শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

রক্তাক্ত আগস্টের একাল-সেকাল-চিরকাল

গোলাম মাওলা রনি

রক্তাক্ত আগস্টের একাল-সেকাল-চিরকাল

ইদানীংকালে কেন জানি গুজব শব্দটি আমাদের দেশে অতিমাত্রায় জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। গুজবের কথা শুনলে আমার বারবার গজবের কথা মনে আসে। কেন মনে আসে তা বলার আগে গুজব ও গজব সম্পর্কে আমি যা জানি তা আপনাদের বলতে চাই। গুজব হলো একটি বিশেষায়িত ডাহা মিথ্যা কথা। সাধারণ মিথ্যার সঙ্গে গুজবের রয়েছে অনেক মৌলিক পার্থক্য।  ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি, অভিলাষ বা অভ্যাসের কারণে মানুষ অহরহ মিথ্যা বলে। অন্যদিকে, গুজবের পরিধি সব সময়ই সাধারণ মিথ্যার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি হয়। মানুষ যখন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা, কাম-ক্রোধ, হিংসা-দ্বেষ ইত্যাদির ব্যাপ্তি সমাজ-সংসার রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চায় এবং মিথ্যাকে অনাগত দিনের ইতিহাসে পরিণত করতে চায় তখন সে গুজব রচনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

সব ধর্ম মতে, মিথ্যাকে গুরুতর অপরাধ তথা পাপাচার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামে মিথ্যাকে সব গুনাহের মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অন্যদিকে, গুজব সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট এবং বিস্তৃত। গুজবের প্রধানতম প্রতিক্রিয়া হলো ফিতনা যার সম্পর্কে ইসলাম বলেছে ফিতনা হত্যাকাণ্ডের চেয়ে জঘন্য। ফিতনার কারণে মানুষ মজলুম হয়ে পড়ে এবং আশ্রয়ের জন্য আকাশের পানে হাত তোলে। মজলুমের দোয়া আল্লাহ সব সময় কবুল করেন এবং ফিতনা সৃষ্টিকারীকে গজবের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলকভাবে পাকড়াও করেন। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কখন এবং কেন ফেতনা সৃষ্টিকারী গুজবের আশ্রয় নেয়। আলোচনার শুরুতেই বলেছি, ফিতনাকারীর ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা ইত্যাদি যখন সব কিছুকে গ্রাস করার লক্ষ্যে তিনকালে অর্থাৎ অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কালকে উপলক্ষ করে পরিচালিত হয় তখনই সে গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। দ্বিতীয়ত, মানুষ যখন তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে শক্তিমত্তা, কর্মনিষ্ঠা, জনপ্রিয়তার মাপকাঠি, গ্রহণযোগ্যতা এবং সত্যনিষ্ঠায় পেরে ওঠে না তখনই সে গুজবকে হাতিয়ার বানিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করে।

মানুষের চিরায়ত স্বভাবমতো তারা সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ায় রাজনীতির ময়দানের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এবং যৌবনবতী অপরূপ সুন্দরীদের বিরুদ্ধে। দুটো ক্ষেত্রেই ক্ষমতা, অধিকার এবং ঈর্ষা প্রবলভাবে মানুষকে গুজব ছড়ানোর জন্য প্রলুব্ধ করে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে গুজব যে কত বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বড় বড় নৃশংস ও জঘন্যতম ফেতনা সৃষ্টি করেছে তা আমরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত রক্তাক্ত অধ্যায় পর্যালোচনা করলেই পেয়ে যাব। আমরা যদি ঘটনার সাদামাটা একটি বর্ণনা দাঁড় করাই তবে দেখতে পাব যে, বাঙালি জাতির জনককে সপরিবারে অন্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। খুনের পেছনে রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগ এবং ক্রোধকে দায়ী করে থাকেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বিদেশি মদদ, চক্রান্ত এবং প্রভাবকেও দায়ী করেন। কিন্তু ১৫               আগস্টের নেপথ্যের কাহিনী এবং আমাদের জাতীয় জীবনে সে রাতে নিহতদের রক্ত কর্তৃক সৃষ্ট বিপর্যয় নিয়ে কেউ খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না।

আজকের আলোচনায় আসি ১৯৭৫ সালের নির্মম ঘটনার নেপথ্যে যেসব গুজব ফেতনা সৃষ্টি করেছিল যার পরিণতিতে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল— তার কারণ, প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া সাধ্যমতো বর্ণনা করার চেষ্টা করব। ১৯৭৫ সালের ঘটনা বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই স্বাধীনতা-পূর্ববতী পূর্ববাংলার রাজনীতি, আওয়ামী লীগের উত্থান এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অভিষেক সম্পর্কে কিছু বলা আবশ্যক। বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রথম সমস্যা ছিল তার নিজ দলের মধ্যে তার চারপাশ ঘিরে থাকা ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, রাজনৈতিক সহচর এবং আত্মীয়স্বজন। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে তিনি যেবার প্রথম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সেবার অন্তত আধাডজন নেতাকে তার শত্রু বানিয়ে ফেললেন। এরপর তিনি সেই শত্রুদের মধ্য থেকে অন্তত দুজনকে নিজের ডান হাত-বাম হাত বানিয়ে তার ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন দলটির সভাপতি মনোনীত হলেন তখন আরেক দফা কিছু রাজনৈতিক শত্রু সৃষ্টি করে ফেললেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় তিনি যখন অবিসংবাদিত জাতীয় নেতায় পরিণত হলেন তখন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দেশের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনে অসংখ্য ঈর্ষাকারী পয়দা হয়ে গেল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ফলে তিনি জয়ী হলেন বটে কিন্তু পূর্ববাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিতে মিত্রহীন হয়ে পড়লেন। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষবৃন্দ হঠাৎ করেই ঈর্ষা-হিংসা ও দ্বেষের বশবর্তী হয়ে তার শত্রুতে পরিণত হলো। তারা বিভিন্ন গুজবের জন্ম দিয়ে এমন ফেতনা সৃষ্টি করে দিল যার পরিণতিতে সারা পূর্ববঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠল। রাজনীতি তখন আর কারও হাতে রইল না। পুরো ঘটনা চলে গেল নিয়তির হাতে যার অমোঘ নিয়মে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। বঙ্গবন্ধু বিরোধীদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধ করলেন বটে কিন্তু যুদ্ধশিবিরেও নানামুখী গুজবের জন্ম দিলেন, যা যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন হতাহতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে বহু দল ও উপদলের সৃষ্টি হলো। যুদ্ধপূর্ব সময়ে পাকিস্তানিদের শোষণ, জুলুম, নির্যাতন এবং যুদ্ধকালীন হানাদারদের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড আরও নির্মম হয়ে উঠল গুজবকারীর কারণে।

স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেন। তার জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব ও বাগ্মিতার কাছে ঘেঁষতে পারেন এমন ব্যক্তিত্ব তখন বাংলাদেশে ছিল না। কিন্তু তার প্রতি অকারণ ঈর্ষাকারী তার কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ সত্ত্বেও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাকারী এবং তার অধীন থেকেও গোপন অবাধ্যতাকারীদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। দিন যত যাচ্ছিল ততই এদের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ছিল হু হু করে। তারা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, দিনে-রাতে, অবসরে-বিনোদনে এবং আহারে-বিহারে সমানতালে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার, তার দল এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে যুগপত্ভাবে গুজব ছড়াতে আরম্ভ করেন। আমি অবশ্যই এ কথা বলব না যে, বঙ্গবন্ধু সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল না। কিংবা দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কোনো অন্যায় করেনি অথবা ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে ছিলেন। আমি বরং নির্দ্বিধায় এ কথা বলব, একটি নতুন রাষ্ট্র এবং এককভাবে সেই রাষ্ট্র পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাহীন একটি রাজনৈতিক দল এবং পিতার গুণাবলি সংবলিত এক বিশাল হৃদয়ের মহাপুরুষ ‘পাওয়ার সিনড্রমের’ কবলে পড়ে সচরাচর যেসব ভুল করেন সেসব ভুলই অহরহ হচ্ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পঁচাত্তর-পূর্ববতী সরকারে। বঙ্গবন্ধু সরকারের ভুলগুলো ছিল খুবই গতানুগতিক যা ইতিপূর্বে সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী দেশগুলোতে সচরাচর কম-বেশি ঘটেছিল। কিন্তু তার বিরোধী গ্রুপগুলো যা করেছিল তার নজির কোনো দেশে সচরাচর ঘটেনি। দেশের শিক্ষিতজন ও বুদ্ধিজীবীগণ প্রকাশ্যে নানা রকম অপমানজনক মর্যাদাহানিকর, বিভ্রান্তিকর এবং ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলে এবং লিখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে জনসম্মুখে হেয় করার পাশাপাশি তাদের হতোদ্যম অথবা উত্তেজিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা অবিরতভাবে করতে থাকেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কালোবাজারি, অবৈধ মজুদ ও পাচারের মতো ঘটনা সুকৌশলে নিজেরা ঘটিয়ে সরকারি দল নেতাদের বিরুদ্ধে বহুমুখী গুজব ছড়াতে থাকে। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা একত্র হয়ে গুজবের ত্রিবেনী সঙ্গম সৃষ্টি করে ফেলে এবং ত্রিমাত্রিক উপায়ে গুজব ছড়াতে থাকেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী গুজব রটনাকারীরা মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে পুরো পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে ও মেঘাচ্ছন্ন করে ফেলেন যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে একজন অপরজনকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। গুজবের কারণে সত্য উধাও হয়ে গিয়েছিল এবং মানুষের বিচারশক্তি, রুচিবোধ এবং বিবেক ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। তারা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য যেমন করতে পারত না তেমনি সর্বক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সন্দেহপ্রবণতা, অবিশ্বাস এবং কানকথা শোনার অভ্যাস তাদের পেয়ে বসেছিল। তা না হলে একটি প্রথম শ্রেণির শীর্ষ পত্রিকায় কী করে বাসন্তীর জাল পরা ছবি ছাপা হলো এবং সে কথা বিশ্বাস করে সারা দেশের মানুষ একই সঙ্গে হৈ হৈ রৈ রৈ করে উঠল। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের আগেই চক্রান্তকারীরা পুরো দেশকে গুজবের চাদরে ঢেকে দিয়েছিল। পত্রপত্রিকা যখন অবাধ ছিল তখন জাসদ গণকণ্ঠ নামক একটি দৈনিক পত্রিকা বের করত, যার সম্পাদক ছিলেন কবি আল মাহমুদ। বাংলাদেশের ইতিহাসে হলুদ সাংবাদিকতা কাকে বলে এবং তা কত প্রকার ও কি কি তা হাতেকলমে এবং নাকে-চোখে-কানে সুঁই ঢুকিয়ে জাসদের গণকণ্ঠ আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আজকে যেসব সংবাদ মাধ্যম অথবা সামাজিক মাধ্যমের বিরুদ্ধে গুজবের অভিযোগ উত্থাপিত হয় তাদের অপরাধকে যদি গণকণ্ঠের সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে তিন যুগের কর্মকাণ্ড নিতান্ত শিশুসুলভ বালখিল্য বলা হবে। গণকণ্ঠ সত্যের মতো করে নির্ভুলভাবে মিথ্যা উচ্চারণ করে যেত সব লজ্জা-শরম ও মানবিকতার মাথা খেয়ে। বাংলাদেশের সব বঙ্গবন্ধুবিরোধী সম্মিলিতভাবে তাঁর যে ক্ষতি করতে পেরেছিল তার চেয়ে বহু বহু গুণ ক্ষতি করেছিল জাসদের গণকণ্ঠ।

পঁচাত্তরের গুজব রচনাকারীরা অভিনব উপায়ে তাদের অপকর্মকে রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ফেলেছিল। তারা প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের হাত করে নিয়েছিল যারা চক্রান্তকারীদের হাতিয়ার রূপে রাজপথে উল্লম্ফন করত। এ শ্রেণির রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুকে প্রকাশ্যে মুদ্রণ অযোগ্য কদর্য ভাষা প্রয়োগ করে গালিগালাজ করত, যাতে জনগণের মনের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে যে সম্ভ্রম ও মর্যাদাবোধ রয়েছে তা মুছে যায়। এসব রাজনীতিবিদ দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিক, টাউট-বাটপার যেনাকারী-ব্যভিচারী-ধর্ষণকারীদের যোগসাজশে এক ত্রিশঙ্কু মৃত্যুফাঁদে সরকারকে আটকে ফেলে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সদা ঘটমান সিঁধেল চুরি ও ডাকাতির ঘটনার সঙ্গেও আওয়ামী লীগ এবং সরকারের ঘনিষ্ঠজনদের সংযোগ রয়েছে বা তাদের মদদেই সব অপকর্ম হচ্ছে এমন গুজবে সারা দেশের আকাশ-বাতাস ভারী করে চক্রান্তকারীরা মানুষের মনমানসিকতা এমন করে তুলেছিল যে প্রতিদিন নিত্যনতুন গুজব না শুনলে তাদের ভালো লাগত না। নিত্যকার খাবার-দাবার, বিশ্রাম-নিদ্রা এবং প্রকৃতির পাক-পাখালির হাঁকডাকের মতো গুজবও তখনকার দিনের বেশির ভাগ মানুষের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল।

গুজবকে মোকাবিলা করার জন্য যে ধৈর্যের দরকার ছিল তা হয়তো সরকারের মধ্যে পুরোপুরি ছিল না ফলে গুজবকারীরা দারুণভাবে সফল হতে শুরু করেন। তারা ১৯৭৪ সালের মধ্যেই নিজেদের সফলতার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন এবং পঁচাত্তর সালে এসে একেবারে চুপচাপ হয়ে পড়েন। কারণ তারা বেশ ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, বিগত দিনে তাদের কর্মকাণ্ড এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া এমন একটি পরিণতি অপরিহার্য করে তুলেছে যা পরিহার করা বা যার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সহজসাধ্য এবং শান্তিপূর্ণ পথ তখন কারোর জন্যই খোলা ছিল না।

শুরুর দিককার কিছু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ভুল, রাগ-অভিমান, ইগো এবং সেগুলোকে অনুসরণ করে শক্তি প্রয়োগ এবং সুবিধাভোগীদের দম্ভ যে কত বড় রক্তাক্ত পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার নির্মম উদাহরণ ১৫ আগস্ট। গুজব সৃষ্টির রাস্তা করে দিলে তা শেষ পর্যন্ত কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটিও আমরা রক্তাক্ত আগস্টের মধ্যে দেখতে পাই। মানুষ তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে কতটা নৃশংস হতে পারে তা আমরা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের রক্তের ইতিহাসের মধ্যে দেখতে পাই। গুজবকারীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত এবং তাদের সর্বশেষ পরিণতিও আমরা সেই ইতিহাসের মধ্যেই খুঁজে পাই। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিটি আগস্ট মাসে কিছু মানুষের উল্লাস এবং বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্রন্দনের মধ্যে আমরা আমাদের ঐতিহাসিক জাতীয় কলঙ্ক এবং বেদনার স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আমাদের কাছে জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে তার পরলোকগত জীবন বেশি শক্তিশালী, মাধুর্যময় ও অনুপম বলে মনে হতে থাকে।

আগস্ট মাসের রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের জাতীয় মানমর্যাদাকে নিদারুণভাবে কলঙ্কিত করেছে। আমাদের জাতীয় চরিত্রকে নষ্ট করে দিয়েছে। গণতন্ত্র, রাজনীতি এবং জাতীয় উন্নয়ন দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাজনীতিবিদদের। যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে রাজনীতিবিদদের অপমান করার সুযোগ পায়। ১৫ আগস্টের কারণে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদটির মর্যাদা এবং আকর্ষণ যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি ওই পদে আসীন সবাইকে একাল-সেকাল এবং চিরকাল বঙ্গবন্ধুর রক্ত তাড়া করেছে, করছে এবং করবে।  ফলে  ওই পদে আসীন যে কেউই ’৭৪-৭৫ স্টাইলের কোনো গুজব দেখতে পেলে আতঙ্কিতবোধ করবেন এটা যেমন স্বাভাবিক,  তেমনি সব গুজবের পূর্বাপর প্রতিক্রিয়াও স্বাভাবিক।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর