রবিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ঘটনা এবং শিক্ষণীয়

ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক

এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ঘটনা এবং শিক্ষণীয়

এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহ দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল বা প্রভাবিত রাষ্ট্র ছিল। আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের মাধ্যমে দেশসমূহ স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনেক রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দেশসমূহের নিজেদের প্রচেষ্টায় সম্পদ ব্যবহার এবং বিশ্বায়নের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে আন্দোলনে সরকারের পতন হচ্ছে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা সর্বত্রই রাজনৈতিক সংকট চলছে। সাম্প্রতিক কালে বহুধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ মালয়েশিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। জননন্দিত নেতা মাহাথির মোহাম্মদ জোট গঠন করে আবার ক্ষমতায় এসেছেন। ইতোমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত থাকলেও সাম্প্রতিক কালে জ্যাকব জুমাকে চাপের মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছে। তিনিও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধেও মামলা চলছে। আমরা জানি ব্রিটিশ শাসনামলের রোডেশিয়া ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ে নামে স্বাধীনতা অর্জন করে। আমরা এও জানি দীর্ঘ ৩৭ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকার পর স্বাধীনতার স্থপতি রবার্ট মুগাবের শাসনের অবসান ঘটে। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুগাবের সহযোগী নানগাগওয়া ক্ষমতাসীন হন, সেনাপ্রধান ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। অতি সম্প্রতি জিম্বাবুয়েতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানগাগওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী জোট নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছে। একসময়ের অবিসংবাদিত নেতা রবার্ট মুগাবেকে কেন এভাবে বিদায় নিতে হলো তা পর্যালোচনায় এসে যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে শক্তিশালী মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অন্যান্য দেশের বিষয়ও আলোচনা করা দরকার।

জিম্বাবুয়ের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, প্রথমে আরব বণিকদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘাত ও দ্বন্দ্ব ছিল সোনা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ উত্তোলনকে কেন্দ্র করে। ইউরোপ থেকে প্রথমে পর্তুগিজরা এসেছিল ষোড়শ শতাব্দীতে। সিসিল রোডিশ ১৮৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরাট অংশ দখল করে নেয়। সিসিল রোডিশের দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানির নামানুসারে জিম্বাবুয়ের এ অঞ্চলকে রোডেশিয়া নামে অভিহিত করা হয় ১৮৯৪ সালে এবং বিএসএ প্রশাসনের ১৯২২ সালের সমাপ্তি ঘটে। রবার্ট মুগাবে প্রথমে জানু পার্টির প্রধান হন। পরে জুসয়া কমুর জাপুর সঙ্গে একীভূত হয়ে প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট গঠন করা হয়। প্রথমে গেরিলা যুদ্ধ এবং ’৭০-এর দশকে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। ব্রিটেনের সহযোগিতায় ১৯৭৯ সালে নতুন সংবিধান রচিত হয় এবং পরের বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জিম্বাবুয়ে প্রজাতন্ত্র ১৯৮০ সালের এপ্রিলে স্বাধীনতা লাভ করে।

উল্লেখ্য, ১৯৮০ সাল থেকে শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসানের পর প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুগাবে দেশটির একক রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে জানু গঠিত হয়। ’৭৫ সালে তিনি এর প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। ’৭৬ সালে অন্য একজন প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী নেতা জসুয়া নকামু প্রতিষ্ঠিত জাপুর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট গঠন করেন। ’৮২ সালে তিনি জসুয়ার নকামুকে বিতাড়িত করে নিজের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ’৮৭ সালে জানু ও জাপু একক দলে পরিণত হয় এবং সেই থেকেই মুগাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তার ভালো কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ভূমি বিতরণ করা এবং কৃষিকাজের উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অর্জন। এ ছাড়া প্রতিবেশী দক্ষিণ আফ্রিকায় ’৯৪ সালে জাতিগত বিদ্বেষের অবসানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, জিম্বাবুয়েসহ আফ্রিকার প্রতিটি দেশে গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজব্যবস্থা চালু ছিল। পরে ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশে পরিণত হয়। যে কয়েকটি দেশে শ্বেতাঙ্গরা স্থায়ীভাবে বসবাস ও সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্ট করে এর মধ্যে জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। দুটি দেশেই শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম চলতে থাকে। আলোচনা থেকে দেখা যায়, গণআন্দোলন ও সংগ্রামে রবার্ট মুগাবেসহ তার সহযোগীরা সফল হয়েছেন। বিভিন্ন দল নিয়ে ঐক্য জোটও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বহুত্ববাদকে অনুসরণ করে দলে ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেননি। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল এবং সুফলও পেয়েছিল। কিন্তু সংস্কার, সুশাসন, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব ও দুর্নীতির ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। প্রশাসন ও সেনাবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং দল থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে এলে জনগণ উল্লাস এবং সমর্থন প্রকাশ করে। তার একসময়ের সহযোগী বিতাড়িত নেতা নানগাগওয়া প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সিরিল রামাপাসাকে তাদের নেতা নির্বাচন করেছে। রামাপাসা এখন নিশ্চিতভাবে ২০১৯ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার নেতৃত্বে দেশটির ব্যর্থতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী দেশ। দীর্ঘদিনের বর্ণবাদী শাসনের পর ১৯৯৪ সালে অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতাসীন হন। শ্বেতাঙ্গ নেতা ডি ক্লার্ককে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেন। এর কারণ হলো, সুষ্ঠুুভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বর্ণবৈষম্যের অবসান। বিগত প্রায় ২৫ বছরে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্ণবাদী শাসনের রেশ মোকাবিলার চেষ্টা করা হলেও তা এখনো শিক্ষা, আয়, কর্মসংস্থান ও সম্পদ বৈষম্যের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর বেশির ভাগই শ্বেতাঙ্গ। জাতীয় আয়ের ৬০ শতাংশ এদের হাতে। আর নিচের সারির ৯০ শতাংশ মানুষ আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের মতো জীবনযাপন করে। যাদের প্রায় সবাই কালো। আফ্রিকার গণমানুষের নেতা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই ক্ষমতা ত্যাগ করেন, উত্তরসূরিরা যাতে নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেদের সুযোগ্য করে নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ম্যান্ডেলা অনেক ক্ষেত্রেই মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করেছিলেন। ম্যান্ডেলার পরে এমবেকি উত্তরসূরি নির্বাচিত হন। ১০ বছর দায়িত্ব পালনের পর জ্যাকব জুমা দলের প্রধান ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সাম্প্রতিক অধিবেশনে রামাপাসাকে দলের প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছে। তিনি জ্যাকব জুমার সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন। এটা দলের ব্যাপক কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ। দুর্নীতি ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ দৃশ্যমান হচ্ছে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এখনো সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ডান ও বাম দুটি ধারার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ডানদিকে দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক জোট শক্তিশালী হচ্ছে যারা দেশটির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রশাসন চালাচ্ছে। ৫ কোটি লোক অধ্যুষিত এ দেশ আফ্রিকার মধ্যে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিক্রসের সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা রয়েছে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে প্রথম কাজ হবে এএনসিতে ঐক্য ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই এ দেশটিতে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। মিসর প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর সভ্যতার ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের। রাজা ফারুককে বিতাড়িত করে জামাল আবদুন নাসের আরব রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও আরব বসন্তে গণঅভ্যুত্থানে হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ থাকলেও গণঅভ্যুত্থানের পরে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের দল থেকে মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ধর্মীয় বিভেদ এবং বৈষম্য, অনৈক্যের সুযোগে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। আবদেল ফাত্তাহ সিসি প্রেসিডেন্ট হলেও দেশে এখনো স্থিতিশীলতা আসেনি। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও তারা এখনো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১০ কোটি জন-অধ্যুষিত দেশটি এখনো অস্থির। জন-অধ্যুষিত আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ নাইজেরিয়া। লোকসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত রয়েছে। মুসলিম ও খ্রিস্টান জনসংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিগত নির্বাচনে বুহারি প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণ করলেন উহুরু কেনিআত্তা। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছে। ১ কোটি ৯৬ লাখ ভোটারের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, উহুরু কেনিআত্তা দেশটির জাতির পিতা কেনিআত্তার সন্তান।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি ধারণকারী ১০টি দেশের মধ্যে ৬টি আফ্রিকা মহাদেশের। তানজানিয়া, ঘানার প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের কাছাকাছি। প্রায় সব দেশের সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করছে। সাম্প্রতিক কালে জিম্বাবুয়ে এর প্রমাণ। আমেরিকা, ভারত, চীন, জাপানসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী দেশসমূহ আফ্রিকার উন্নয়নে সম্পৃক্ত হচ্ছে এবং প্রভাব বিস্তার করছে। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন পারস্পরিক সহযোগিতা কার্যকর ভূমিকা রাখে; পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত, জাপানসহ বিশ্বের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশসমূহের সঙ্গে আফ্রিকার রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সহযোগিতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এবং স্থায়ী রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

আমরা জানি, মালয়েশিয়া বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৫৬.৬%, বৌদ্ধ ২১.৯%, খ্রিস্টান ৯.০৩%, হিন্দু ৭.২২%। ইসলাম মালয়েশিয়ায় সরকারি ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মালয়েশিয়া মালয় রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল, অষ্ঠাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায় এবং ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে আশির দশক থেকে প্রায় দুই দশক পর্যন্ত দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করে। বিগত প্রায় এক দশকের অব্যবস্থা ও অনিয়মের ফলে অগ্রগতি আবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতন আরাপন নাজিব রাজাকের জোট বারিশান ন্যাশনালকে পরাজিত করে বিপুল বিজয় অর্জন করে। জোটের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। অবশ্য জোটের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনোয়ার ইবরাহিমকে শাস্তি মওকুফ করে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আলোচনা করে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জাপান সফরের মাধ্যমে শক্তিশালী দেশসমূহের সঙ্গেও সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ ভারত মহাসাগরে হাজারের বেশি দ্বীপের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নয়নাভিরাম দেশ। ৩ লাখ লোকের এই ছোট্ট দেশের জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের বংশোদ্ভূত। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত নাশিদই একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিন বছর ক্ষমতায় টিকে থাকার পর ২০১২ সালে তাকে জোরপূর্বক ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। উল্লেখ্য, এর আগে মামুন আবদুল গাইয়ুম ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। নাশিদের ক্ষমতা ছাড়ার পর আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্ষমত ছেড়ে নাশিদকে প্রথমে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে যেতে হয়। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করছেন। সম্প্রতি সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ নয়জন বিরোধী নেতার সাজার আদেশ সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে তাদের ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়ার পরই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ইয়ামিন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, প্রধান বিচারপতিসহ দুই বিচারপতিকে গ্রেফতার করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে গৃহবন্দী করেন। নাশিদের নেতৃত্বে বিরোধী দল বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। জাতিসংঘ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উদ্বেগ প্রকাশ করে। অতিসম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমের সরকার সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে ভারত সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষা করে। মালদ্বীপের এই সংকটের মূল কারণ সেখানে সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। দল ও বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার কোন্দল অব্যাহত রয়েছে। অথচ দেশটির পর্যটনশিল্প ও মৎস্যসম্পদ রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে বিচার বিভাগসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে দিতে হবে। নেপালেও দীর্ঘ ১০ বছরের প্রক্রিয়ায় সংবিধান প্রণীত হয়েছে এবং এর অধীনে নির্বাচন হয়ে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানে জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবানদের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে তালেবানসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী আশ্রয় ও প্রশ্রয় পাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা বিশেষ করে জাতিগত সংঘাত ঘটলেও সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে বিগত তিন দশক ধরে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রয়েছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। থাইল্যান্ডে বার বার সামরিক বাহিনী প্রভাবিত সরকার গঠিত হচ্ছে। পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনে সামরিক বাহিনী মূল ভূমিকা পালন করছে। গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে না। এশিয়ার ভারত, চীন ও জাপান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। বর্তমান শতাব্দীকে বলা হয় এশিয়ার শতাব্দী। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশে অব্যবস্থা রয়েছে। স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারত, জাপানসহ এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এগোতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত

 

সর্বশেষ খবর