শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বপ্নবাজ বাদলের খেজুর অভিযান

শাইখ সিরাজ

স্বপ্নবাজ বাদলের খেজুর অভিযান

ভালুকার পাড়াগাঁয়ের মোতালেবের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মনে আছে। যাকে সবাই খেজুর মোতালেব নামেই চেনে। সেই ২০০১ সাল থেকে শুরু করে নানা প্রতিকূলতা জয় করে ২০০৪ সালে ফলিয়েছিলেন সৌদি খেজুর। মোতালেবই বাংলাদেশের মাটিতে সৌদি খেজুর ফলানোর প্রথম নায়ক। চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত সেই মোতালেবের সাফল্যের গল্প শুনে আরেক যুবক গাজীপুরের নজরুল ইসলাম বাদল চিন্তা করলেন আরও গভীরভাবে। আমাদের দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি করা হয়। তার লক্ষ্য বাংলাদেশে যে পরিমাণ খেজুর আমদানি করা হয়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে সে পরিমাণ খেজুর উৎপাদন। স্বপ্নটা তার অনেক বড়। আর বড় স্বপ্নটি পূরণ করতে তিনি মাঠে নেমেছেন। এই উদ্দীপ্ত তরুণের খবর পেয়ে একদিন গাজীপুর গেলাম তার কর্মকাণ্ড দেখতে। গাজীপুরের পিরুজালি গ্রাম। এলাকাটি অদ্ভুত ছায়াঘেরা। মনে হয় বহুবছর আগের প্রকৃতি। গাজীপুরের কিছু কিছু এলাকার কৃষিজীবী বসতিগুলো এখনো বেশ ছায়াসুনিবিড়। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে গাছে গাছে কাঁঠাল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লটকন, জামরুলসহ নানারকমের মৌসুমি ফল। বাতাসে মিষ্টি ঘ্রাণ। দেখা হলো আত্মবিশ্বাসী তরুণ বাদলের সঙ্গে। ঘুরে দেখালেন তার খেজুরবাগান, কৃষি আয়োজন। কথায় কথায় অনেক কথাই বললেন বাদল। লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসায় হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু সবুজ প্রকৃতির মায়া ছেড়ে বাজারে শুধু টাকার অন্বেষণে বসে থাকতে ভালো লাগেনি তার। জানালেন, সেই শৈশবে টেলিভিশনে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান দেখে দেখে স্বপ্ন গেঁথেছিলেন কৃষিকে ঘিরে। সেই স্বপ্নের টানে, সবুজের মায়ায় অবশেষে কৃষিতেই ফিরেছেন। মুরগি লালন-পালন, লেবুবাগান ইত্যাদি ছোট ছোট উদ্যোগ দিয়ে শুরু। তারপর ১০ বছর আগে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে ভালুকার খেজুর মোতালেবের খেজুরবাগান দেখে নতুন স্বপ্ন জাগে তার। সেই থেকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে লেগে থেকে আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন তিনি। বাদলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমান একসময় কাজ করতেন সৌদি আরবে। সেখানে তিনি খেজুর চাষের বিষয়গুলো দেখেন খুব কাছ থেকে। শিখেছেন হাতে-কলমে। দেশে ফিরে ছেলের সঙ্গে লেবুবাগান আর লটকন ফলিয়ে বেশ লাভবান হন। বাদল যখন বললেন তিনি খেজুর চাষ করবেন তখন চিন্তিত ছিলেন সত্যিই এ দেশে খেজুর চাষ সম্ভব কিনা এ বিষয়ে। প্রতিবেশীরাও হাসাহাসি করতেন, বলতেন মরুভূমির খেজুর কোনো দিন এ দেশে ফলবে না। কিন্তু বাদল দেখেছেন অসাধ্য সাধন করেছেন মোতালেব। মোতালেবকে নিয়েও এমন কথা বলেছেন প্রতিবেশী; বলেছেন এসব পাগলের কর্মকাণ্ড। এমনকি বউ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন বাবার বাড়ি। সেই মোতালেবের নিষ্ঠা আর একাগ্রতা বাদলের অনুপ্রেরণা। লেগে থাকলেন তিনি। বাবার হাতে-কলমে খেজুর চাষের জ্ঞান আর তার শ্রম ও একাগ্রতায় সফল হলেন বাদল। এখন শুধু খেজুর নয়, খেজুরের চারা বিক্রি করে আয় করছেন লাখ টাকা। বাদলের বাগানের শুরু ২০১৪ সালে। বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮টি চারাগাছ সংগ্রহ করে ১০ কাঠা জমিতে চাষ শুরু করেন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে ৩টি, দুবাই থেকে ১০টি, ভারত থেকে ২টি ও কুয়েত থেকে ৩টি চারা সংগ্রহ করেন বাদল। এতে তার ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা। সেই ১০ কাঠার বাগান এখন আড়াই একর জমিতে ছোট, বড় ও মাঝারি মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার চারাগাছ রয়েছে। ফল দিচ্ছে ১৬ রকমের সৌদি খেজুরের ১০৫টি গাছ। বাদল খেজুরের চারা তৈরির জন্য গড়ে তুলেছেন এক নার্সারি। তিনি জানালেন ১৪ মাস বয়সী চারা বিক্রি করেন প্রতিটি ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা দরে। দুই বছর ১১ মাস বয়সের চারা বিক্রি করেন প্রতিটি ৫ হাজার টাকা দরে। আর চার বছর বয়সের চারা বিক্রি করেন প্রতিটি ১০ হাজার টাকা দরে। এ হিসাবে তার কাছে খেজুরের চারা রয়েছে এখন কোটি টাকার। এ তো গেল চারার হিসাব। ফলের হিসাবেও লাভ রয়েছে বাদলের। আজওয়া, আনবারা, সুক্কারি, রুথান, বারহি, মরিয়ম প্রভৃতি জাতের গাছে ফল ধরেছে। একেকটি গাছ থেকে মিলবে ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি খেজুর। বাদল জানালেন, প্রথম বছর পাওয়া খেজুরের স্বাদ এবং মান যেমন ভালো ছিল, ভালো ছিল খেজুরের আকারও। খেজুর গাছ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করছেন বাদল। অনলাইনে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও খামারে যোগাযোগ করে তাদের সেবা গ্রহণ করেছেন। গাছের পাতা দেখে বলে দিতে পারেন কোনটা পুরুষ গাছ আর কোনটা স্ত্রী। বাগানের প্রতিটি গাছের জাত, বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য বৃত্তান্ত বাদলের নখদর্পণে।

মুগ্ধ হওয়ার মতো খেজুরবাগান। অল্প দিনেই বাগানের খেজুরগুলো পেকে উঠবে। তখন বৈচিত্র্যময় এ খেজুরবাগানটি আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে উদ্যমী ও কৃষি-অনুরাগী তরুণ নজরুল ইসলাম বাদল তার স্বপ্নপথে অনেকটাই সফল। তিনি নিজের বাগান সাজানোর পাশাপাশি স্বপ্ন দেখেছেন উন্নত জাতের বিদেশি খেজুরের চারা দেশের আগ্রহী উদ্যোক্তা ও শৌখিন কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার। খেজুর চারা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে তাদের খেজুর চাষ পদ্ধতিও হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। আগেই বলেছি, বাদল শুধু নিজের খামার সমৃদ্ধ করার স্বপ্নে বিভোর নন, তার ইচ্ছা বাংলাদেশকে এই পুষ্টিকর সুস্বাদু ও পবিত্র মাটির কুদরতসম্পন্ন ফলে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। এজন্য হিসাব ও পরিকল্পনাও তৈরি করেছেন তিনি। আত্মবিশ্বাসী ও দূরদর্শী উদ্যোক্তাদের প্রথম যে কোনো উদ্যোগ পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে বিস্ময় জাগায়। অনেকেই নিরুৎসাহিত করেন। বাদলের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাদল প্রমাণ করে দিয়েছেন সত্যিকারের স্বপ্নবাজ মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না। বাদলের এ স্বপ্নের বাগানটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমে মানুষের। বাদলের পৈতৃক বাড়ির ২০ বিঘা জায়গাজুড়েই অনন্য এক কৃষি ক্ষেত্র। এখানেই রয়েছে কাঁঠাল ও লটকনের ফলবান বাগান। তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগের এই সময়ে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য যে কোনো উদ্যোগ সফল করে তোলা অনেকটাই সহজ। কিছুদিন আগে নরসিংদীর কামরুল ইসলাম মাসুদের খামারের কাদাকনাথ মুরগি নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। সেই খামার থেকে কাদাকনাথ মুরগির জাতও নিয়ে এসেছেন নিজের খামারে। রয়েছে মুরগির আরও কিছু জাত। আজকের দিনে তরুণ উদ্যোক্তাদের বড় একটি অংশ কৃষিমুখী হচ্ছে। উৎপাদন খাতের প্রয়োজনীয়তা তারা যেমন উপলব্ধি করছে, একইভাবে বুঝতে পারছে এর লাভজনক নানা দিক। এজন্য কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ব্যবহারিক শিক্ষাও তারা অর্জন করছে— এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বিষয়। গাজীপুরের পিরুজালির এই তরুণ তার নিজস্ব স্বপ্ন পূরণ করে সারা দেশে আমদানিনির্ভর আরব খেজুর উৎপাদনের যে অভিযান শুরু করেছে, তা অনেক বড় স্বপ্ন, কিন্তু এর বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সবার আন্তরিক সহযোগিতা। পাশাপাশি আজ যারা শৌখিনতার বশে এমন উদ্যোগ নিচ্ছেন, তারা একটি দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে উদ্যোগটি ধরে থাকবেন, এ কামনা আমার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। [email protected]

সর্বশেষ খবর