সোমবার, ৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাকিস্তানে নীরব সামরিক অভ্যুত্থান!

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

পাকিস্তানে নীরব সামরিক অভ্যুত্থান!

পূর্বাপর ঘটনাসহ ২৫ জুলাই পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনটি যেভাবে সম্পন্ন হলো এবং তার ফল ও দলীয় আসন প্রাপ্তির বিন্যাস দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের ছদ্মবেশে পাকিস্তানে আরেকটি নীরব সামরিক অভ্যুত্থান সুসম্পন্ন হয়েছে। পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেনাবাহিনী ক্ষমতার রশি নিজেদের হাতে রাখার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সবকিছু এমনভাবে সাজিয়েছে যাতে কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারে।  বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি সরাসরি সামরিক শাসনের অনুকূলে নয় বিধায় সরকারের কায়ায় থাকতে না পারলেও খুবই সূক্ষ্মভাবে সেনা কর্তৃপক্ষ সর্বদা ছায়ায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। দলভিত্তিক আসন প্রাপ্তি দেখলেই সেটা বোঝা যায়। ভুট্টো পরিবার নিয়ন্ত্রিত ঐতিহ্যবাহী পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ, দুই দল মিলে যে সংখ্যক আসন পেয়েছে তার থেকে এককভাবে বেশি আসন পেয়েছে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

তবে ইমরান খানের দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৭ আসন পায়নি, পেয়েছে ১১৫ আসন। সমীকরণটি এরকম হয়েছে, নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর মেয়াদ পূর্তির আগেই সেনাবাহিনী কর্তৃক বা তাদের ইশারায় দুবার ও তিনবার ক্ষমতাচ্যুত যথাক্রমে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগ এক জোট হয়েও যাতে সরকার গঠন না করতে পারে তা নিশ্চিত হয়েছে। এই দুই দল মিলে প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ১১০-এর নিচে। অন্যদিকে ইমরান খানের দলকে সরকার গঠনের জন্য ২২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে এবং সরকার টিকিয়ে রাখতে হলে আগামীতেও নির্ভরশীল থাকতে হবে। ক্ষমতার নাটাইটা এখানেই রয়েছে যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ছোট দলগুলোর জয়ের পেছনে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা রয়েছে। এই সংসদ সদস্যরা তাদের নির্দেশেই চলবেন। ফলে ইমরান খান যদি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান তাহলে ওইসব সংসদ সদস্য ইমরান খানের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। ফলে সরকারও তখন ভেঙে যেতে পারে। পাকিস্তান ক্ষমতার উৎস হিসেবে কাজ করে পাঞ্জাব প্রদেশ। দীর্ঘদিন পর সেখানেও পরাজিত হয়েছে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ, যদিও নির্বাচনপূর্ব সব জনমত জরিপ অনুসারে নওয়াজের দল বিপুলভাবে এগিয়ে ছিল। পাঞ্জাব প্রদেশেও ইমরান খানের দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সেখানে প্রাদেশিক সরকার গঠনের জন্য স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থন লাগবে, যারা সব কিছু করবেন সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি হেলনে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যা ঘটছে তাতে পুরো অঞ্চলের জন্য নতুন করে উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে। যে সময়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোকে সুকৌশলে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ঠিক সেই সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তথাকথিত জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের (যে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ভারত ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়) মূল ধারার রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে জঙ্গি আক্রমণের প্রধান আসামি মাওলানা হাফিজ সাঈদকে শুধু মুক্তিই দেওয়া হয়নি, তার নেতৃত্বে আল্লাহ আকবার তেহরিক নামের একটি দল খুলে সেই দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথও প্রসারিত করে দেওয়া হয়। জাতিসংঘ কর্তৃক এই হাফিজ সাঈদকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে বহু আগে। হাফিজ সাঈদকে ধরে দিতে পারলে তার জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের নিজস্ব সন্ত্রাসী তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও চরম শিয়া বিরোধী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নেতা আওরঙ্গজেব ফারুকীকে আদালতের নির্দেশে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই নেতা প্রাক-নির্বাচনী এক জনসভায় ঘোষণা দেন, তিনি নির্বাচিত হলে পাকিস্তানে শিয়া জনগোষ্ঠীকে আর বসবাস করতে দেওয়া হবে না। তাদের দেশ ছাড়তে হবে, আর নয়তো সবাইকে হত্যা করা হবে। নির্বাচনের সপ্তাহ দুই আগে নওয়াজ শরিফ যখন লন্ডন থেকে পাকিস্তানে ফিরলেন, সেদিন ১৩ জুলাই শুক্রবার বেলুচিস্তানের একটি নির্বাচনী প্রচার সমাবেশে জঙ্গিদের আক্রমণে ১২৮ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন। ওই আক্রমণের টার্গেট হয় বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি), যারা মূলত উদার গণতন্ত্রপন্থি এবং পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারি অক্ষ শক্তির বিরোধী। এই হত্যার উন্মাদনা বন্ধে সরকার বা সেনাবাহিনীর কাউকেই তেমন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। চরম জঙ্গিবাদী ও উগ্র ইসলামিস্ট দলগুলো বরাবরের মতোই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনেও ভালো ফল করতে পারেনি। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাদের আরও সুসংগঠিত করা হলো, যাতে প্রয়োজন হলে সামরিক কর্তৃপক্ষ আগের মতো হাতের পাঁচ হিসেবে এদের দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে মোকাবিলা করতে পারে এবং যে দলই ক্ষমতায় থাকুক তারা ছকের বাইরে গেলে যেন এদের সামরিক বাহিনী রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারে। বিগত সময়ে বেনজির ভুট্টোকে দুবার ও নওয়াজ শরিফকে তিনবার মেয়াদ পূর্তির আগেই ক্ষমতা থেকে উত্খাতের পটভূমি তৈরি করার জন্য সামরিক বাহিনী উগ্র ইসলামিস্ট গোষ্ঠীকে উল্লিখিত কৌশলে ব্যবহার করেছে। পরিস্থিতি মূল্যায়নে পাকিস্তানি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে বর্তমান সেনা কর্তৃপক্ষ পর্দার আড়াল থেকে জেনারেল জিয়াউল হকের দেখানো পথে হাঁটছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরিবারের কর্তৃত্ব হ্রাস করার জন্য জেনারেল জিয়াউল হক ইসলামিস্ট কট্টরপন্থিদের সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবের প্রভাবশালী শিল্পপতি পরিবারের উদীয়মান স্টার নওয়াজ শরিফকে টেনে এনে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রায় ৩৮ বছর পর বর্তমান সেনা কর্তৃপক্ষ একই কৌশলে কট্টর ইসলামিস্টদের সহযোগিতায় নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবারকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে তত্স্থলে সাবেক ক্রিকেটার উগ্র মতাবলম্বী ইমরান খানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। এর আলামত ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার অব্যবহিত পরেই পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পরপরই নওয়াজ শরিফ বলেছিলেন, তিনি পাকিস্তানের মানুষকে জানিয়ে দিতে চান দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিই রাষ্ট্রের বস, সেনাবাহিনী নয়। অনেক বিশ্লেষক এখন বলছেন, আসলে সেদিনই নওয়াজ শরিফের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। এত দিন ছিল শুধু সময় গণনা এবং ক্ষেত্র প্রস্তুতের পালা। ওই সময় ভারতের সঙ্গে দহরম-মহরম এবং দেশের স্বার্থ বিলিয়ে দিচ্ছেন, নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে ইমরান খানের দল বিশাল জনসমাবেশের মাধ্যমে প্রায় তিন মাস ইসলামাবাদের সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে রাজধানীকে প্রায় অচল করে দিয়েছিল। তখনই সবাই বলেছেন, সেনা কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়া ও নির্দেশে ইমরান খান ওই কর্মসূচি পালন করছেন। তারপর এক সময়ে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনা সদরে এসে সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করলে ইমরান খানের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তখনই তাবৎ বিশ্লেষকদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। নওয়াজ শরিফ সৎ ও বিশ্বস্ত নয়, এই বিমূর্ত অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৭ সালে যখন নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে তখনই বোঝা গিয়েছিল নওয়াজ শরিফ ও তার পরিবারের রাজনীতি শেষ। ২৫ জুলাই নির্বাচনের ফলাফল দেখে সবাই বুঝতে পারছেন আগামী দিনে ইমরান খানের কাঁধে বন্দুক রেখে সব ব্যাপারে প্রকৃত গানম্যানের কাজ করবে সেনাবাহিনী। আর সেটা যখন হবে তখন নিশ্চিত করে বলা যায়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে এবং পুরো অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘদিন যাবৎ পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিশেষ করে ভারত, আফগানিস্তান, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীই সব সময় চূড়ান্ত কথাটি বলে আসছে। একই সঙ্গে একাত্তরে বাংলাদেশে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখনো বের হতে পারেনি। সুতরাং উপমহাদেশে পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি, যার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী, তার মূলে আছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে একাত্তরের প্রতিশোধ নেওয়া এবং চিরশত্রু ভারতের কাছ থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করা। নওয়াজ শরিফ তার মেয়াদে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য বহুবার চেষ্টা করেছেন। তিনি একই সঙ্গে আফগানিস্তানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে আফগান তালেবানদের ওপর থেকে পাকিস্তানের সমর্থন ও আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই নস্যাৎ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় একাধিকবার ভারতের অভ্যন্তরে নাশকতামূলক ও জঙ্গি তৎপরতা চালিয়েছে লস্কর-ই তৈয়বা এবং জইশ-ই মুহম্মদের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। যারা সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরও সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ইমরান খান তার রাজনীতির শুরু থেকেই অত্যন্ত উগ্রপন্থি মনোভাব ব্যক্ত করে আসছেন এবং তার ভাষা ও বক্তব্যের সঙ্গে মোল্লা এবং মিলিটারির ভাষা ও বক্তব্যের কোনো পার্থক্য নেই। নওয়াজ শরিফ ও বেনজির ভুট্টোকে পোষ মানাতে না পেরে পাকিস্তানের সেনা কর্তৃপক্ষ এখন উপযুক্ত পাপেট মনে করছে ইমরান খানকে।  তাই সব কিছু মিলে মনে হচ্ছে পাকিস্তান ভবিষ্যতে আরও সামরিকতন্ত্র ও উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।  এর পরিণতিতে আফগানিস্তান ও ভারতের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাওয়াসহ সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর