শনিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেশে দেশে ‘ফিরে চল মাটির টানে’

শাইখ সিরাজ

দেশে দেশে ‘ফিরে চল মাটির টানে’

বিপ্লবী নেতা মার্কাস গার্ভে বলেছিলেন, যে মানুষের নিজের মূল, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোনো জ্ঞান নেই সে মূলত একটি শিকড়হীন গাছ। রবিঠাকুরও আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে বলেছেন শিকড়ে, যেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে নিজের অস্তিত্বের। সমুদ্র উত্থিত এই ব-দ্বীপের পলি জমা উর্বর মাটিতে পূর্বপুরুষরা বুনেছিল ফসলের বীজ, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের মূল প্রোথিত রয়েছে হাজার বছর আগে, এই কৃষিতেই। পাঠক! আপনারা হয়তো জানেন, চ্যানেল আইয়ের পর্দায় ‘ফিরে চল মাটির টানে’ অনুষ্ঠানে দেখেছেন আমি প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ ও স্কুলের একঝাঁক শিশু-কিশোর নিয়ে চলে যাই কৃষকের কাছে, কৃষির কাছে। যেন এই অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ, আগামী প্রজন্ম একবার হলেও ছুঁয়ে আসে নিজের শিকড়পোঁতা মাটি, নিয়ে আসে বাংলাদেশের কৃষকের শ্রমে-ঘামে সিক্ত মাটির ঘ্রাণ। সেখান থেকে যেন তারা দীক্ষা নিতে পারে ধ্যানমগ্ন ও শ্রমসাধনার সমৃদ্ধ জীবনের এবং আরও শক্ত ও মজবুত করতে পারে নিজের শিকড়কে।

নতুন প্রজন্মকে আগের প্রজন্মের সঙ্গে, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে প্রতিটি উন্নত ও সভ্য জাতিরই। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কৃষি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাঠ দেওয়া হয় নতুন প্রজন্মকে। যেমন বলা যায় স্কটল্যান্ডের উইটমোর অর্গানিক ফার্মের কথা। সেখানে শিশুরা নিয়মিত কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য প্রস্তুত প্রণালির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ৫০ মাইল দূরের ম্যুর পার্ক এলাকায় আন্ডার উড ফ্যামিলি পার্কের কথাও বলা যেতে পারে। এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনও আপনারা ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেখেছেন।

কদিন আগে কাজের প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল মার্কিন মুলুকের নিউইয়র্কে। সেখানে স্কুলের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের কৃষি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান ও হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়ার এক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলল। পোকান্টিকো হিলসের স্টোন বার্নস সেন্টার ফর ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার। পাহাড়বেষ্টিত নৈসর্গিক পরিবেশে সমন্বিত কৃষির এক বিশাল আয়োজন। প্রতিষ্ঠানটিতে একদিকে চলছে কৃষি উৎপাদন, অন্যদিকে কৃষি নিয়ে বহুমুখী গবেষণা। এখানে বিভিন্ন বয়সী ও শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য যেমন রয়েছে ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার আয়োজন, একইভাবে রয়েছে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থার ত্রুটিগুলো হাতে-কলমে জানার ব্যবস্থাও।

৮০ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান আমেরিকার স্বনামখ্যাত শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ ডেভিড রকফেলার ও তার মেয়ের মালিকানাধীন। তাদের উদ্যোগেই প্রথমে দুগ্ধ খামার গড়ে তোলা হয়; যা দিনে দিনে বহুমুখী কৃষি উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের স্বাদ ও মান সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেওয়ার এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই ‘স্টোন বার্ন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার’ সেন্টারেই রয়েছে ‘ব্লু হিল’ নামের ব্যয়বহুল ও অভিজাত রেস্টুরেন্ট। সরাসরি খামারজাত খাদ্যের সেই রেস্তোরাঁয় একজনের খাবারের আনুমানিক মূল্য পড়ে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২০ হাজার টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাস বলে খামারটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত রকফেলার পরিবারের নিজস্ব ও রক্ষণশীল একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০০৪ সালে এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কৃষিবিষয়ক শিক্ষার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে ১৩ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ; যাদের সবারই কৃষির প্রতি যেমন রয়েছে অনুরাগ, একইভাবে রয়েছে সম্যক জানা-বোঝাও।

আগেই স্টোন বার্ন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার সেন্টার পরিদর্শনের সময়সূচি ও অনুমোদন নিয়ে রাখা ছিল। তাই প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ নির্বাহী আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তিনি জানালেন তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে। স্টোন বার্ন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার সেন্টার গভীরভাবে চায় নতুন প্রজন্মকে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষা দিতে। সে শিক্ষাটি হোক হাতে-কলমে। মাটি ও ফসলের স্পর্শের মধ্য দিয়ে। শুধু উন্নত বিশ্ব নয়, পৃথিবীব্যাপীই শিক্ষা হয়ে উঠেছে রুদ্ধ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ভবন কাঠামোর ভিতরমহলের বিষয়। কিন্তু এখানে রয়েছে মুক্ত প্রাঙ্গণে মাটির ঘ্রাণ মেখে নতুন এক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ।

সনাতন কৃষি ও আধুনিক কৃষির পার্থক্যটি খুব স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে। অবশ্য প্রকৃতিনির্ভর কৃষিকে বেশি করে প্রাধান্য দিচ্ছে তারা। মাঠে দেখা মিলল একদল শিক্ষার্থীর, যারা হাতে-কলমে নিচ্ছে কৃষি শিক্ষা। আর তাদের শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা পরিচালক রেনে মারিয়ন। কথা হয় মারিয়নের সঙ্গে। তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা নিউইয়র্কের একটি কলেজের নবম গ্রেডের। কলেজের প্রাণিবিদ্যা ক্লাসের অংশ হিসেবেই উদ্ভিদের জীবনপ্রণালি, কৃষি ও এর অনুশীলনগুলো প্রথমবারের মতো সরেজমিন দেখছে। কৃষির পরিবর্তনগুলো তারা বোঝার চেষ্টা করছে।

মারিয়ন জানান, যদিও আমাদের সনাতন কৃষিতে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। কৃষি থেকে অনেকেই সরে গেছেন। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম আগে এসব শিক্ষার্থীর পূর্ব প্রজন্মও কৃষক ছিল। ওরা সেই অতীতটা জানে না। ওদের সেই অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা জরুরি। মাঠে দেখা মেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণের। নাম লরেন্স। কথা হয় তার সঙ্গে। সে জানায়, নয় মাসের সমন্বিত কৃষির একটি কোর্স করছে সে। কোর্সের শুরুর তিন মাস ছিল প্রাণিসম্পদ। তা শেষ করার পর বনায়ন বিষয়ে কোর্স করেছে তিন মাস, এরপর চলছে পুরোপুরি কৃষি শিক্ষা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টোন বার্ন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার সেন্টারটি বিস্ময়কর এক কৃষি ক্ষেত্র। মাঠে যেমন ফসলের উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের, একইভাবে ধারণা দেওয়া হচ্ছে উদ্ভিদের রোগবালাই, কীটনাশক প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় প্রতিটি বিষয়ে। বিস্তীর্ণ ফসলি খেত তার পাশে দীর্ঘদিনের বন-বনানীর ভিতর দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিচরণ করছে, সেই সঙ্গে জেনে নিচ্ছে কৃষির পানি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে নানা বিষয়। স্টোন বার্ন সেন্টারের ব্লু হিল রেস্টুরেন্টের কিচেনে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়েছিলাম। সেখানেও শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কিচেনে শিক্ষার্থীদের কাজ কী? স্টোন বার্ন সেন্টারে এক দিনের জন্য সংযুক্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সবজি কাটা থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত। এর প্রতিটি পর্ব অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। রেনে মারিয়ন জানান, ফসল উৎপাদনের সব পর্বে যেমন নানা বিষয়ে দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন রয়েছে, তেমন দৃষ্টি রাখতে হবে কৃষিপণ্যকে খাদ্যে পরিণত করার কৌশলের দিকেও। বিশেষ করে সবজি বা ফল কাটা, তা রান্না করা এবং পরিবেশনের ওপর নির্ভর করছে এর বিশুদ্ধতা।

পাঠক! এসব শুনে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়ছে ফিরে চল মাটির টানের কথা। আমাদের প্রতিটি সেশনেই শিক্ষার্থীদের কৃষি কাজের পাশাপাশি থাকে নিজ হাতে খাদ্য রান্নার বিষয়। অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এ কাজগুলো সম্পন্ন করে। যাই হোক, সমন্বিত কৃষি শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী আমেরিকান শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলল, ফসলের মাঠ থেকে খাবারের প্লেট পর্যন্ত অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্রস্তুতি পর্যন্ত এই সম্যক ধারণা তাদের জীবনবোধকে সমৃদ্ধ করেছে।

আগেই বলেছি, স্টোন বার্ন সেন্টার একদিকে যেমন আধুনিক কৃষির নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের কাজ করে চলেছে, একইভাবে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে কৃষিকৌশল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে যাতে তারা যে কোনো সময় কৃষিকাজে হাত দিতে পারে। ইতিমধ্যে আমেরিকার ৪৬টি স্কুলের মাধ্যমিক শ্রেণির নিয়মিত পাঠক্রমে যুক্ত রয়েছে এই সেন্টার পরিদর্শন ও ব্যবহারিক শিক্ষা। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও চিন্তা করা হচ্ছে প্রজন্মকে কৃষিসচেতন করে গড়ে তোলার। খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের স্বার্থেই প্রতিটি নাগরিকের জানা প্রয়োজন ফসল উৎপাদনের কলাকৌশল। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কৃষি সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশেও খোদ প্রধানমন্ত্রী বার বার আহ্বান জানাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষি সম্পর্কিত ধারণা নেওয়ার জন্য। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের পক্ষ থেকে প্রায় এক দশক ধরে ‘ফিরে চল মাটির টানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি চেষ্টা করে চলেছি নতুন প্রজন্মকে কৃষির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমার বিশ্বাস, এসবের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম মাটির সঙ্গে তাদের সম্পর্কটুকু ধরে রাখবে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর