সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

সাইফুর রহমান

চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

ফরাসি পর্যটক তাভেরনিয়ের ভারতবর্ষে আসেন ১৬৪০ সালে। তখন মোঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসন আমল। তাভেরনিয়ের বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৬৬৫ সালের ১৪ জানুয়ারি। ততদিনে সম্রাট শাহজাহান পরলোকগত হয়েছেন। ভাইদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ শেষে সিংহাসনে বসেছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। আগ্রা থেকে ১৬৫৫ সালের ২৫ নভেম্বর নৌপথে যাত্রা শুর“ করে প্রায় এক মাস বিশ দিন পর তিনি পৌঁছেছিলেন ঢাকায়। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনীটি ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। তিনি লিখেছেন- ১৪ জানুয়ারি আমি ঢাকা শহরে পৌঁছেই গিয়েছিলাম নবাব সাহেবের সঙ্গে সাাৎ করতে। তাকে উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলাম সোনার জরিতে তৈরি টিসু কাপড়ের একটি পোশাক। তার ঝালর ও কিনারা ম্লিত ছিল স্পেন দেশীয় সোনালি জরির সূতোতে। তাকে আরও দিলাম সোনালি র“পালি নকশাযুক্ত একখানি চাদর বা অঙ্গাবরণ, আর সুন্দর একটি মরকত মণি। নবাবের দশ বছর বয়সের পুত্রকে উপহার দিলাম সোনার জলে মীনে করা বাক্সে একটি ঘড়ি, রৌপ্যখচিত একজোড়া ছোট পিস্তল, অতি সুন্দর একখানি ম্যাগনিফাইং গ্লাস। পিতা পুত্রকে মিলিয়ে যা আমি দিয়েছিলুম তার মূল্য পাঁচ হাজার লিভারেরও বেশি ছিল। সন্ধ্যার দিকে আমি ওলন্দাজদের কুঠিতে ফিরে আসার পর নবাব আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন স্ফটিক পাথর, চিনা কমলালেবু, দুটি পারসিক ফুটি এবং তিন রকমের নাশপতি। ১৫ তারিখে আমি নবাবকে আমার জিনিসপত্র দেখিয়ে দিলাম। জিনিসপত্রের দাম সম্বন্ধে আমি চুক্তিবদ্ধ হলাম ১৬ তারিখে। অবশেষে তার গোমস্তার কাছে গেলুম আমার বিনিময় মুদ্রার জন্য চিঠি আনার উদ্দেশ্যে যাতে করে আমার প্রাপ্য টাকাগুলো আমি কাশিমবাজার থেকে উঠিয়ে নিতে পারি।

তখনকার দিনে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল। যে কোনো পর্যটক, নবাব ও তার পরিবারের জন্য দামি কোনো উপঢৌকন নিয়ে এলে সেগুলোর দাম নির্ধারণ করে তা চুকিয়ে দেওয়া হতো পর্যটকের হাতে। তাভেরনিয়ের ঢাকায় বসে তার পাওনা টাকা গ্রহণ না করে কেন সে টাকা কাশিমবাজার থেকে উত্তোলন করতে চাইলেন? কারণটি হলো- তাভেরনিয়ের ঢাকা আসার পর দেখলেন ওলন্দাজরা বেশ জমিয়ে ব্যবসা করছে ঢাকায়। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের জিনিসপত্রগুলো চুরি হয়ে যায় হরহামেশাই। তারা যখন দেখলেন যে ঢাকার সাধারণ বাড়িতে জিনিসপত্র রাখা নিরাপদ নয় তখন তারা চোরদের হাত থেকে জিনিসগুলো রা করার জন্য নিজেদের জন্য ভারি চমৎকার একটি বাড়ি তৈরি করেন। তাভেরনিয়ের আরও লিখেছেন- ওলন্দাজগণের ব্যবসা বুদ্ধি আমার চেয়ে ঢের বেশি। তারা আমাকে বললেন সঙ্গে টাকাকড়ি নিয়ে কাশিমবাজার যাওয়া নিরাপদ নয়। আবার নদী পথ ছাড়া যাওয়ার দ্বিতীয় কোনো উপায়ও নেই। স’লপথ যা আছে তাও পাঁকে, জলায় পরিপূর্ণ। তাছাড়া জলপথে আরও বিপদ আছে। যে জাতীয় নৌকোর ব্যবহার হয় তা সামান্য ঝড়বাতাসে উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো মাঝি মাল্লাদের যদি জানা থাকে যাত্রীর সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাকড়ি আছে তাহলে খুব অনায়াসেই তারা নৌকো উল্টে দিতে পারে। মাঝিমাল্লাগুলো এমন-ই দ চোর যে তারা ঠিক-ই বুঝতে পারত নদীর কোনো জায়গায় মুদ্রার থলেগুলো নিমজ্জিত হয়েছে এবং সময়মতো এসে অবাধে তারা সেগুলো তুলে নিতে সম হতো।

শুধু তাভেরনিয়ের-ই নয় তার সমসাময়িক প্রায় অধিকাংশ পর্যটক যেমন আল বির“নী (ভারতবর্ষে ছিলেন ১০১৭ থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত) ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৩৩৩ সালে, বার্নিয়ের (১৬৫৯-১৬৬৬), মানুচি (১৭০৪-১৭১৭), কমবেশি আমাদের চারিত্রিক স্খলনের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিখেছেন- মালদ্বীপে চুরি করার অপরাধে আমি একবার একটি চোরের হাত কেটে ফেলার হুকুম দিয়েছিলাম, তখন সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।

এবার আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে যাই। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম যে পরিব্রাজক এসেছিলেন তার নাম মেগাসে’নিস। তিনি এসেছিলেন গ্রিস থেকে। সম্ভবত ৩০২-২৯৮ খ্রিস্টপূর্বের কোনো এক সময়। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর আগে। গ্রিক সম্রাট সেলুকাসের দূত হিসেবে ভারতে এসেছিলেন মেগাসে’নিস। তখন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল। চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলিপুত্র (বর্তমান বিহারের রাজধানী পাটনা)। মেগাসে’নিস কিন্তু আল বির“নী, তাভেরনিয়ের, মানুচি কিংবা অপরাপর অন্যান্য পর্যটকদের মতো আমাদের চোর, শঠ, প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করেননি। মেগাসে’নিস লিখেছেন— পাটলিপুত্র নগরের সাধারণ মানুষের জীবন সুসংযত ও সুশৃঙ্খল। এখানে চুরি চামারি অতি বিরল। পাটলিপুত্র নগরে চার লাখ লোকের বাস। কিন্তু কোনো দিনও ত্রিশ মুদ্রার অধিক মূল্যের বস‘ অপহৃত হয়েছে বলে শোনা যায় নাই। ভারতবর্ষে লিখিত আইন-কানুনের ব্যবহার নেই। কিন্তু তারপরও কেউ আইন ভঙ্গ করেন না। তারা সরলচিত্ত ও মিতাচারী বলে সুখেই দিন যাপন করেন। তাদের বিধি ও পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকার সব কিছুই সরল। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তারা কখনো রাজদ্বারে অভিযোগ নিয়ে উপস্থিত হয় না। তারা অন্যের কাছে যে সব মূল্যবান সম্পদ গ”িছত কিংবা আমানত রাখে তৎসম্পর্কেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ করতে হয় না। সে সবের জন্য কোনো সাীরও প্রয়োজন হয় না। তারা পরস্পরকে বিশ্বাস করেই সম্পদ গ”িছত রাখে। তারা সচরাচর তাদের গৃহ অরতি রেখেই প্রাত্যহিক কাজকর্মে বেরিয়ে পড়ে। শুধু মেগাসে’নিস-ই নয় চীনা পরিব্রাজন ফা হিয়েন (৩৯৯-৪১৪) হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) প্রভৃতি পর্যটকগণও আমাদের সততা, আতিথেয়তা ও ন্যায়পরায়ণতার সুখ্যাতি করেছেন। হিউয়েন সাঙ এসেছিলেন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে (নালান্দা জেলা, বিহার, ভারত) একজন আচার্য হিসেবে। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন- ভারতবর্ষের দুর্গম ও অরণ্যসংকুল অঞ্চলে ডাকাতির কিছু আশঙ্কা থাকলেও চোরের তেমন কোনো উপদ্রব নেই। গৃহস’ লোকজন সাধারণত রাতে গৃহের দরজায় খিল না এঁটেই ঘুমায়।

ভারতের লোকজন রাতে গৃহের দ্বার খোলা রেখে ঘুমায় এটা দেখে হিউয়েন সাঙ যে অবাক হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কারণ পৃথিবীতে যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ২ হাজার বছর আগে সর্বপ্রথম তালার আবিষ্কার হয় মিসর ও চীন দেশে। এ থেকেই বোঝা যায় চীনে ও মিসরে ফারাওদের রাজত্বকালে কী প্রকার চোরের উপদ্রব ছিল সেখানে! সে যা হোক আমার প্রশ্ন হচ্ছে মেগাসে’নিস, ফা হিয়েন কিংবা হিউয়েন সাঙের মতে এ দেশের মানুষ সে সময় চুরি করতে জানত না। আমরা সত্যি সত্যি একসময় ছিলাম সৎ, উদার ও ন্যায়পরায়ণ কিন্তু চার, পাঁচশ বছরের ব্যবধানে কী রূপে আমরা সাংঘাতিক রকম চোর হয়ে উঠলাম সেটা সত্যি একটা আশ্চর্য বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের মতো সুরতি একটি স্থান হতে সোনা হয়ে যায় তামা। লাখ লাখ টন কয়লা কিংবা পাথর লোপাট হয়ে যায় চোখের সামনে থেকে। এ কোন এক বিচিত্র দেশে বাস করছি আমরা!!!

এককালে নাকি চোর পেশাটির বেশ নামডাক ছিল। প্রাচীন শাস্ত্রে চৌষট্টি কলার একটি অন্যতম কলা ছিল চুরিবিদ্যা। সেকালে রাজকুমারদের নানা বিদ্যা শাির পর চুরিবিদ্যা শেখানো হচ্ছে এমন বর্ণনা ‘দশকুমার চরিত’ প্রভৃতি গ্রন্’ে পাওয়া যায়। সংস্কৃতে লেখা পুঁথিতেও হদিস মেলে- ‘চৌর চর্যা’ বা ‘চৌর্য স্বরূপ’ নামে। এও শোনা যায়, প্রথম পুঁথির লেখক মূলদেব নিজেই নাকি ছিলেন একজন ডাকসাইটে চোর। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে প্রাচীনকালের পর্যটকগণ সৎ হিসেবে যতই আমাদের সুখ্যাতি কর“ক চৌর্যবৃত্তিটাই আসলে আমাদের অনিবার্য পরিণতি! আমাদের শাি ও সংস্কৃতিতেই কি তাহলে ছিল চৌর্যবৃত্তির বীজ। তা না হলে চারদিকে কেন আজ শুধুই চৌর্যবৃত্তি আর চোরদের মহাউৎসব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের স্পষ্টই জানিয়েছেন চুরি হলো একটি বদ অভ্যাস। লোভ থেকে যার জন্ম। অন্যদিকে অয় কুমার দত্ত লিখেছেন-                 “চৌর্যবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট প্রবৃত্তির অন্যতম কারণ হলো অর্জনস্পৃহা অর্থাৎ লাভের ই”ছা- অর্জনস্পৃহা বৃত্তি অতি প্রবল হইলে লোভ অত্যন্ত বৃদ্ধি হইয়া প্রতারণা ও চৌর্যবৃত্তিতে মানুষ প্রবৃত্ত হয়।”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অয়কুমার দত্ত চৌর্যবৃত্তিকে বদঅভ্যাস, কুঅভ্যাস, অর্জনস্পৃহা প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করেছেন ভালো কথা কিন্তু এই বদঅভ্যাস কিংবা এই কাজে ঐ নির্দিষ্ট মানুষটি কেন প্রবৃত্ত হয় যে বিষয়ে কোনো আলোকপাত করেননি কিংবা সেগুলোর কোনো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও তারা কেউ প্রদান করেননি। আমার মনে হয় এর শেকড় আরও গভীরে প্রোথিত। পাঠকবৃন্দ একটু ল্য কর“ন, প্রাচীনকালে সে হোক রাজা মৌর্য চন্দ্রগুপ্ত কিংবা সম্রাট অশোকের শাসন আমল। তখনকার সময়ে রাজ-রাজড়াগণ তাদের রাজ্য সীমানা বৃদ্ধি করতে যুদ্ধবিগ্রহে হয়তো লিপ্ত হতেন ঠিক-ই কিন্তু সে সময় প্রজাদের ওপর নিপীড়ন হতো কম। তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। হিউয়েন সাঙ রাজা হর্ষবর্ধনের রাজসভায়ও ছিলেন কিছু দিন। হর্ষবর্ধন ছিলেন পাটলিপুত্রের পাশের শহর কৌনজের সম্রাট। রাজা হর্ষবর্ধনের সুবিচার এবং দানশীলতা সম্বন্ধে বিস্তর প্রশস্তি লিখে গেছেন তার লেখা ভ্রমণকাহিনীতে। কালক্রমে রাজা-বাদশাগণ তাদের রাজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ল লোভী হয়ে উঠতে থাকেন। তাদের অর্থ-সম্পদ ও ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করার জন্য প্রজাগণের ওপর আরোপিত হয় অতিরিক্ত করের বোঝা। দেশ থেকে উধাও হতে থাকে সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো। এখানে একটি দৃষ্টান্ত দি”িছ। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়েরের কথা আমি আগেই উলেস্ন্লখ করেছি। ফ্রাসোঁয়া বার্নিয়ের পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি ভারতে এসেছিলেন ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাটের দূত হয়ে। ১৬৬৬ সালে স্বদেশে ফিরে গিয়ে বার্নিয়ের ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সম্পদ, আচার-ব্যবহার, সেনাবাহিনী, সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে একখানি দীর্ঘ পত্র লেখেন। বার্নিয়েরের সময় ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন চতুর্দশ লুই এবং মঁশিয়ে কলবার্ট ছিলেন ফ্রান্সের অর্থসচিব। বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের অন্যান্য অংশের মধ্যে এই পত্রখানির ঐতিহাসিক মূল্য ও গুর“ত্ব তার ভ্রমণবৃত্তান্তের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।        

বার্নিয়ের কলবার্টের কাছে লিখেছেন- ভারতবর্ষে সম্রাট-ই দেশের সমস্ত সম্পদের মালিক, বিশেষ করে ভূসম্পত্তির। সামরিক কর্মচারীদের বেতন হিসাবে তিনি ভূসম্পত্তির ভোগাধিকার দান করেন তাকে ‘জায়গির’ বলে। এই জায়গির থেকে তারা তাদের ন্যায্য বেতন আয় করেন। প্রাদেশিক সুবাদারদেরও জায়গির দেওয়া হয়, শুধু বেতনের জন্য নয়, সৈন্যসামন্তদের জন্যও।

এভাবে ভূসম্পত্তির অধিকারী যারা হন— সুবাদার, জায়গিরদার ও জমিদার— তারা প্রজাদের একমাত্র হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে যান, চাষিদের ওপর তাদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় থাকে, এমনকি নগর ও গ্রামের বণিকশ্রেণি ও কারিগরদের ওপরেও। এই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য তারা যে কি নির্মমভাবে প্রয়োগ করেন নিষ্ঠুর অত্যাচারীর মতন, তা কল্পনা করা যায় না। এই অত্যাচার ও উত্পীড়নের বির“দ্ধে অভিযোগ করারও কোনো উপায় নেই। কারণ যিনি রক, তিনিই ভক। এমন কোনো নিরপে কর্তৃপ কেউ নেই, যার কাছে তার অভিযোগ পেশ করা যায়। আমাদের দেশের (ফ্রান্স) মতন ভারতবর্ষে পার্লামেন্ট নেই, আইনসভা নেই, আদালতে বিচারক নেই— অর্থাৎ এমন কিছু নেই যার সাহায্যে এই নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের বর্বরতার প্রতিকার করা যেতে পারে। কিছু নেই, কেউ নেই। আছেন শুধু কাজি সাহেব, কিন্তু কাজির বিচারও তেমনি, কারণ কাজির কাছে জনসাধারণের সুবিচারের কোনো আশা নেই। পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ একটু ভালো করে ল্য কর“ন, আমাদের দেশ ও মানুষ সম্পর্কে তিনশত পঞ্চাশ বছর আগে বার্নিয়ের যা লিখে গেছেন বর্তমানে কি তার এতটুকু বদলেছে। যে কোনো রাষ্ট্রে সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার বিষয়গুলোর অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রে তৈরি হয় এক ধরনের অনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এসব প্রোপটে দুর্নীতি নেয় এক ভায়বহ রূপ। যেমনটি ঘটছে বর্তমানে।  

একজন মানুষ যখন অনিরাপত্তায় ভুগেন তখন তিনি মনে করেন টাকা দিয়েই নিশ্চিতভাবে সমস্ত সমস্যার সমাধান করবেন তিনি। চৌর্যবৃত্তির অন্যতম একটি কারণ যদি হয় সামাজিক অনিরাপত্তা তাহলে চৌর্যবৃত্তির অন্য আরেকটি বড় কারণ হলো অর্থ সঞ্চয়ের প্রতি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। আমার মতে এই আসক্তি হেরোইন, গাঁজা কিংবা আফিমের চেয়ে কম প্রভাবশালী নয়, বরং বেশি।

ঘুষ, ব্যাংক লুট, ঠিকাদারি কাজে দুর্নীতি প্রভৃতি চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের পরও তাদের খিদে মেটে না সহজে। তারা ক্রমাগত দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে অব্যাহত থাকেন। পত্রপত্রিকায় পড়েছি মালয়েশিয়া, আমেরিকা, কানাডা প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ নাকি তৈরি করেছেন সম্পদের পাহাড়। কানাডার এক অঞ্চলের নাম হয়েছে ‘বেগমগঞ্জ’। সেখানে বসবাস করেন বাংলাদেশের বেশ কিছু রাজনীতিবিদের বেগমরা। তাদের সেসব বিলাসবহুল বাড়ির সামনে দিয়ে যখন কানাডার স্থানীয় বাসিন্দারা হেঁটে যান তখন তারাও নাকি লজ্জা পান রাজনীতিবিদদের ওই সব প্রাসাদোপম বাড়ি দেখে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে ভালোভাবে জীবন ধারণ করতে একজন মানুষের আসলে কতটুকু সম্পদ প্রয়োজন। সেটা কি খুব বেশি। কেউ হয়তো বলবেন সরকারি পদে থেকে একেবারেই কি নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা সম্ভব। চাণক্যও বলেছেন- জিহ্বার অগ্রে বিষ রেখে মধু পান যেমন সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি রাজ আমাত্য হয়ে অর্থ তছর“প থেকে বিরত থাকাও সম্ভব নয়। অথচ চাণক্য কিন্তু ঠিকই দুর্নীতি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে কেউ দেখা করতে এলে তিনি প্রথমে প্রশ্ন করতেন- তুমি কি সরকারি কাজে এসেছ, নাকি আমার কাছে ব্যক্তিগত কাজে এসেছ? ওই লোকটি হয়তো বলল- আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সাাৎ করতে এসেছি। তখন তিনি সরকারি লণ্ঠনটি নিভিয়ে দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে ওই লোকের সঙ্গে কাজকর্ম সারতেন। তিনি নিজের কাজে সরকারি তেল ব্যবহার করতেন না। দেখা যাচ্ছে একজন দুর্নীতি পরায়ণ মানুষ হয়তো ব্যক্তি জীবনে ভোগ করছেন যৎসামান্যই। কিন্তু ব্যাংকে জমিয়ে রাখছেন শত সহস্র কোটি টাকা। চোরের খেতাব মাথায় নিয়ে কবরে যেতেও তাদের কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু ঐশ্বর্যের পাহাড় তাকে যে করে হোক গড়তেই হবে। এ জন্যই আমি বলেছি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন হচ্ছে একটি নেশার মতো। বার্নিয়ের তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন- অনাহারে ও অর্ধাহারে থেকেও ভারতবর্ষের মানুষদের সোনার গহনা পরার লোভ ও অভ্যাস খুব প্রবল।

চিলির পিনোসে, ফিলিপাইনের মার্কোস কিংবা প্রাচীন যুগের জুলিয়াস সিজার, চেঙ্গিস খান হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক ছিলেন। জীবনে তারা কতটুকু ভোগ করেছিলেন আর কতটুকু তারা কবরে নিয়ে যেতে পেরেছেন সে ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা আছে। তারপরও সম্পদের প্রতি মানুষের লোভ চিরন্তন। তবে সাধারণ মানুষদের চেয়ে আলোকিত মানুষজন ও লেখক সাহিত্যিকরা চট করেই ধরতে পারেন যে একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আসলে বিপুল অর্থ সম্পদের প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ বিষয়ে দুটো গল্প আছে। একটি গল্পের নাম ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ দ্বিতীয়টি ‘গুপ্তধন’ নামে। সম্পত্তি সমর্পণ গল্পে যজ্ঞনাথ কুণ্ড তার এত্তো এত্তো সম্পত্তি তো শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে পারলেন না। নিজের নাতিকে চিনতে না পেরে সমস্ত সম্পত্তি সমেত নিজের সেই দৌহিত্রকে মাটিচাপা দিয়ে দিলেন মন্দিরের নিচে। ছেলে নিতাই কুণ্ডের মুখে যজ্ঞনাথ যখন জানতে পারলেন পথে কুড়িয়ে পাওয়া নিতাই পাল আসলে তার নিজের নাতি গকুলচন্দ্র কুণ্ড তখন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। ‘গুপ্তধন’ গল্পে দেখি মৃত্যুঞ্জয় তার পিতামহের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি গুপ্তধনের নক্শা পেয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা তদবির করে এক সন্ন্যাসির সাহায্যে বিরাট এক সুড়ঙ্গের মধ্যে সেই গুপ্তধনের সন্ধান তিনি পান। কিন্তু সেই সুড়ঙ্গের ভিতর আটকা পড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- “এমন সময় দ্বার খুলিয়া গেল। সন্ন্যাসী ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, মৃত্যুঞ্জয়, কী চাও। সে বলিয়া উঠিল, আমি আর কিছুই চাই না- আমি এই সুড়ঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলকধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে, বাহির হইতে চাই। আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তি চাই।”

আমাদের দেশে চৌর্যবৃত্তি প্রসারের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা। সমাজে চোররা আজ সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দেশে যারা মন্ত্রী, আমলা, কামলার দায়িত্ব পালন করেন তাদের একাংশের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ডান, বাম, আস্তিক, নাস্তিক, কমিউনিস্ট, ইসলামিস্ট মিলেমিশে সব আজ চৌর্যবৃত্তিতে নিমজ্জিত। চোরে চোরে আজ সব মাসতুতো ভাই। লেখক হরিপ্রসন্ন দাশ গুপ্ত ১৯২২ সালে এ নামে একটি গল্প রচনা করেন কিন্তু আজ সেটা আর গল্প নয় একেবারে সত্যি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। নামাজ পড়ে পড়ে কপালে কালো দাগ ফেলে দিয়েছেন কিংবা বছরে বছরে যারা হজ করেন তাদের কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তিতে পিছিয়ে নেই। এরাই আমাদের সমাজের বিভিন্ন সভা, সমিতিতে সভাপতি, প্রধান অতিথি ও অগ্রগণ্য ব্যক্তি। চোর হিসেবে যে তাদের অযোগ্য কিংবা অপাঙেক্তয় ঘোষণা করবে সে সৎ সাহস আমাদের সমাজের কারও নেই।

আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিরা যে পরিমাণ অর্থ তছর“প করেন যে পরিমাণ অর্থ বোধকরি একজন কুখ্যাত ডাকাতও করে না। আসলে এসব চোরদের ডাকাতের সঙ্গে তুলনা করলে ডাকাতদের-ই অপমান করা হয়। আমাদের দেশের এসব চোররা ডাকাতদের চেয়েও জঘন্য ও ঘৃণিত। চোর এবং ডাকাত উভয়ই পরের অনিষ্ট করে তবে কেন লোকে চোরকে ‘ঘৃণা’ করে আর ডাকাতকে ‘বিদ্বেষ ও ভয়’ করে। আমার মতে ডাকাতরা ডাকাতির কথা স্বীকার করতে কখনো লজ্জা পায় না। এ ছাড়াও কোনো ডাকাতের হঠাৎ চৈতন্য জন্মালে তারা দুঃখিত হয় অনুতপ্ত হয়। নদীয়ায় প্রসিদ্ধ বিশ্বনাথ ওরফে বিশু বা বিশে ডাকাতকে নিয়ে ১৮৯৬ সালে লেখক শ্রীশচন্দ্র মজুমদার নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে রচনা করেন ১২৭ পৃষ্ঠার একখানি মনোজ্ঞ ঐতিহাসিক উপন্যাস। ডাকাত হয়েও বিশ্বনাথ ছিল সহৃদয়। ডাকাতি পেশাটিকে সে জাতে তুলেছিল। ডাকাতি পেশাটিকে আরও জাতে তুলতে সহায়তা করেছিল ইংল্যান্ডের রবিনহুড, অস্ট্রেলিয়ার নেডক্যালি, মৌর্যচন্দ্রগুপ্তের সময় ভল্লাট ও চম্বলের ডাকু মান সিং-এর মতো ডাকাতেরা। উনিশ শতকে, এমনকি বিশ শতকে সাহিত্যেও চোর নয় বরং ডাকাতদেরই জয়-জয়কার। বিশে ডাকাতকে নিয়ে উপন্যাসের কথা তো আগেই বলেছি। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায়ও ডাকাতের ছড়াছড়ি। চন্দ্রশেখর (১৮৭৭) আনন্দমঠ (১৮৮২) কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬) প্রভৃতি উপন্যাসে ডাকাত চরিত্র বা ডাকাতির বিবরণ আছে বিস্তর। ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৮৮৪) উপন্যাসে নায়িকা দেবী চৌধুরানী তো স্বয়ং ডাকাত। অথচ চোরদের নিয়ে লেখা হয়েছে হাতে গোনা গুটিকয়েক গল্প ও মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’ নামে শুধু একটি উপন্যাস।

লেখক কালীপ্রসন্ন লিখেছেন- “ডাকাতের চরিত্রে আছে গৌরব ও মহত্ত্বের মিশ্রণজাত পুর“ষাকার। প্রতিপ তথা প্রশাসনকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবার অতুলনীয় স্পর্ধা ডাকাতকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। অন্যদিকে চোরের স্বভাব-চরিত্র একেবারে বিপরীত- চোর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে প্রবেশ করে, নিঃশব্দ অপহরণ করে এবং আলোক দেখিলেই ভয়ে তাহা নিভাইয়া ফেলে। ডাকাত সিংহ না হলেও ‘ব্যাঘ্রজাতীয়’, কিন্তু চোর ধূর্ত, বঞ্চক ও কপটপর শৃগাল জাতি।”

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মেইল :  barristershaifur¦yahoo.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর