শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

কোরবানি প্রসঙ্গ

মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবী

কোরবানি প্রসঙ্গ

কোরবানির সূচনা হয় মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এর যুগ থেকে। দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে হজরত আদম (আ.) তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের মানসে উভয়কে ইখলাসের সঙ্গে কোরবানি করার নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর মহান রাব্বুল আলামিন তাকওয়ার ভিত্তিতে হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন এবং কাবিলের কোরবানি প্রত্যাখ্যান করলেন। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে কোরবানির প্রচলন শুরু হয়। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, হে আমার হাবিব! আপনি তাদেরকে আদম-এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনা যথার্থরূপে পাঠ করে শুনিয়ে দিন; যখন তারা উভয়েই কোরবানি দিয়েছিল। অতঃপর তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপরজনের কোরবানি গৃহীত হয়নি। সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। তখন অপরজন বলল, আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের আমল কবুল করে থাকেন। (সূরা মায়িদা, আয়াত ২৭)।

পরবর্তীতে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) খোদাপ্রেমের নিদর্শন ও পরীক্ষা স্বরূপ মিনার প্রান্তরে তাঁর কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল (আ.) এর গলায় ছুরি চালিয়ে ত্যাগ ও ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। বিশ্বময় রচিত হলো কোরবানির নতুন ইতিহাস। এ ব্যাপারে দয়াময় আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ করেন, অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন পিতা ইবরাহিম (আ.) তাকে বললেন, হে আমার প্রিয় সন্তান! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, তোমাকে জবাই করছি; এ বিষয়ে তোমার অভিমত কী? ছেলে উত্তরে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে আপনি তা বাস্তবায়ন করুন। ইনশা আল্লাহ! আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং জবাই করার জন্য তাকে শায়িত করল তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নে যা দেখেছ তা সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে জবাই করার জন্য এক মহান জন্তু দান করলাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২)।

প্রিয় পাঠক! কোরবানি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত, ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত ও মহান স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনের এক বিশেষ মাধ্যম। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য শুধু পশু জবাই নয়, বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে খোদাভীতি ও প্রীতি অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। কোরবানির বিনিময়ে মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মুমিনের জন্য রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও অফুরন্ত প্রতিদান। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সূরা হজের ৩৭নং আয়াতে ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া তথা খোদাভীতি।

মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেন, আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। (সূরা কাওসার, আয়াত ০২)।

হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আরও রসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! এই কোরবানি কী? রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, এটা তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত। অতঃপর আবার জিজ্ঞাসা করা হলো, এই কোরবানির মধ্যে আমাদের জন্য কী প্রতিদান রয়েছে? রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করলেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে নেকি রয়েছে। (ইবনে মাজাহ)।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ঈদুল আজহার দিন মানুষের সব নেক আমলের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় আমল হলো- কোরবানি। কেয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল অবস্থায় হাজির হবে। নিশ্চয় কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের পবিত্রতা অর্জন কর এবং খুশি মনে আনন্দচিত্তে কোরবানি কর। (তিরমিজি)। প্রিয়নবী (সা.) আরও ইরশাদ করেন, তোমরা মোটা-তাজা পশু কোরবানি কর, কারণ তা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারি হবে। (কানযুল উম্মাল)।

তবে যারা সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, তাদের ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা.) কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে। (ইবনে মাজাহ)।

তাই ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে এবং ইবরাহিমি চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান স্রষ্টার নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আশায় কোরবানি করা প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুমিন মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব্ব। সম্মানিত পাঠক! সঠিক পদ্ধতিতে কোরবানি করার সুবিধার্থে এ সংক্রান্ত কিছু জরুরি মাসায়েল আপনাদের সমীপে উপস্থাপন করছি :

যে ব্যক্তি ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা এর সমপরিমাণ মূল্যের কোনো মালের মালিক হয়, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। ১০ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত কোরবানি করার নির্ধারিত সময়। তবে প্রথম দিন কোরবানি করা সর্বাপেক্ষা উত্তম, এরপর যথাক্রমে দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন। নাবালেগ, পাগল ও মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়; যদিও সে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়। উট, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এতদ্ব্যতীত হরিণ বা অন্যান্য হালাল বন্য পশুর দ্বারা কোরবানি জায়েজ নয়।

উট, মহিষ ও গরু এ তিন প্রকার প্রাণীর ক্ষেত্রে এক থেকে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ। তবে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এই তিন প্রকার প্রাণীর ক্ষেত্রে একের অধিক শরিক হয়ে কোরবানি করা জায়েজ নয়। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে এক বছর, গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর এবং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। একাধিক শরিক মিলে যদি একটি পশু কোরবানি করে, তবে এর গোশত অনুমান করে বণ্টন করা জায়েজ নয়। বরং পাল্লা দ্বারা মেপে সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। অন্যথায় কমবেশি হয়ে গেলে গুনাহগার হবে।

লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ, কাজলা (ভাঙ্গাপ্রেস), যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর