বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

কাজী ইউনুস আলী মাস্টার : শেষ প্রদীপটিও নিভে গেল

ড. শেখ আবদুস সালাম

কাজী ইউনুস আলী মাস্টার : শেষ প্রদীপটিও নিভে গেল

গত চার-পাঁচ বছরে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আমার শিক্ষকদের এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁদের নিয়ে অন্তত চারটি লেখা আমাকে লিখতে হয়েছে। সেসব নমস্য শিক্ষক হলেন—আমার পাঠশালার হাতেখড়ি দেওয়া শিক্ষক নিশিকান্ত মাস্টার মহাশয়, প্রাইমারি পর্যায়ের আবুল হাসেম স্যার, নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ের নুরো স্যার এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের চিত্ত স্যার। গত ২৫ আগস্ট, ২০১৮ তারিখ আমার জীবনের আরেক বাতিঘরতুল্য শিক্ষক কাজী ইউনুস আলী মাস্টারও গত হয়ে এ পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। আমি আমার এই লেখার শুরুতে প্রত্যেকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। কাজী ইউনুস আলী ছিলেন আমাদের অনেকের জীবনে এক রাখালতুল্য শিক্ষক। আমাদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে স্কুলে নেওয়া এবং পড়ার টেবিলে বসানো ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। আমরা বাগেরহাটের রামপাল থানার (এখন উপজেলা) কুমলাই গ্রাম থেকে গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে যারা স্কুলজীবন পাড়ি দিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় এক-আধটু জায়গা করে নিতে পেরেছি, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ বিচারিক কর্মকর্তা, কেউ ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, কেউ কলেজের শিক্ষক, ভাইস-প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপাল, কেউ স্কুলের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, কেউ সরকারের বড় কর্মকর্তা ইত্যাদি পদে অধিষ্ঠিত এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৃতিমানও। এ সময় এসে তাঁদের কেউ আবার অবসরপ্রাপ্ত, কেউ কেউ আবার পৃথিবী ছেড়ে চলেও গেছেন। ষাটের দশকে দক্ষিণ বাংলার অবহেলিত আমাদের ওই অঞ্চলে লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং অবস্থান ছিল অনেক দূরে দূরে (যেমন : আমি সপ্তম শ্রেণিতে উঠে আমার বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় মাইল কাঁচা এবং কাদা রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে ১৬-১৮টি বাঁশের সাঁকো পার হয়ে স্কুলে যেতাম)। আমাদের গ্রামে তখন মাত্র একটি বা দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। আজ সেই গ্রামে ১১-১২টি স্কুল-মাদ্রাসা (সম্প্রতি ইসলামী ফাউন্ডেশনের বদৌলতে আরও একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলছে)।

সে সময় প্রাথমিকের গ্লি পার হয়ে খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী হাইস্কুল বা কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখতে পারত। তখন প্রয়াত ইউনুস কাজী মাস্টারও ছিলেন আজকের দিনের তুলনায় স্বল্প শিক্ষিত এক স্বপ্নচারী মানুষ। সাধ্যের বাইরে গিয়ে শিক্ষানুরাগী ও সমাজ বিনির্মাণের এক উদ্যমী কারিগর। তিনি নিজে তখন ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া জানতেন; কিন্তু বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণ, সমাজ পাঠ এবং পাটিগণিত-বীজগণিত এসবের ওপর দখল ছিল যথেষ্ট। তাঁর কাজ ছিল গ্রামে কোন কোন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে, তাদের খুঁজে বের করে একত্র করা এবং গার্ডিয়ানদের কনভিন্সড করে গ্রুপ তৈরি করে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তাদের পড়ালেখা নির্বিঘ্ন করা এবং প্রয়োজনে প্রাইভেট পড়ানো। তাঁর মাসিক পারিশ্রমিকের হার ছিল শিক্ষার্থী প্রতি অবস্থা ভেদে দুই থেকে পাঁচ টাকা। কেউ না দিতে পারলে দরকার নেই।

শিক্ষার্থীদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে লেখাপড়ায় নিয়োজিত রাখার এই রাখাল শিক্ষককে আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে। অনেকটা বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে ছাত্র বানানো এবং শেষাবধি তাদের একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠার আগ-পর খোঁজখবর নেওয়া, জীবনভর তাদের ব্যাপারে তদারকি অব্যাহত রাখা এমন মানুষ আজ সমাজে খুঁজে পাওয়া বিরল। ইউনুস আলী মাস্টার ছিলেন এমনই এক নিবেদিত আত্মার মানুষ। আজকের রামপাল-মোংলা মিলে তখন একই থানা—রামপাল। বিশাল পরিধি। এই থানায় তখন হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র হাইস্কুল। আমাদের গ্রাম থেকে কোনো কোনোটির দূরত্ব ছয় মাইল, ১০ মাইল, ১৫ মাইল এমনকি ২০ মাইল। সম্ভবত ১৯৬২ সাল। আমার গ্রামের কতিপয় স্বল্পশিক্ষিত (আবার কেউ কেউ অশিক্ষিত) শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি আজ তাঁরা সবাই প্রয়াত। এদের মধ্যে কাজী আকাম উদ্দিন, হাজী দলিল উদ্দিন, শেখ আমিন উদ্দিন, সরদার এলেম উদ্দিন, শেখ মফিজ উদ্দিন, শেখ সৈয়দ, শেখ ্লমোবারকসহ আরও অনেকে (সবার নাম মনে নেই) উদ্যোগ নিলেন গ্রামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্কুলটিতে প্রথমে ক্লাস সিক্স পরে সেভেন, এইট অতঃপর নাইন এবং টেন ক্লাস চালু করা হলো। এই উদ্যোগের জন্য খাতাপত্র প্রস্তুত করা, কাঁধে বয়ে সুপারি গাছ, বাঁশ, গোলপাতা দিয়ে স্কুল ঘর তৈরি করা, ছাত্র জোগাড় করা, শিক্ষক জোগাড় এসব কাজের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত হয়ে পড়লেন কাজী ইউনুস আলী মাস্টার। তিনি দায়িত্ব নিলেন স্কুলের প্রধান ক্লার্কের; সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো ক্লাসে বাংলা, সমাজ            প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদানের। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য দাপ্তরিক খাতাপত্র তৈরি করা, তা প্রয়োজনমতো আপডেট রাখা এ কাজে ইউনুস আলী মাস্টারের কোনো তুলনা ছিল না। বন্যা, বাদল-বৃষ্টি, ঝড়-তুফান কোনো কিছুই তাঁকে নিত্যদিন সময়মতো স্কুলে আসা এবং সবার শেষে স্কুল ত্যাগ—এই অভ্যাস থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। প্রথম দিকে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা যেমন কম ছিল, ছাত্র বেতনও ছিল নামমাত্র এবং তাও থাকত অধিকাংশ সময়ে অনাদায়ী। উদ্যোগী ওইসব ব্যক্তি তখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারিকেল, সুপারি এবং ধানের মৌসুমে ধান কালেকশন করতেন। আর তা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের যৎসামান্য বেতন দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। প্রধান কারণিক হিসেবে ইউনুস আলী মাস্টার তখন বছরে কয় টাকা স্কুল থেকে পেতেন তা বলা কঠিন। তবে সবাইকে দেওয়ার পর যে তিনি তারটা নিতেন এটা ছিল তার স্বভাবের অংশ। স্কুলটি সরকারি অনুমোদনের দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর একসময়ে গিয়ে এমপিওভুক্তির ফলে সরকার থেকে তাও খুবই সামান্য টাকা-পয়সা হয়তো তারা পেতেন। তবে তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলত এ কথা বলা যাবে না। সে কারণে সুযোগ পেলে অনেকেই চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন। কিন্তু ইউনুস আলী মাস্টার এখন থেকে চার-পাঁচ বছর আগে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্কুলটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন নিজ সন্তানের মতো। এটা যেন ছিল তাঁর নিজ বাড়ি। রাত-দিন তার ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুমলাই হাইস্কুল। কাজী ইউনুস একজন ক্লার্ক-কাম-শিক্ষকই ছিলেন তা কেবল নয়। তিনি একদিকে অফিস সামলাতেন, ক্লাসে শিক্ষাদান করতেন, আবার রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন, আমরা পড়াশোনা করছি কি না? তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত প্রকৃতির সংস্কৃতিবান মানুষ। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক প্রভৃতি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতো। এই মানুষটি নিজে নাটক রচনা করতেন, তা প্রযোজনা করতেন, নাটকের নির্দেশনা দিতেন এবং নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য অর্থ জোগাড়ের দায়িত্বও পালন করতেন। বাগেরহাটের রামপালের ওই অঞ্চল থেকে তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী আজ দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে খোঁজখবর পাওয়া যেত ইউনুস কাজী মাস্টারের কাছে। তাঁর প্রথম জীবনে দারিদ্র্যকে কোনোভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও শেষ জীবনে এসে আর যেন কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তাঁর একটি ছেলে তখন বিএ বা এমএ পাস। আমি সে সময় পিআইবির মহাপরিচালক। একদিন আমার বাড়িতে ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির। ছেলেটিকে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বুলুর দায়িত্ব এখন থেকে তোমাকে দিলাম। আমি আর আর্থিকভাবে পারছি না।’ আমি কাজী সাহেবের ছেলেকে পিআইবি-তে একটি ছোট্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। জানি না ওই ছেলে তার বাবাকে কতটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পেরেছে। ইউনুস মাস্টার সাহেব অবসরে যাওয়ার পর আমি আমার এলাকার তিনজন শিক্ষকের (আবদুর রাজ্জাক, মিজান প্রফেসর এবং কাজী ইউনুস আলী) অবসর ভাতার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তা করিয়ে দিয়েছিলাম। কাজী ইউনুস মাস্টার বহু মানুষের কাছে এই গল্প করেছেন। তাঁর হাতে তৈরি এক অভাজন ছাত্র তাঁর জন্য এতটুকু করেছে এটাতেই তার ছিল মহাআনন্দ। কিন্তু এসবের পরও দারিদ্র্য তাঁকে ছাড়েনি। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি প্রায়শ অসুস্থ থাকতেন। বাড়িতে গেলে আমি এবং তাঁরই সম্ভবত সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র এবং বন্ধুসম আমার বড়ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক তাঁর আর্থিক অনটনের কিছুটা উপশম করার চেষ্টা করেছি ঠিকই; কিন্তু ইউনুস মাস্টারের অবদানের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই যৎসামান্য। একজন নিবেদিত শিক্ষক এবং এমন প্রকৃতির সমাজকর্মীর ঋণ আসলেই কখনো পরিশোধ করা যায় না। আমাকে সরাসরি পাঠদান করেছেন, আমার এই রাখাল শিক্ষকের প্রয়াণে আমার জীবনের শেষ বাতিঘরও আজ নিভে গেল। আমি ওই এলাকাবাসী এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অনুরোধ জানাব—স্কুলের যে কক্ষটিতে ইউনুস মাস্টার সাহেব বসে এলাকায় শিক্ষার চাষ করেছেন সেই কক্ষটি অন্তত যেন তাঁর নামে নামকরণ করা হয় এবং তাঁর একটি ছবিও সেই কক্ষে টানিয়ে রাখা যেতে পারে। হে মহাপ্রাণ শিক্ষক, আপনি আমাদের কাছে অবিস্মরণীয়, আপনি আমাদের বিনম্র সালাম ও শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। আপনি যেখানে থাকুন, শান্তিতে থাকুন।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর