রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাক্ষরতা উন্নয়নের চাবিকাঠি

বাহালুল মজনুন চুন্নূ

সাক্ষরতা উন্নয়নের চাবিকাঠি

একটা দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সাক্ষরতার দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। সাক্ষরতা অর্জনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়ে যায়। সাক্ষরতা, শিক্ষা ও উন্নয়ন একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে দেশের সাক্ষরতার হার যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। সাক্ষরতা মানুষকে কর্মক্ষম ও মানবসম্পদে পরিণত করে। সাক্ষরতার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের দ্বার উন্মুক্ত হয় যা জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেয়। তাই সাক্ষরতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবীয় অধিকার হিসেবে বিশ্বে গৃহীত হয়ে আসছে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক ও মানবীয় উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু মৃত্যু রোধ, সুষম উন্নয়ন এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি বিকশিতকরণের ক্ষেত্রেই কেবল সাক্ষরতা অনন্য ভূমিকা পালন করে না, এটি একজন ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক মনোবল বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। একজন নিরক্ষর বা স্বাক্ষরতা জ্ঞানশূন্য ব্যক্তিকে সমাজের ‘বোঝা’ বলে বিবেচনা করা হয়; কেননা, বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য ন্যূনতম শিক্ষা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। একটি উৎপাদনশীল-উন্নয়নমুখী-কর্মদক্ষ-সচেতনমুখী-আলোকিত ও সুশৃঙ্খল জাতি গঠনে সাক্ষরতার দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল সমাজ নির্মাণের মূল ভিত্তিই হলো সাক্ষরতার দক্ষতা অর্জন করা। তাছাড়া উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই করার ক্ষেত্রেও সাক্ষরতার বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে বিশ্বে এখনো প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৮ কোটিই সাক্ষর নয়। অর্থাৎ প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি পাঁচজনের একজন নিরক্ষর। আর এ জনগোষ্ঠীর ৬৪ শতাংশই নারী। শিশুদের ক্ষেত্রেও চিত্রটা উদ্বেগজনক। জাতিসংঘ ঘোষিত সবার জন্য শিক্ষা সেস্নাগানের পরও বিশ্বের সাড়ে সাত কোটিরও বেশি শিশুই জানে না কী করে লিখতে পড়তে হয়। এ জন্যই আমরা দেখি, জাতিসংঘ  কর্তৃক ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) পূরণের জন্য সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সাক্ষরতা কী এ ধারণাটি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হিব্রু সভ্যতায় চিহ্ন বা প্রতিকৃতিভিত্তিক অক্ষরের ব্যবহার শুরু হয়। রোমান ও গ্রিকরাও মনের ভাব লিখিতভাবে প্রকাশ করার উপায় হিসেবে চিহ্ন বা সংকেত ব্যবহার করতে শুরু করে। যার ফলে তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় চিহ্ন বা সংকেত তথা অক্ষর চেনা, পড়া, লেখা ও ব্যবহার করার প্রক্রিয়া যা সাক্ষরতা হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাক্ষরতার সংজ্ঞায় তফাত থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো সার্বজনীন একটি সংজ্ঞা দেয় যেখানে পড়তে, লিখতে, বলতে পারার সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন হিসাব-নিকাশ করতে পারাকে সাক্ষরতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন ব্যক্তিকে সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য অন্তত তিনটি শর্ত মানতে হয়— ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে। এবং এই প্রতিটি কাজই হবে ব্যক্তির প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বে বর্তমানে এ সংজ্ঞার আলোকেই সাক্ষরতার হার নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ এখনো নিরক্ষর। এটি উদ্বেগজনক। তবে স্বাধীনতার পর সাত কোটি মানুষের মাঝে যেখানে সাক্ষরতার হার মাত্র ২০ শতাংশ ছিল, ১৬ কোটি মানুষের মাঝে তা ৭২.৩ শতাংশ। সাক্ষরতার হারের দিক দিয়ে এই যে ক্রমোন্নতি তা কিন্তু আশাব্যঞ্জক। এ ক্রমোন্নতির সূত্রপাতই হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে হলে জাতিকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে। তাই তিনি নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য যুগপত্ভাবে বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সবসময়ই গণমুখী শিক্ষাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণমুখী শিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্যই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে তার নির্দেশনায় একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত পর্যাপ্ত বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা পাঠদানের বিষয়টি আবির্ভূত করা হয়। তিনি সাক্ষরতা আন্দোলনের সূচনা করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ১৯৭২-৭৩ সালে দেশপ্রেমিক মোকছেদ আলীর উদ্যোগে ঠাকুরগাঁও জেলার কচুবাড়ি কৃষ্টপুর গ্রামের দেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হয়ে ওঠা। নিরক্ষরতা দূরীকরণের ওপর বঙ্গবন্ধু যে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে। গণশিক্ষা বিস্তারে তথা নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বরাদ্দ করেছিলেন আড়াই কোটি টাকা। সাক্ষরতা বা বয়স্ক শিক্ষার (১৫+) জন্য ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রণীত কুদরত-ই-খুদা কমিশনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় যার ওপর ভিত্তি করে সাক্ষরতা কার্যক্রম বিস্তারে গ্রহণ করা হয় নানামুখী পদক্ষেপ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশে সাক্ষরতার হার দীর্ঘকাল স্থবির অবস্থায় থাকলেও ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বিগত সাড়ে আট বছরে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দেশের বিদ্যমান ২৮ শতাংশ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ এর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসংক্রান্ত লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ গ্রহণ করা হয়েছে।

বর্তমান সরকার শিক্ষার প্রসার ও নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশকে একটি ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে এবং রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে সরকার নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কর্মসূচিকে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক ১৫-৪৫ বছর বয়সী ৪৫ লাখ নিরক্ষর নারী-পুরুষের জন্য দেশব্যাপী ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) নামে একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে ৬৪টি জেলায় ৫০২৫টি কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করে নব্য সাক্ষরদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদানের আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত করে জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাক্ষরদের দক্ষতাকে আরও পরস্ফুিটিত করতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অভিপ্রায়ে তাদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হচ্ছে। কেননা বর্তমান যুগে একজন মানুষ কেবল সাক্ষর হলেই হবে না, তাকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও জানতে হবে। বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি, ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ সর্বক্ষেত্রেই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। নব্য সাক্ষরদের যদি এ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তবে তাদের পক্ষে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হওয়া সম্ভব হবে না; যা টেকসই ডিজিটাল বাংলাদেশ হওয়ার অন্তরায়। এ জন্যই সরকার নিরক্ষর মানুষদের সাক্ষরতা অর্জন, তা ধরে রাখা এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে এটাও সত্যি সরকারের একার পক্ষে অতি দ্রুত নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত সংস্থার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন। পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে রক্ষা করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব।

এ দায়িত্ব পালনে সবাই এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াস পেলে বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যাবে। বাংলার মানুষ সাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যেমে দক্ষ জীবন গড়তে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত সোনার দেশে।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ খবর