শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সময় এখন গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার ধরার

শাইখ সিরাজ

সময় এখন গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার ধরার

আর কদিন বাদেই ঈদুল আজহা। দেশের গরুর হাটগুলোতে চলছে কোরবানির পশুর শেষ মুহূর্তের কেনাবেচা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে কোরবানির বাজারে উঠছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার পশু। এ ছাড়া দেশি গরু মোটাতাজাকরণের সংখ্যাও অন্যবারের চেয়ে এবার কয়েক লাখ বেশি। কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে এবার ৪৪ লাখ ৫৭ হাজার গরু ও মহিষ এবং  ৭১ লাখ ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে সারা দেশে ৫ কোটি ৩৬ লাখ ৫৪ হাজার গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ১৫ লাখ ১৭ হাজার কোরবানির উপযোগী। সব মিলিয়ে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৭ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু এবার বিকিকিনি হচ্ছে। দেশের প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একাধিক হাটের পাশাপাশি অনলাইনে গরু বেচাকেনার প্রসার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গত বছর কোরবানিতে জবাই হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার পশু। এবার চাহিদার তুলনায় জোগান রয়েছে বেশি। কোরবানির জন্য এখন আর ভারত থেকে গরু আনার প্রয়োজন নেই। এটা বেশ আশার কথা। কোরবানিকে সামনে রেখে ছয় মাসের বাণিজ্যে লাভবান হওয়ার কারণেই সারা দেশে উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন গরু মোটাতাজাকরণ খামার।

কোরবানি ছাড়াও সারা বছরের গরুর মাংসের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে দেশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ৭২.১৪ লাখ মেট্রিক টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হচ্ছে ৭২.৬০ লাখ মেট্রিক টন। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ফেলার পর এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক বাজার ধরার। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চ দাবি করছে, ২০২০ সালের মাঝে গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার গিয়ে দাঁড়াবে ২ হাজার ১৫১ বিলিয়ন ডলারের। গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজারে শীর্ষে ব্রাজিল ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পাশাপাশি রয়েছে। ক্রম বিকাশমান এই বাজারে প্রবেশের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে নিরাপদ গো মাংসের। নিরাপদ মাংসের জন্য চাই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরু লালন-পালন। সে ব্যাপারে আমাদের খামারিদের সচেতন করতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে শিক্ষিত কিছু তরুণ এ ব্যাপারে স্বপ্ন বুনছে। সে রকম এক তরুণ উদ্যোক্তা নরসিংদীর শিবপুরের কিবরিয়া গাজী। তার লক্ষ্য একদিন তার গরুর মাংস যাবে দেশের বাইরের বাজারে। তরুণ উদ্যোক্তা কিবরিয়া গাজী কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দুই বছর ধরে গরু মোটাতাজাকরণ করছে। এবারও শতাধিক গরু বাজারে পাঠাচ্ছে এই তরুণ উদ্যোক্তা। সম্পূর্ণ দেশীয় উপায়ে গরু মোটাতাজা করছেন তিনি। পরিকল্পিতভাবে গরু মোটাতাজাকরণের অনুশীলনটি এদেশে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রচলিত। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরু মোটাতাজাকরণের দেশীয় নতুন কিছু পদ্ধতি তুলে ধরেছিলাম। সাম্প্রতিক সময়ে এসে গরু মোটাতাজাকরণে নানা অসাধু উপায় অবলম্বন শুরু করেন একশ্রেণির মুনাফালোভী। তারা নানারকমের গ্রোথ হরমোন ও স্টেরয়েডের ব্যবহার শুরু করে। এ কারণে কয়েক বছর ধরে ভোক্তাদের মধ্যে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। খামারিরাও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত বছর থেকেই গ্রোথ হরমোন ও স্টেরয়েডের ব্যবহার অনেকটাই কমতে শুরু করেছে। এখন খামারিরা যথেষ্টই সচেতন। একই সঙ্গে সচেতন ক্রেতা বা ভোক্তারাও। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত বছর গাজীপুরের কোনাবাড়ির হাজী মনছুর আলীর গরু ও খামার নিয়ে প্রতিবেদন দেখিয়েছিলাম। যার উদ্দেশ্য ছিল মুনাফার পাশাপাশি কোরবানির পবিত্রতা রক্ষার জন্য গ্রাহকদের মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে লালন-পালন করা গরু সরবরাহের। যাই হোক, বলছিলাম শিবপুরের কিবরিয়া গাজীর কথা। দৃঢ় মনোবলের এই উদ্যোক্তার স্বপ্নটা অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও বর্তমানে তিনি রয়েছেন স্বপ্নপথের একেবারে প্রারম্ভে। একশ গরু নিয়ে শুরু করেছেন তার পথচলা। গত দুই বছরে তিল তিল করে সাজিয়ে এনেছেন তার গরুর খামার। খামারে বড় দুটি শেডে পালন করছেন দেশি ও বিদেশি গরু। একদিন ঘুরে এলাম তার গরুর খামার থেকে।

গরু মোটাতাজাকরণের ধরনটি তার একেবারে আলাদা। না, দ্রুত মোটাতাজাকরণের কোনো চেষ্টা তার নেই। প্রয়োজনে কয়েক বছর সময় নিয়ে গরু বড় করার কথা বলেছেন এই উদ্যোক্তা। মোটকথা গরুকে দ্রুত ওজন বাড়ানোর তাগিদ নেই, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়েই বড় করে ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য তার।

কিবরিয়া জানালেন, সম্পূর্ণ দেশীয় পদ্ধতিতে লালন-পালন করছেন তার গরুগুলোকে। এ বছরের কোরবানিকে উদ্দেশ্য করে ১০০টি গরু তিনি লালন-পালন করছেন। গরুকে খেতে দেন সম্পূর্ণ নিজের হাতে তৈরি সুষম খাবার। পনের বিঘা জমিতে চাষ করেছেন নেপিয়ার পাকচং ঘাস। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তার খামারটি। উপরে টিন থাকলেও নিচে হিট ট্রান্সফারের মেইনটেইন এর জন্য ইনসল্যুউশন ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে অতিরক্তি গরমে গরুর ক্ষতি না হয়। মোটকথা বায়োসিকিউরিটির ব্যাপারে বেশ সচেতন কিবরিয়া।

কিবরিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার লাভের হিসাব সম্পর্কে। প্রত্যয়ী এই তরুণ হিসাব কষে দেখিয়ে দিল লাভের অঙ্ক। ১০০টি গরুর জন্য সারা বছরে তার মোট খরচ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এখানে গরুর দাম, খাবার খরচ, শ্রমিকের বেতন সবকিছুই যুক্ত আছে। গরুপ্রতি তার লাভ থাকছে ৩৫-৪০ হাজার টাকা। তার মানে এক বছরে সে লাভ গুনছে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।

কিবরিয়া গাজীর খামারের অধিকাংশ গরুই ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। বাকিগুলোও আগামী দুই দিনে বিক্রি হয়ে যাবে বলে আশা করছেন। খামারের গরু ঈদের আগের দিন কিংবা ঈদের দিন সকালে ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া হবে। আর বেশিরভাগ কেনাবেচা হচ্ছে অনলাইনে। তিনি জানালেন, প্রবাসীরাই বেশি কিনছে তার খামারের গরু। আমেরিকা, লন্ডন, কানাডা থেকে ফোন আসে তার কাছে। অনলাইনে ছবি/ভিডিও দেখিয়ে বিক্রি করছেন গরু। বেশ ভালোই বাজার পাচ্ছেন কিবরিয়া।

বাজার যাই থাক কিবরিয়া গাজীর গরুর মোটাতাজাকরণের ধরন ও ব্যবসায়িক সততা অনেক ক্রেতার কাছে প্রতিষ্ঠিত। অনেকে বহু আগেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ধর্মীয় রীতিনীতি আর ব্যবসায়িক ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা থাকে তার। কিবরিয়া গাজী খামার এলাকার বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে এলাকার তরুণরা এই খামার দেখে গত কয়েক বছরে গরু মোটাতাজাকরণের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তবে তাদের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গরু আমদানি নীতিমালা। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদের এ খাতটি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন কিবরিয়া গাজী।

কিবরিয়া গাজীর মতো তরুণরাই একদিন এ দেশকে পাল্টে দেবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ওদের উদ্যোগকে বেগবান করতে পারলে গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক বাজার ধরাটা খুব একটা কঠিন হবে না। কিবরিয়া গাজীর মতো তরুণদের স্বপ্ন পূরণ অসম্ভব কিছু নয়।

ঈদ আমাদের সামনে যেমন আনন্দের, একইভাবে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। ঈদের পশু কোরবানি মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব। এখানে বিশুদ্ধতা, পবিত্রতা ও পরোপকারী মনোভাব যেমন জরুরি একইভাবে জরুরি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য খামারিদের পাশাপাশি সব মহলের আন্তরিকতা। কোরবানিকে সামনে রেখে বিশুদ্ধ উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণের যে উৎসাহ খামারিদের তৈরি হয়েছে, খামারিদের এই উৎসাহ ধরে রাখতে হবে।  ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ খাতের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে সরকারিসহ সব মহল আন্তরিক পদক্ষেপ রাখবে, এই প্রত্যাশা।  সবাইকে ঈদ মোবারক।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর