শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করে সেগুলোর মেরামত বা সেগুলোকে সর্বোচ্চ কর্মক্ষম করার একমাত্র উপায় হলো উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিভিন্ন রাগরাগিণীর সুরলহরি। এসব রাগরাগিণী শরীর-মন-মস্তিষ্কের ওপর কখন ও কীভাবে কাজ করে তা বলার আগে উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে সামান্য ধারণা দেওয়া আবশ্যক।

সংগীতজ্ঞরা স্থান-কাল-পাত্র, প্রকৃতি ও পরিবেশ-ভেদে মানুষের হৃৎপিণ্ডসহ শরীরের অন্যান্য অংশে যে কম্পন হয় তার মাত্রা, ছন্দ, গতি ও প্রকৃতি বিবেচনা করে বিভিন্ন রাগসংবলিত সুর সৃষ্টি করেন। এসব সুর কণ্ঠে ধারণ করে কেউ হয়ে যান কিংবদন্তির বেগম মুখতার, বড় গুলাম আলী, নুসরাত ফতেহ আলী খান অথবা শামশাদ বেগম। অন্যদিকে, একই সুর সারোদে ধারণ করে কেউ কেউ হয়ে যান ইতিহাস সৃষ্টিকারী আলাউদ্দিন খাঁ, আকবর আলী খাঁ বা আমজাদ আলী খাঁ। রাগরাগিণী যখন মানুষের পদযুগলে শোভা পায় তখন একজন বিরজু মহারাজ অথবা উদয় শঙ্কর পয়দা হয়ে যান। তবলায় আশ্রয় নিলে আমরা আল্লারাখা খান ও জাকির হোসেন খানকে পাই। অনুরূপভাবে রাগরাগিণীর সানাইয়ে ভর করলে বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভা ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁর দেখা মেলে আর সেতারে পেয়ে যাই পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অনুশকা শঙ্করকে।

উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিভিন্ন রাগরাগিণী হলো মানুষের শরীর, মন ও মস্তিষ্কের নিরাময় সাধনকারী এক অতি উঁচু মার্গের অব্যর্থ মহৌষধ। যারা সচরাচর ধ্যান করতে অভ্যস্ত এবং নিজের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা দূর করার শান্তিময় পথ খুঁজে বেড়ান তারা এই মহৌষধে উপকার পান। অসুস্থ শরীর, অস্থির চিত্ত এবং অপরিপক্ব মস্তিষ্ক দ্বারা যেমন ধ্যান সম্ভব নয়; তেমন উচ্চাঙ্গ সংগীতও তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। চিন্তা-চেতনা ও কর্ম দ্বারা যে ব্যক্তি নিজের অপূর্ণতা অনুধাবন করতে পারেন এবং জীবন-জীবিকার সর্বস্তরে হৃদকম্পনের ছন্দময় গতিকে একই তালে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পথ খুঁজতে থাকেন কেবল তারাই রাগরাগিণীর ছন্দে অনুরণিত হয়ে শরীরের সর্বস্তরে ছন্দময় শব্দের মাধ্যমে কম্পন ধরিয়ে অনাবিল প্রশান্তি লাভ করার পাশাপাশি কর্মে প্রেরণা, উদ্ভাবনে সৃজনশীলতা ও সফলতায় ব্যতিক্রমী নজির স্থাপন করতে পারেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুরলহরি, ছন্দ মানুষের শরীর-মনের পরতে পরতে নির্দিষ্ট মাত্রার কম্পন সৃষ্টি করে। সুরের তালে তালে কম্পনের মাত্রা যেমন বাড়ে তেমন আনুপাতিক হারে কমতে গিয়ে সেখানে এক ছন্দময় গতি সৃষ্টি করে দেহ-মনে এমন এক উন্নয়ন ঘটায় যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে কিছু বলে নিবন্ধ শেষ করব। নাচুনে বুড়ির নাচন কথাটি এসেছে একটি বাংলা প্রবাদ থেকে যেখানে বলা হয়েছে, একে তো নাচুনে বুড়ি তার ওপর ঢোলের বাড়ি। প্রবাদটি ব্যঙ্গাত্মক হলেও আমি শিরোনামের নাচুনে বুড়ি বলতে সংগীতময় মানুষকে বুঝিয়েছি যার মন-মস্তিষ্ক ও শরীরে সংগীতের সুর-তাল-লয়-ছন্দ চৌম্বক আকারে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শরীরের বাইরের কোনো সুর-তাল-লয় তা ঢোল বা অন্য কোনো বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে অথবা প্রকৃতির অন্য কোনো মাধ্যমে অনুরণিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাকর্ষের চৌম্বক শক্তির মতো মানুষের ভিতরকার সংগীতের চুম্বককে আকর্ষণ করতে থাকে। ফলে মানুষ ছন্দের তালে নাচতে আরম্ভ করে দেয় কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো বা একান্ত মনে অতি গোপনে হৃদয়ের নির্জন গহিন অরণ্যে।

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর