শিরোনাম
রবিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিতর্কিতদের বাদ দিতে হবে

নঈম নিজাম

বিতর্কিতদের বাদ দিতে হবে

জোয়ারের পর ভাটা থাকে। সব সময় সমুদ্রের স্রোত একরকম থাকে মনে করার কোনো কারণ নেই। মেঘে মেঘে বেলা চলে যায়। সাঁঝবেলায় ঘরে ফিরতে হয়। জীবন এক বহতা নদী। একসময় ঢাকায় জমিদারদের দাপট ছিল। সবকিছুর নিয়ন্ত্রক তারাই ছিলেন। এখন তাদের পরিবার-পরিজন কোথায় আমরা খোঁজও রাখি না। সর্বশেষ নবাব পরিবারের এক সন্তান খাজা হাবিব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হয়েছিলেন। আর বেগম শামসুন নাহার খাজা আহসান উল্লাহ বিএনপি থেকে হয়েছিলেন এমপি। এরশাদ আমলের শুরুর সময় মেজর মুন্নার কথা কারও মনে আছে কি? মুন্না ও জাহাঙ্গীর প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়ে। জেনারেল চিশতির নেতৃত্বে এরশাদের সঙ্গে কাজ করতেন তারা। ’৮২ সালে সামরিক শাসন জারির পর অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদকে মন্ত্রী করতেন এই মুন্না। তাকে সবাই সমীহ করতেন। এরশাদ আমলে ঢাকা ক্লাবে মুন্না প্রবেশ করলে সবাই তাকে ঘিরে রাখতেন। সেই মুন্না এখন কোথায়? কেউ কি তার খোঁজ নেন? তিনি সুস্থ না অসুস্থ? মানবজীবন বড় অদ্ভুত। আমরা সব সময় ক্ষমতাকে সমীহ করি। ওয়ান-ইলেভেনের পর ব্রিগেডিয়ার বারী ও আমীনের প্রভাব দেশবাসী দেখেছে। তারা এখন কোথায়? কেউ খোঁজও নেন না। মইন উ আহমেদকে নিয়েও কারও মাথাব্যথা নেই। জেনারেল মইন ও জেনারেল মাসুদ তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আপা ডাকতেন। সাঈদ ইস্কান্দারের বন্ধু হিসেবে তাদের প্রভাব ছিল। তারেক রহমান ছিলেন তাদের ভাগনে। বিভিন্ন সময় এমন অনেক দাপুটে মানুষের আনাগোনা আমরা দেখেছি। মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মি নিয়মিত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যেতেন। বেগম মুজিব তাদের টেবিলে খাবার দিতেন। পরবর্তী ইতিহাসের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার খবর আমরা জানি। আজকাল কিছু মানুষের অতি চাটুকারিতা দেখে মাঝে মাঝে ভয় হয়। সবার সঠিক দায়িত্বটুকু পালন জরুরি। চাটুকারিতা আর বাড়াবাড়ি ভালো নয়। এর পরিণামও ভালো হয় না। বাড়াবাড়ি না করেও সফলভাবে কাজ করা যায়। কামরুল ইসলাম সিদ্দিককে কাছ থেকে দেখেছি। তার মতো দক্ষ, সৎ, সফল প্রশাসক আমার চোখে আজ অবধি আর কাউকে পাইনি। একাত্তরে যুদ্ধ করার দেশপ্রেম লুকিয়ে রেখেছিলেন হৃদয়ের গহিনে। সেই প্রেম বেরিয়ে আসে এলজিইডিকে নিয়ে সারা দেশে উন্নয়নযুদ্ধ শুরু করার পর। তিনি সফল ছিলেন এলজিইডি, পিডিবি ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ে। দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন করে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। একজন সরকারি কর্মকর্তার কাজ এমনই হওয়া দরকার।

টানা ক্ষমতায় থাকার নেতিবাচক অনেক প্রভাব পড়ে দল ও সরকারে। সুবিধাবাদীরা নিজেদের আখের গোছাতে অনেক সর্বনাশ করে ফেলে; যার মেরামত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এখন কিছু আমলা-কামলা হাইব্রিড মনে করে তারা সবাইকে শাসন করবে। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, যখন তখন হুমকি-ধমকি দেবে। ভুল। ইতিহাসের দিকে তাদের চোখ নেই। অথবা তারা ইতিহাস জানে না। বুঝতে হবে ইতিহাস তার আপন মহিমায় চলে। আমলা-কামলাদের ভাবে অথবা অতিবাড়াবাড়িতে কারও কিছু যায় আসে না। তাদের নিয়ে মানুষ ভাবে না। সংকটের সমাধান রাজনীতিবিদদের করতে হয়। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষের বেলায় শেষ ভরসা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি এখনো সব সংকটেরই মোকাবিলা করেন। সবাইকে নিয়েই চলেন। তার কাছ থেকে শেখেন। তার থেকে শিখতে না পারলে আপনাদের আগামী অন্ধকার। পদ থেকে ছিটকে পড়লে একবার আপনাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভেবে রাখুন। তাহলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে না। অন্যথায় ঝামেলা বাড়তেই থাকবে। আগামী হবে অন্ধকার। মনে রাখা দরকার সবারই, এই দিন দিন না আরও দিন আছে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। বেলা শেষে সবাইকে ঘরে ফিরতে হবে। পরিবেশটা নষ্ট করবেন না আপনারা কিছু মানুষ। আপনাদের কারণে অশান্তির অনল তৈরি হচ্ছে। ঘরে বাইরে সমস্যা বাড়ছে। বিভেদ-বিভাজন হচ্ছে সদরে-অন্দরে। এক জীবনে অনেক দেখেছি। ’৭৬ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ মানুষের ভয় কাটাতে প্রথম কবিতা পড়েন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তিনি কাজটি করেন ভালোবাসা থেকে। এই ভালোবাসা তার দুর্বলতা নয়। কারও কাছে ভালো না লাগতে পারে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীই প্রথম ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ, লিয়াকত হোসেন বেইজ্জত হয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়লেও ’৭৫ সালের পর তাদের অবদান ছিল। সেই অবদানকে এখন খাটো করা যাবে না। পুরাতন সেই ইতিহাস অনেকের অজানা। দুনিয়ায় চাওয়া-পাওয়ার হিসাব অনেক আছে। এই হিসাবে একবার ভুল হলে সমস্যা। মানবজীবন অনেক ছোট। আজ আছি কাল নেই। আমরা চলে যাওয়ার পর সব থাকবে। কিন্তু আমি থাকব না। তখন কে আমার প্রশংসা করল আর বিরোধিতা করল কী যায় আসে। এ জীবন আমি বার বার ফিরে পাব না। ’৯১ সালের আগে কাজী শাহেদ আহমেদ আমাদের বলতেন, সাহস করে ঘুরে দাঁড়াও দেখবে তুমিই বাঘ। কোটা, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে মুক্তি দিন। তাদের কাছে টেনে নিতে হবে। ওদের বোঝাতে হবে এই দেশটা কে আমাদের দিয়ে গেছেন। আজ এই দেশের নেতৃত্বে সেই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রতিনিয়ত লড়ছেন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য। রাতদিন ২৪ ঘণ্টা তিনি শ্রম-মেধা ব্যয় করেন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে। সুন্দর আগামীর জন্য তাকেই দরকার। তোমরা যে বাংলাদেশ চাও তা শেখ হাসিনাই দিতে পারেন। সবাই সব কাজ করতে পারে না। ছোট্ট একটা জীবন। এক জীবনে এত ঝামেলার কী দরকার? আমাদের প্রিয় দুজন সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেন চলে গেলেন। মিডিয়ায় তাদের শূন্যতা আর পূরণ হবে না। বাকি দু-চার জন মানুষ আছেন, তারা চলে গেলে কী হবে জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, গভীর শূন্যতা তৈরি হবে মিডিয়ায়। আমার একজন নেতা ছিলেন নাম জয়নাল আবেদীন ভূইয়া। তার দরজা দলমতনির্বিশেষে সবার জন্য খোলা ছিল। ২০০১ সালের পর জামায়াত-বিএনপির তাণ্ডবের রেশ নাঙ্গলকোটেও পড়ে। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কর্মী নিহত এবং শতাধিক আহত হন। অনেকের হাতের কব্জি কেটে নেওয়া হয়। মামলা-মোকদ্দমার শেষ ছিল না। সেসব ভয়াবহ দৃশ্য জয়নাল ভাইকে বিচলিত করত। তিনি সন্ধ্যা হলেই আমাকে ডাকতেন। আমার কাছে আসতেন। আমিও যেতাম। একদিন বললাম, আপনি বিএনপি-জামায়াত সবার উপকার করলেন ক্ষমতায় থাকার সময়। এখন দেখলেন ওরা কী করল? তিনি বললেন, এমনটা হবে ভাবিনি। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে কাজ করতাম মানুষের জন্য। কে কোন দল তা ভাবনায় কখনো আনিনি। জয়নাল ভাইয়ের কথা প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। মানুষের মাঝে সহনশীলতা উঠে যাচ্ছে। মানুষ আর আগের মতো নেই। একটি হিংসা আরেকটি প্রতিহিংসা তৈরি করে। এ অবস্থা দেখতে চাই না। সহনশীলতা চাই সবার মাঝে। জীবনের সব যোগফল মিলবে না। তাই বলে থেমে থাকা চলবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এই এগিয়ে চলাকে ধরে রাখতে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রের কতগুলো বিষয় নিয়ে আপস হবে না। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হবে। আদর্শিক লড়াই সব সময় ছিল, থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। আমাদের ইনস্টিটিউটগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে রক্ষা করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখতে অতিকথক ও চাটুকারদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের এড়িয়ে চলতে হবে। আমাকে একজন বললেন, আপনি কী নিয়ে আতঙ্কিত? আমি বললাম, কোনো কিছু নিয়ে নয়। আমি বিশ্বাস করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারাবাহিকতা থাকবে। তবে আমি সাবধানে পথচলার পক্ষে। সাবধানে পথ চললে সমস্যা কী? আজকাল এমন কিছু মানুষকে অতিরিক্ত আওয়ামী লীগার হতে দেখছি যা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। অন্য কিছু নয়। কোনো অতিবাড়াবাড়ি ভালো নয়। সবকিছুর একটা দৃশ্যমান সৌন্দর্যবোধ আছে। এ সৌন্দর্য নষ্ট হলে সমস্যা। ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কোনো ইতিহাসে যাব না। সেই সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ গত ১০ বছরে কোনো অবস্থানই পাননি। এমনকি ২০১৪ সালের অনেক অজানা ইতিহাস আমার দেখা আছে। এই সময়ে অবদান রাখা অনেক কর্মকর্তা ও মানুষকে এখন আর দেখি না। নানামুখী গ্রুপিংয়ে অনেকের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। নতুন বইয়ের মলাটের মতো পরিবর্তনের ঢেউ বড্ড বেশি আছড়ে পড়ছে চারপাশে। এই ঢেউয়ের নেতিবাচক আঘাত এলে অনেক কিছু সামলে ওঠা কঠিন হয়ে উঠবে। সময় চলে যায়। কোনো কিছু থেমে থাকে না। ভালো কাজের অবশ্যই মূল্যায়ন আছে। দুনিয়ায় মানুষ তা দেখে যায়। মনে রাখা দরকার, রাজনীতিতে দুঃসময়ে অবদান রাখা মানুষগুলো অভিমানী হয়। আর এই অভিমানের সুযোগ নেয় নবাগত বহিরাগতরা। এর পরিণাম শেষ পর্যন্ত রাজনীতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। আমাদের একটা সাহস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু দেশটা দিয়ে গেছেন। অথচ আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি। এই দুর্ভাগ্য আমাদের। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে ফোন করেছিলেন সেনাপ্রধানকে। তিনি আসেননি। থামাতে পারেননি বিপথগামী সদস্যদের। হত্যাকাণ্ড নিয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল। বিশাল আকাশ কখন মেঘে ঢেকে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু টের পাননি। তখন চারদিকে আওয়ামী লীগ ছাড়া কিছুই ছিল না। বাকশাল গঠনের পর সবাই দলে বলে শামিল হয়েছিলেন। জাতির জনক কঠিনতম সময়ে কাউকে পাশে পাননি। যারা তখন বেশি কথা বলতেন তারাও আসেননি। তাই চলমান সময়ে যে এমপি, মন্ত্রী, নেতাদের জনপ্রিয়তা কর্মীদের কাছে শূন্যের কোঠায় তাদের রাখতে হবে কেন? বিতর্কিতদের বাদ দিতে হবে বৃহত্তর স্বার্থে। আওয়ামী লীগ টিকিয়ে রাখতে হবে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার জন্যই।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর