রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

লেখাপড়া করে যে...

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

লেখাপড়া করে যে...

‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ ছোটবেলায় বহুবার এ কথা গুণীজনদের কাছে শুনেছি। কিন্তু বড় হতে হতে জীবনের নানা বাঁকে এ কথার সত্যতা কানাকড়িও খুঁজে পাইনি। কারণ লেখাপড়া ছাড়াও বৈধ-অবৈধ হাজারটা উপায়ে এ দেশে পরিচিতজনদের গাড়ি-ঘোড়া কিনতে দেখেছি। আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুদের মধ্যে যারা সেই ছোটবেলায় স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেছিল তাদের অনেকেই আজ গাড়ি-বাড়ির মালিক। আর সেই বন্ধুরা যাদের পড়ালেখা অন্যদের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল, অভিভাবকরা যাদের দেখিয়ে বলতেন, ‘ওই ছেলেটা কত ভালো সারা দিন পড়ালেখা নিয়ে থাকে। সারা দিনের ১৮ ঘণ্টায়ই তাদের পড়ার টেবিলে কাটে।’ আজ তাদের অনেকেই গাড়ি চালায় জীবন-জীবিকার তাগিদে। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে পড়ালেখাকে খুব দোষারোপ করা যাচ্ছে না। কারণ মাঝপথে ওরা পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার কারণেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি বলেই হয়তো তাদের এমন দশা। কিন্তু যারা শিক্ষাজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পড়ার টেবিলকে তার একমাত্র আরাধনার জায়গা বলে মেনেছেন তারাও ওই পড়ালেখার শিক্ষা মেনে বৈধ পথে নিজের জন্য গাড়ি কিনতে পেরেছেন কতজন, সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে।

আমার বক্তব্য পাঠের পর মনে হতে পারে যারা পড়ালেখা করে না তারাই তো ভালো আছে। সেই ভালো থাকা আপেক্ষিক বিষয়। কেউ যদি ছোটবেলায় শেখানো ওই বক্তব্যের মতো গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার জন্য পড়ালেখা করে তবে তা ভিন্ন কথা। বর্তমানে পড়ালেখা করলে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া যায় কি যায় না সেই বিতর্কে যেতে চাই না। তবে পড়ালেখায় যে অন্যরকম এক সুখ আছে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি। পড়ালেখার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি মাত্রই তা জানেন। আর জানেন বলেই তারা জীবনের নানা অর্থের প্রলোভন সত্ত্বেও পড়ালেখায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু পড়ালেখায় নিজেকে নিযুক্ত করা অর্থ উপার্জনের মতো অত সহজ নয়। পড়ালেখা করা অনেক কঠিন। শিক্ষকরা না জানলেও ছাত্ররা অন্তত সে বিষয়টি ভালোভাবেই জানে! পৃথিবীর সব কাজ এক তুড়িতে করতে পারে এমন ছেলেও পড়ালেখার নাম শুনলে কেমন যেন মিইয়ে যায়।

শিক্ষকদের মধ্যে যারা পড়ালেখায় নিজেকে নিযুক্ত রাখতে চান তারা জানেন এ দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা কত কঠিন। একসময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার। কিন্তু আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়েও দিন দিন মুক্তবুদ্ধির চর্চার পথ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমরা এক অদৃশ্য কারণে শিকলবন্দী হয়ে পড়ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের মুক্ত বিহঙ্গের মতো জ্ঞানের সাগরে ছুটে বেড়ানোর কথা থাকলেও আমরা নিজেকে কেন যেন চার দেয়ালে আবদ্ধ রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। আমরা এক কাচের দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। ওই দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসতে গেলে আমার ছোড়া ঢিলে ভেঙে যাওয়া কাচের দেয়ালের ভাঙা কাচের টুকরোয় আমারই প্রাণ সংহারের সম্ভাবনাও রয়েছে ভেবে আজ কাচের দেয়ালকে নিজের রক্ষাকর্তা বলে মানছি।

আমাদের এই মানসিকতার জন্ম দু-এক দিনে হয়নি। বছরের পর বছর পর গড়ে ওঠা অদৃশ্য ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণেই হয়তো আমরা এমন হয়ে গেছি। আমরা দেখেছি যারা পড়ালেখা না করে অর্থবিত্ত উপার্জন করেছেন তারা অতি সহজে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। বিপরীত দিকে যারা প্রকৃত জ্ঞানচর্চা করতে চেয়েছেন তারা কতভাবে নিগৃহীত-অবহেলিত-নিপীড়িত-লাঞ্ছিত হয়েছেন। আর দেখতে-জানতে গিয়েই হয়তো আমরা আর দেখতে-জানতে চাওয়ার পরিণতি জেনে নিজেকে কাচের দেয়ালে বন্দী করে রাখাকে শ্রেয় মনে করছি। কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশই সৃষ্টিশীলদের অনুকূলে নয়। অবশ্যই এ বিষয়টা নতুন কিছু নয়, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বহু বছর আগেই বলে গেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত সৃষ্টিশীল প্রতিভাবানদের পছন্দ করে না।’

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন, ‘উনিশশ আটত্রিশ সনে কবি জসীমউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। শিক্ষকতা করেন প্রায় পাঁচ বৎসর। সময়টা তাঁর ভাল যায়নি।’ শুধু কবি জসীমউদ্দীন নন; এমন হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে যারা সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছেন তারা প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সময়টা ভালোভাবে পার করতে পারেননি। অনেকে বাধ্য হয়েই চাকরি ছেড়ে দেওয়াকে শ্রেয় মনে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে একুশে পদক পাওয়া অধ্যাপক মো. মজিবর রহমান দেবদাস এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মেধাবী ছাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্রগতিশীল আন্দোলনে। পাকিস্তানিদের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্নে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্ত স্বদেশে তিনি স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার পাননি। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধা এই শিক্ষককে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। কেবল দেবদাস অথবা কবি জসীমউদ্দীন নন ঈশ্বরকণা তত্ত্বের জনক অধ্যাপক বোসসহ অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জীবনটা সুখের ছিল না। বহু খ্যাতিমান পণ্ডিতের জীবনেতিহাস পাঠে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কথার সত্যতা পেয়েছি বললে অত্যুক্তি হবে না। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশের সব সুযোগই এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভোগ করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা অবশ্যই ভিন্ন। আর এ ভিন্ন চিত্রের জন্য যতটা না দায় সরকারের, তার চেয়ে বেশি দায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের! ছাত্রদের!

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর