শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

খাঁটি অন্তরওয়ালা মানুষ বানিয়ে দেয় হজ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

খাঁটি অন্তরওয়ালা মানুষ বানিয়ে দেয় হজ

মরচে পড়া লোহা অনেকেই হয়তো দেখেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় মরচে পড়াকে বলে জং ধরা। লোহায় যখন জং ধরে, তখন তা কাজের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। জং ধরা লোহাকে আগুনে জ্বালিয়ে, বালিতে ঘষে, পানিতে চুবিয়ে জং ছাড়াতে হয়। মরচে কেটে গেলেই লোহা আবার কাজের উপযুক্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষের দেহেও মরচে পড়ে। মানে জং ধরে। তখন ব্যায়াম, দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ইত্যাদি শারীরিক পরিশ্রম করে দেহের জং ছাড়াতে হয়। নয়তো শরীর দিন দিন অকেজো হয়ে কঠিন ও জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। প্রিয় পাঠক! দেহের মতো মনেও জং ধরে। মরচে পড়ে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘লিকুল্লি শায়ইন সিকালাহ। ওয়া সিকালাতি কুলুবু জিকরুল্লাহ। প্রতিটি মেশিন সারানোর একটি যন্ত্র থাকে। তেমনি মনে যদি মরচে পরে সে মরচে কাটানোর যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই মনের মরচে দূর হয়ে চকচক করতে থাকে।

মনে যখন মরচে পড়ে তখন ভালো কাজ ভালো লাগে না। সুন্দর কিছু মনে ধরে না। ছুরিতে যেমন মরচে ধরলে ধার চলে যায়, কোনো কিছু কাটতে পারে না, তেমনি মনে মরচে পড়লেও মনের শক্তি কমে যায়, খারাপ ইচ্ছাকে ঠেকাতে পারে না। তখন শুধু খারাপ কাজই ভালো লাগে। একজন মানুষের জন্য এটা বড়ই ভয়াবহ সময়। মানুষ মাত্রই ভুল করবে। গোনাহ করবে। কিন্তু সে গোনাহকে যদি গোনাহই মনে না করে, তাহলে তো এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কিছুই নেই। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো আদম সন্তান যখন জন্ম নেয়, তখন তার অন্তরটা স্বচ্ছ আয়নার মতো থাকে। যখন সে গোনাহ করে, তখন ওই আয়নায় একটি কালো দাগ পড়ে। এভাবে দাগ পড়তে পড়তে একসময় আয়নাটা কালো কুচকুচে হয়ে যায়। তখন তার কাছে কালো কাজগুলোই ভালো মনে হয়। কেউ যদি ওই কালোর জগৎ থেকে আলোর জগতে বেরিয়ে আসতে চায়, তাহলে তাকে খাঁটিভাবে তওবা করতে হবে। গোনাহর জীবন থেকে ফিরে আসতে হবে। যখন সে গোনাহর জীবন থেকে ফিরে আসে, সঙ্গে সঙ্গে তার মনের আয়না আগের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়।’ মনের আয়না স্বচ্ছ করার অনেক উপায় আল্লাহ আমাদের বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি উপায় হলো হজ। হজের মাধ্যমে বান্দার জীবনের সব গোনাহ সাফ করে আল্লাহতায়ালা আবার তাকে স্বচ্ছ-সুন্দর অন্তরওয়ালা মানুষ বানিয়ে দেন।  আল্লাহ মাফ করবেন। এটাই আল্লাহর ভালো লাগে। তাইতো আল্লাহতায়ালা অধিকার খাটিয়ে বলছেন, ‘ওয়ালিল্লাহি আলান্নসি হিজ্জুল বাইতি মানিসতাতাআ ইলাইহি সাবিলা। মানুষের মধ্যে যারা আমার ঘরে আসার সামার্থ্য রাখে, তাদের অবশ্যই কর্তব্য তারা যেন আমার ঘরে এসে লাব্বাইক বলে যায়। এটা তাদের প্রভুর অধিকার।’ সুবহানাল্লাহ! যেন কোনো অভিমানী প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলেছে, ‘তুমি যখনই সুযোগ পাবে, অবশ্যই আমার সঙ্গে এসে দেখা করে যাবে। এটা আমার অধিকার। অথবা কোনো মমতাময়ী মা তার সন্তানকে বলছে, বাবা! তোকে দেখার জন্য নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার জন্য সবসময় আমার মনটা ছটফট করে। যখনই তোর সম্ভব হয়, আমার কাছে এসে একটু বসে যাবি। আমার মমতার বাগান থেকে মমতাফুল কুড়িয়ে নিবি।

আল্লাহ বান্দাকে হজ করতে বলেছেন, আল্লাহর জন্য না। বান্দারই জন্য। কারণ, হজের নির্দেশের শেষে আল্লাহ বলছেন, ‘ওয়ামান কাফারা ফাইন্নাল্লাহা গানিউন আনিল আলামিন। জেনে রেখ বান্দা! তুমি যদি আমার ঘরে এসে লাব্বাইক না বল, তাহলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জগতের কারও মুখাপেক্ষী নই।’ বরং হজ না করলে আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের কালো অন্তরকে সাদা করতে পারলাম না।

হে আমার প্রিয় পাঠক! রসুল (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, হজের মাধ্যমে বান্দার কালবের মরিচা দূর হয়। অন্তর সুন্দর হয়। জীবনের গোনাহগুলো হজের পানিতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, মান হাজ্জা লিল্লাহি, ফালাম ইয়াফাস ওয়ালাম ইয়াফসুক রাজাআ কাইয়াওমি ওয়ালাদাতহু উম্মুহু। কেউ যখন শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করবে, আর হজের সময় কোনো ধরনের অশ্লীলতা এবং পাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে না তাহলে হজ শেষে সে এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরবে যেন সে একজন সদ্য ভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ শিশু। (বোখারি।) আরেকটি হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, আল হাজ্জু মাবরুরুন লায়সা লাহু জাজাউন ইল্লাল জান্নাহ। আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হজের বিনিময় শুধুই জান্নাত, আর কিছু নয়। (মুসলিম)। আল্লাহ! আমাদের সবাইকে কোরআনে আঁকা হজ করে গোনাহমুক্ত স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষ হওয়ার তৌফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ

মুফাসসির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

 

সর্বশেষ খবর