শুক্রবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ঈদুল আজহার শিক্ষা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ঈদুল আজহার শিক্ষা

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা কর এই কারণে যে, তিনি তোমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা হজ-৩৭) এখানে এ কথা বলা উদ্দেশ্য যে, কোরবানি একটি মহান ইবাদত। এই ইবাদতের মাকসাদ মনকে কোরবানি করে মহান রাব্বুল আলামিনের কোরব বা নৈকট্যতা হাসিল করা। কোরবানিদাতার নিয়তের ওপর নির্ভর করে তার কোরবানি কবুল হওয়া না হওয়া। যদি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করে তাহলে আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জিত হবে। আর যদি লোক দেখানোর নিয়তে কোরবানি করে থাকে তাহলে তার নিয়ত অনুযায়ী ফলাফল পাবে। পবিত্র কোরআনের আলোচ্য আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বান্দার নিয়তটাই মূলত কবুলের মাফকাঠি। আল্লাহর কাছে জানোয়ারের গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, আর পৌঁছবে বা কী করে কোরবানির উদ্দেশ্যতো এগুলো নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য হলো পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে পালনকর্তার আদেশ পালন করা। যেমনটি করে ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)। শুধু কোরবানি কেন সব ইবাদতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। নিয়তের ওপরই তামাম ফলাফল নির্ভর করে। যেমন, নামাজে ওঠা-বসা করা এবং রোজায় ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয়; বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই আসল লক্ষ্য। আন্তরিকতা ও মুহব্বত বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র। কিন্তু তামাম ইবাদতের মধ্যে শরিয়তসম্মত কাঠামোও এ কারণে জরুরি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার আদেশ পালনের জন্যে এই কাঠামো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। এই আনন্দ মুসলিম সমাজের। এ এক অনাবিল আনন্দ। যে আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। কারণ এ আনন্দ প্রেমময়, তাকওয়া অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্যতা হাসিলের। তাই তো এ ঈদ মুসলিম সমাজে ‘কোরবানির ঈদ’ নামে পরিচিত। যে ঈদে মনের কোরবানি হয়। আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জন হয়। এখানেও শরিয়তের সীমানা বজায় রেখে আনন্দ করতে হবে। এমন কোনো আনন্দ-উৎসব করা যাবে না। যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্যতা অর্জনের পরিবর্তে গজব প্রাপ্ত হতে হয়। প্রিয় পাঠক! পবিত্র আয়াতের প্রতি আরও লক্ষ্য করুন। একটি অবুঝ জানোয়ার সম্পূর্ণভাবে নিজেকে কোরবানি করার জন্য তৈরি করে দেয়। তার মধ্যে আনুগত্যতার এই গুণ কে দিয়েছেন? এক কথায় বলতে হবে আল্লাহ দিয়েছেন। এখান থেকে প্রতিটি মানবজাতির স্মরণ রাখতে হবে। আমার আল্লাহ আমার সব কিছুর মালিক। তার কাছে জীবনের সব কিছু অর্পণ করে দিতে হবে। দেখুন না! আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য কত সুন্দর সুন্দর বিধান রেখেছেন। যা প্রতিটি মানবজাতির জন্য অবশ্যই কল্যাণময়। তিনি মুসলিম জাতির আনন্দ প্রকাশ করার জন্য দিয়েছেন পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আমাদের মাঝে প্রতিটি বছর পবিত্র ঈদুল আজহা ঘুরে ঘুরে এসে মানুষকে মানবতা-ইনসানিয়াতের শিক্ষা দিয়ে যায়। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে দৃঢ় করার পত্র লিখে যায়। ঈদ মানবীয় সমাজকে ভালোবাসার গ্রন্থিতে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। ঈদ গোটা মানবজাতিকে একই বিশ্বাসের সুশীতল ছায়াতলে অভিন্ন পরিবারে রূপান্তরিত করতে চায়। আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে আমরা সবাই একই পিতার রুহানি সন্তান। ঈদ মানব সমাজকে সুন্দর-সুস্থ ও প্রেমময় একটি ইসলামী সমাজ উপহার দিতে চায়। ঈদ মানুষকে ঐক্য, একাত্মবাদ, সাম্য, সুখ-শান্তি, প্রেম-প্রীতি, ধৈর্য ও ক্ষমার কথা বলে যায়। ঈদ মানব সমাজ থেকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যুদ্ধ, ক্রোধ, বেহায়াপনা-বেলাল্লাপনা এবং অবাধ ভোগ বিলাসকে দূর দিতে চায়। ঈদের একমাত্র চাহিদা হলো আল্লাহর প্রেম এবং আল্লাহর সৃষ্টির মুহব্বত। ইসলাম ঈদকে আনন্দের দিন ঘোষণা করেছে। আনন্দের সঙ্গে জুড়িয়ে দিয়েছে সম্মিলিত ইবাদত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্তব্যের বাধ্যবাধকতা। বোঝা গেল ঈদ মানে মহা ত্যাগের উজ্জ্বল এক স্মারক। ঈদ মানে আল্লাহর মেহমানদারিতা গ্রহণ ও সম্মিলিত কণ্ঠে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। ধনি-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া। ধনী-গরিবের হাল-ফুর্তি করা। প্রিয় পাঠক! আমরা কি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি? আমাদের পরস্পরের মাঝে যদি কোনো কারণে ভেদাভেদ থেকে থাকে, তা আমরা এবারের ঈদে দূর করব। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যাব। নিজেদের মাঝে আনসার ও মুহাজেরদের মতো সত্যিকারার্থে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন চালু করব। হ্যাঁ ভাই! আমরা অবশ্যই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারি। গ্রামগঞ্জে, শহরে বন্দরে যারা যেখানেই বাস করি না কেন? ঈদে ধনী-গরিব সবারই খোঁজ খবর নিব। আমরা কি একটু চিন্তা করে দেখেছি? আমাদের সমাজে অনেকে এমন আছেন যারা অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে ঈদের দিন নতুন পোশাক পরিধান করতে পারে না, কোরবানি দিতে পারে না, আবার মুখ ফুটে কারও কাছে বলতেও পারে না। বিত্তবানদের ঘরে খাবার তৈরির ধুম পড়ে। দরিদ্র ঘরের জানালা দিয়ে হৃদয়ের ধোঁয়া বের করে এবং দরজা বন্ধ করে নীরবে নির্জনে অশ্রু ফেলে। বিত্তবানদের ঘরে বছরের প্রায় দিনই উন্নত খাবার তৈরি হয়, দরিদ্র ঘরে প্রায় দিন নিম্নমানের খাবার তৈরি হয়। অনেক দিন ওরা অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়ে দেয়। ছয় মাস ৯ মাসেও ওরা উন্নত খাবারের চেহারা দেখে না। এ ধরনের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ওদের এই করুণ পরিণতি আমাদেরও হতে পারে। কারণ সম্পদ মানুষের হাতে সকালে থাকে আবার বিকালে চলেও যেতে পারে এবং অনেক সময় চলেও যায়। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। তাই আমরা প্রত্যেকে অপরের খোঁজখবর নিয়ে সাধ্যানুযায়ী তাদের প্রয়োজন পুরা করব। যারা আল্লাহপাকের তাওফিকে কোরবানি দিতে পেরেছি নিজেদের পশুর একটি অংশ ওদের ঘরে পৌঁছে দেব। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যে বান্দা অপরের প্রয়োজন পুরা করে আল্লাহও তার প্রয়োজন পুরা করবেন। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

            লেখক : মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর