বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবাই একবার ভেবে দেখুন

মাজাহারুল ইসলাম

সবাই একবার ভেবে দেখুন

কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি শিগগিরই তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোটা আন্দোলনকারীরাও সুমতির পরিচয় দিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে।  আন্দোলন এবং তা ঠেকানোর নামে বিশৃঙ্খল বা অবাঞ্ছিত পরিবেশ কারোরই কাম্য হওয়া উচিত নয়। জাতি উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশবাসী উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিই আন্দোলন সংগ্রামের ফসল। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন—যার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন। সব কিছুর পেছনেই ছিল ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ অগ্রণী ভূমিকা।

যে কোনো আন্দোলনেই বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ছাত্রসমাজের। শুধু আন্দোলনে নয়, অসংখ্য তরুণের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। দেশে বেকার সমস্যা বেড়েছে। নতুন প্রজন্ম মেধাবী এবং ঐক্যবদ্ধ। কবি বলেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়েই সোনার বাংলা গঠন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান, বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। জাতির প্রত্যাশা তার কাছে অনেক এবং এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জারিকৃত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেধা কোটা-২০%, মুক্তিযোদ্ধা কোটা-৩০%, নির্যাতিত মহিলা কোটা-১০% এবং জেলা কোটা ৪০% সর্বমোট-১০০%। জারিকৃত আদেশটি ছিল একটি সাময়িক বিষয় কিন্তু নানা পর্যায়ে কোটা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫৮টির মতো। কোটা পদ্ধতির সুফল-কুফল নিয়ে আমার চাকরি জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সরকার এবং প্রিয় পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছি।

মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিনই ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দুঃখের বিষয় দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৭ বছর।

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করতে প্রতিটি সরকারই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবাদে চাকরিতে প্রবেশ করেছে অনেকে। তারা না জানে ভালো বাংলা, না জানে ভালো ইংরেজি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা, সবকিছুই বৈষয়িক বিষয়। কিন্তু যখন একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুর পর জাতীয় পতাকা দিয়ে আচ্ছাদিত করে রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন করা হয় তখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা নীরবে কাঁদে। কারণ জাতীয় পতাকা শুধু একটি সেলাই করা কাপড়ই নয়। এটা জাতির অস্তিত্ব, জাতির আবেগ। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখতে হলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা সময়ের দাবি। স্বাধীনতার পক্ষের সরকার হিসেবে বর্তমান সরকারের এটা নৈতিক দায়িত্ব।

আনসার ভিডিপি কোটা : ১০% আনসার ভিডিপি কোটায় সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য বিধান রাখা হয়েছে। আনসার ভিডিপি ট্রেনিং না দিয়ে উেকাচের বিনিময়ে একটি সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে কোটার সুবাদে চাকরিতে প্রবেশ করার সুযোগ পায় অনেকে। যেহেতু আমাদের নৈতিক চরিত্রে ঘাপলা আছে, সেহেতু প্রকৃত আনসার ভিডিপি নির্ধারণ করাই দুরূহ।

জেলা কোটা : ১৯৯৩ সাল। আমি তখন উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা। নেত্রকোনা জেলার কোনো এক উপজেলায় আমার পোস্টিং। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের অফিস সহকারীর বাড়ি জামালপুর। আমার পাশের উপজেলায়। তার স্ত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। একদিন তার এবং তার স্ত্রীর কিছু কাগজপত্র আমার কাছে সত্যায়িত করার জন্য নিয়ে এলো। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখলাম তাদের উভয়ের ঠিকানা সুনামগঞ্জ। জিজ্ঞাসা করলে ছেলেটি সততার পরিচয় দিল। সে আমাকে বলল, জামালপুরের কোটায় বারবার ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাচ্ছি না। তখন জাতীয় পরিচয়পত্র চালু করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নাগরিকত্ব সনদপত্র দিতেন।  কোনো এক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সুনামগঞ্জের নাগরিকত্ব সনদ নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেছে। পাশাপাশি আমি ১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে কর্মরত ছিলাম। কিশোরগঞ্জে ১৩টি উপজেলার প্রতিটি উপজেলার তহশিল অফিসে কর্মচারী পদে কোনো এক জেলা প্রশাসক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) তার জেলার ৩০-৩৫ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন। বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত কিশোরগঞ্জবাসী। সারা বাংলাদেশেই তদন্ত করলে এর ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে।

অন্যান্য কোটা নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন নেই। কারণ বেশ কিছু দিন যাবৎ কোটা পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে। কোটা পদ্ধতি চালু হয়েছিল ১৯৭২ সালে আজ ২০১৮ সাল। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে, বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ১৯৭২ সাল ছিল অ্যানালগের যুগ, ২০১৮ সাল ডিজিটালের যুগ। জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন মেধার। মেধাশূন্য জাতি কোনো দিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কোটা পদ্ধতি বাতিল বা সংস্কার বড় বিষয় নয়।  বড় বিষয় হলো মেধাবী লোকদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্র তৈরি করা। এ জন্য প্রয়োজন আমাদের দেশপ্রেম, সততা ও মানবতা।

পাদটীকা : দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ‘দি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা’। বিশ্ববিদ্যালয়টির ফটকে লেখা আছে— কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এটম বোমা ফেলার দরকার নেই। যদি পার জাতিকে মেধাশূন্য করে দাও। কারণ মেধাহীন লোক ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যেসব ঘরবাড়ি তৈরি করবে অচিরেই ঘরবাড়িগুলো ধসে পড়ে মানুষের মৃত্যু হবে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ সাভারের রানা প্লাজা। মেধাহীন লোকেরা ডাক্তার হয়ে ভুল চিকিৎসা করবে, ফলে রোগী মারা যাবে।  যা প্রতিনিয়ত পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে অদক্ষ লোক প্রবেশ করলে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হবে।  জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব, এখনো সময় আছে।  সবাই একবার ভেবে দেখুন।

            লেখক : কলাম লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর