রবিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে?

জাকারিয়া চৌধুরী

বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে?

আধুনিক যুগের জীবনধারা অর্থনীতিনির্ভর। আধুনিক অর্থনীতি যে জীবন-দর্শনের ওপর ভিত্তি করে তা টেকসই এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় - নয় সহায়ক জাগতিক ও মানবিক শান্তি প্রতিষ্ঠায়। Capitalism বা পুঁজিবাদ ব্যক্তিস্বার্থকে সমাজের সঠিক চালিকাশক্তি হিসেবে ধরে নেয়। মানুষ যত বেশি আত্মস্বার্থের তাড়নায় প্রতিযোগী হবে, যত বেশি উৎপাদন বাড়াবে, পণ্য বাড়াবে, প্রবৃদ্ধি বাড়াবে ততই বেশি মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, সমাজের সম্পদ বাড়বে, মানুষ সুখে এবং শান্তিতে থাকবে। এককথায়, মানুষকে স্বার্থপর হতে হবে। Self interest is the best interest. স্বার্থই পরম সত্য। আসলে কি তাই? মানব জাতি কি সুখে ও শান্তিতে আছে? অনেকটা বন জঙ্গলের নিয়ম ‘survival of the fittest’ কে সামাজিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া। আজকের মানব সমাজ এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই চলছে। অর্থনীতি মানবমুখী না হয়ে হয়েছে বাজারমুখী। রাজনীতিও সেই ধারায় বহমান।

 

Darwin-এর মতামত হলো ‘in the state of Nature’ অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণী জগতের ক্রমবিকাশ হয়েছে বিবর্তনের প্রক্রিয়া ‘Natural selection’-এর মাধ্যমে। Nature favours the strongest মানুষও কি পশুপাখির স্তরে নেমে গিয়ে, যে শক্তিশালী শুধু সেই প্রজাতিই টিকে থাকার নীতিতে সমাজ পরিচালনা করবে? যুগে যুগে মানব সভ্যতার উত্থান ও পতন হয়েছে। যখনই মানুষ নৈতিকতা হারিয়ে শুধু আত্মতুষ্টির প্রতিযোগিতায় ধাবিত হয়েছে তখনই সেই সভ্যতার পতন হয়েছে। শুধু শক্তির জোরে গ্রিক, রোমান, মিসরীয়, চীন, ভারত, ইনকা, মায়া কোনো সভ্যতাই টিকে থাকতে পারেনি। পশু শক্তির জোরে চূড়ান্ত মানবিক বিকাশ সম্ভব নয়। অতীতে মানব সভ্যতার বিকাশ হয়েছে আঞ্চলিক ভিত্তিতে। এখন একই সভ্যতার ছত্রছায়ায় সম্পূর্ণ পৃথিবী। অতীতে সভ্যতার পতন হয়েছে একটা অঞ্চলজুড়ে, এখন পতন এলে তা হবে সম্পূর্ণ পৃথিবীজুড়ে।

 

আধুনিক প্রযুক্তি ও অর্থনীতি পণ্যের বাজার বিস্তারে ব্যস্ত। প্রচার মাধ্যমে মানুষকে অবিরাম প্ররোচিত করা হচ্ছে নিত্যনতুন পণ্যসামগ্রী কেনার তাগিদ দিয়ে। চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী ক্রয় ক্ষমতা সবার বাড়ছে না তাতে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও টেনশন। পৃথিবীর অর্ধেক লোক বঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্যে জীবন কাটায়। বাকি অর্ধেকের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রাচুর্য ও বিলাসিতার মধ্যে বাস করে, বাদবাকি মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে। সম্পদের অনৈতিক ও অসম বণ্টন ব্যবস্থার কারণে সামাজিক বৈষম্য দিনে দিনে বাড়ছে, সুস্থ জীবনধারণের জন্য মৌলিক প্রাকৃতিক উপাদান যেমন জলবায়ু দূষিত ও দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে মানুষের কর্মক্রিয়ার কারণে। লাগামহীন ভোগবাদী পুঁজিবাদ যার নবযাত্রা শুরু হয় Regan Thatcher যুগের Reganomics দিয়ে তা এখনো চলমান। তবে ২০০৮-৯ সালে শুরু হওয়া বিশ্ব মন্দার ধাক্কায় কিছুটা হলেও হুঁশ হয়েছে যে free market বা মুক্তবাজারের নামে অর্থনীতিতে স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দেওয়া যায় না।

১৯২৯ সালের Great Depression বা বিশ্ব মন্দায় Adam Smith চিন্তাধারার Capitalism বা পুঁজিবাদ ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এলো ভিন্ন চিন্তাধারার পুঁজিবাদ। তার প্রবর্তক হলেন Lord Keynes| শুরু হলো যাত্রা Keyesian economics-এর। পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবস্থা বিশেষে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। সরকার বাজারের নিয়ন্ত্রক না হলেও বাজারের প্রহরী। এই চিন্তাধারার রেশ ধরে উদয় হয় Welfare Economics-এর, জম্ম হয় social democrac-র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কয়েক দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় Welfare State। আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রিগান ও যুক্তরাজ্যে মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতায় আসীন হয়ে Welfare State বা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নীতি থেকে সরে গিয়ে প্রবর্তন করলেন free market   নীতি বিশ্বব্যাপী। ২০০৯-এর বিশ্ব মন্দা আবারও প্রমাণ করল মার্কেট তার নিজের গতিতে সুস্থ ও সচল থাকে না সব সময়।

পুঁজিবাদ মানুষকে স্বার্থপর ও প্রতিযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করে। যারা স্বার্থপর হবে না তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। যে যত বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও উচ্চাভিলাষী হবে সে তত বেশি সফলকাম হবে। আমরা আমাদের জৈবিক বাসনা পরিতৃপ্ত করার প্রয়াসে সব নৈতিকতা ও মানবতা বর্জন করছি। আমরা নিজেরাই বাজারের পণ্য হয়ে গেছি।

কিন্তু আমরা আসলে জাবর-কাটা জীব নই। আমরা একমাত্র conscious বা সচেতন জীব এই গ্রহে’ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আমাদের সমাজ জীবন ‘survival of the fittest’-এর নীতিতে চললে পশু জীবনের সঙ্গে মানবজীবনের পার্থক্যটা থাকল কোথায়? আমাদের অর্থনীতি হওয়া উচিত Real income -এর মাপকাঠিতে, Money income -এর মাপকাঠিতে নয়। গ্রামের কোনো এক লোক গরিব হলেও সে বিশুদ্ধ বাতাস সেবন করছে। আর আরেকজন সচ্ছল হলেও Mega ciMega cit বা মহানগরীতে বাস করে দূষিত বাতাস সেবন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাতাসের যদি Money value ধরা হয় তা হলে গ্রামের লোকটির income এই ক্ষেত্রে শহরের লোকটির চেয়ে অনেক বেশি। যে সব জায়গায় মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস ও প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য পর্যটকরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে বেড়াতে যায় সেই সব স্থানের বসবাসকারীরা বিনামূল্যে প্রত্যহ তা উপভোগ করে। এই সুযোগের আর্থিক মূল্যায়ন কী হবে? আর্থিক মূল্যায়ন যাই হোক না হোক তার যে একটা প্রকৃত মূল্যায়ন আছে তা কি অস্বীকার করা যাবে? শুধু টাকার মাপে সব কিছুর মূল্যায়ন করার প্রবৃত্তি আমাদের পেয়ে বসেছে। আমাদের এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ভুটান এমন একটি দেশ যেখানে money income- এর চেয়ে real income-কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। G.D.P.’র (Gross Domestic Product) প্রবৃদ্ধি দিয়ে নয় .D.H. (Gross Domestic Happiness)-এর মাপদন্ড জীবনের মান নির্ণয় করা হয়। Per Capita income-এর চেয়ে Per Capita happiness বেশি কাম্য। যদি অবাধ Tourism-এর সুযোগ দেওয়া হতো তাহলে দেশটি আর্থিক মানদন্ডে অনেক বেশি বিত্তশালী হতে পারত। অতি মাত্রায় পর্যটক ভিড় জমালে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় ভুটান সরকার প্রতি বছর সীমিত সংখ্যক লোককে পর্যটনের ভিসা দেয়। টাকার গরিমার চেয়ে সুখ ও শান্তির পরিবেশ তাদের কাছে বেশি কাম্য। আজকের দূষিত জলবায়ু ও দুর্নীতিপ্রবণ মানুষের পৃথিবীতে ভুটান একটি ব্যতিক্রমধর্মী শান্তি, সুখ ও সুশাসনের আদর্শিক দেশ।

আমরা Money income-এ বেশি আগ্রহী Real income-এর চেয়ে। Money market এখন নিয়ন্ত্রণ করে productive marke-কে। তাই সব কিছু হয়ে পড়েছে সড়হবু নির্ভর। যাদের হাতে যত টাকা তাদের তত প্রতাপ। Money medium of exchange অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম না হয়ে যাতে monster-এ পরিণত না হয় অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক না হয়ে না দাঁড়ায় সে জন্যই বোধহয় ইসলামে সুদ বারণ করা হয়েছে। ওই ব্যবস্থায় medium of exchange স্থিতিশীলতা হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করে। রাজনীতিও টাকানির্ভর। কোটি কোটি টাকা খরচ না করলে সংসদ সদস্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামা কঠিন। আমেরিকায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার না হলে সিনেটর হওয়ার প্রতিযোগিতায় যাওয়া যায় না।Money talks, money wins.

উন্নয়নের অভিযাত্রায় আমরা দ্রুত প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করে ফেলছি, পরিবেশ বিষাক্ত করছি, বপড়ষড়মরপধষ ভারসাম্য নষ্ট করছি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছি। বর্তমানের সুখ ও প্রাচুর্যের জন্য ভবিষ্যতের সুখ ও শান্তি জলাঞ্জলি দিচ্ছি, বিপন্ন করে তুলছি ভবিষ্যৎ জীবন।

বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করতে হলে চাহিদার হার অর্থাৎ rate and range of consumption কমাতে হবে এবং জীবনধারা অর্থাৎ life style বদলাতে হবে যা প্রচলিত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মেনে নেওয়া কঠিন। রাজনীতিবিদরা ২০ বছর পরে কী হবে সেই চিন্তা করে রাজনীতি করেন না সুদূর ভবিষ্যতের কথা না হয় বাদ দিলাম। তারা কোন সুযোগে ক্ষমতায় যাবেন এবং কি করে ক্ষমতায় বহাল থাকবেন সেই চিন্তা ও কৌশল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। চাহিদার আগুন প্রশমিত করে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন যেমন খাদ্য, বাসস্থান, সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য পূরণের অর্থনীতি ও রাজনীতি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। গতানুগতিক রাজনীতি ও অর্থনীতি দিয়ে সে আশা পূরণ সম্ভব নয়। সেই জন্য প্রয়োজন হবে চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন। প্রয়োজন হবে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের। সত্যিকারের নেতা সেই যে মানুষকে পরিচালনা করে, মানুষ কর্তৃক পরিচালিত হয় না। Leader Ges politician-দের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, মহাত্মা গান্ধী হলেন leader আর মিসেস ইন্দিরা গান্ধী হলেন politician। আমেরিকায় যেমন আবরাহাম লিঙ্কন হলেন politician আর রিচার্ড নিক্সন হলেন ঢ়ড়ষরঃরপরধহ। রাজনীতি এক আকর্ষণীয় পেশা- মানব সেবায় নিবেদিত কোনো সাধনা নয়।

নৈতিকতা ও মানবিকতা বিবর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও রাজনীতি কখনো মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত করতে পারে না- মানব ইতিহাসই তার সাক্ষ্য।

সবার জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের পরিপন্থী আধুনিক জীবনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা ও জীবনধারার কারণে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে আগামীতে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন তা নিয়ে কোনো কথাবার্তা হতে দেখি না। শুধু কার্বন নির্গমন রোধ করার আলোচনা নিয়ে দরকষাকষি ও শেষ পর্যায়ে প্রায় ভেস্তে যাওয়া কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত মহাসমাবেশ একটা জোড়াতালির অঙ্গীকারে পর্যবসিত হয়েছে। পরিবেশ সংক্রান্ত ইদানীং সমাপ্ত প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনেও কথাবার্তা ও হাঁক-ডাক অনেক হয়েছে কিন্তু কার্যত বিশেষ কিছু হয়নি এখনো। বিশ্বখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী জেইমস হেনসেন এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘একগাদা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ বলে। যাকে বলা যায় face saving সমাধান। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে নব্য নির্বাচিত কাজ্ঞানহীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবিবেচক ঘোষণা যে তিনি প্যারিস সম্মেলনের সমঝোতা চুক্তি মানবেন না। কেননা তিনি মনে করেন অতিমাত্রায় কার্বন নির্গমনের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা যে সব কথাবার্তা বলছেন ও সতর্ক করছেন তা সবই ভুয়া। যে ব্যক্তি জেগে ঘুমায় তাকে জাগানো যায় না। এই যখন বিশ্ব পরিস্থিতি তখন মানব সৃষ্ট প্রলয় থেকে বাঁচার উপায় কী ভেবে পাই না। মানবিক অধিকার বা human rights বলতে কে কী বুঝে জানি না। আমার বুঝ অনুযায়ী সবার জন্য বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান  অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, সুস্বাস্থ্য ও সুশিক্ষা মানবিক অধিকার পূরণের পূর্বশর্ত। এখন সেই লিস্টে যোগ দেওয়া জরুরি বিশুদ্ধ জলবায়ুর নিশ্চয়তা। প্রকৃতির wake up call অগ্রাহ্য করে চিরাচরিত জীবনধারায় গা ভাসিয়ে দিলে যখন ফরংঃৎবংং পধষষ আসবে তখন আর সময় থাকবে না রক্ষা পাওয়ার। কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে বিক্ষোভকারী মিছিলের প্রধান দাবি ছিল System change। System change না হলে climate change রোধ করা যাবে না। কবে আসবে সেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তন, না আসবেই না, কে জানে।

আমার দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এখন এই উপলব্ধিতে এসেছি যে ,system বদলালেই যে সমস্যার সমাধান হবে তাও ঠিক নয়। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যাই হোক, যে সমাজে নৈতিকতা ও মানবিকতার কোনো দাম নেই, দাম আছে শুধু প্রযুক্তি ও পণ্যের, ক্ষমতা ও সম্পদের সেই সমাজ বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। ইতিহাস তাই বলে। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের মূলে কমিউনিস্ট পার্টিতে দুর্নীতির বিস্তার, সমাজতন্ত্রের দুর্বলতার কারণে নয়। কোরআনে আল্ল­াহ বলেছেন যে, আমরা মাটি খুঁড়লেই দেখতে পাব কত শত জনপদ ও সভ্যতা নৈতিকতা ও মানবিকতার স্খলনে ধ্বংস হয়ে মাটিচাপা পড়ে আছে। নৈতিকতা ও মানবতা বোধের চরম অবনতি যখন ঘটে স্রষ্টা তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে সেই সমাজকে ধ্বংস করে দেন।

আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ আর অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতাÑ এ দুয়ের প্রভাবে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ধসে পড়বে আধুনিক সভ্যতা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণা শেষে এমন ভবিষ্যদ্বাণীই করেছেন বিজ্ঞানীরা। একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তিতে গবেষণাটি করেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমান সভ্যতার পতন হওয়ার আগেই সমাজের অভিজাতদের ‘যেমন চলছে চলুক’ নীতির ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অভিজাতরা যদি এখনই অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তাহলে সভ্যতার এই সম্ভাব্য ধ্বংস এড়ানো যেতে পারে।

জার্মান দার্শনিক Fridrich Hegel ও আরব দার্শনিক ইবনে খালেদুনের চিন্তাধারা অনুযায়ী ইতিহাসের গতিধারা পরিচালিত হয় আদর্শিক দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায়। আর জার্মান দার্শনিক Carl Marx-এর তথ্য অনুযায়ী ইতিহাস রচিত হয় সমাজে শ্রেণি দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়ায়। Hegel ও খালেদুনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো idealistic আর Marx-এর দৃষ্টিভঙ্গি হলো materialistic.

যে দৃষ্টিতেই আমরা ইতিহাসকে দেখি না কেন, এটা ধ্রুব সত্য যে নৈতিকতা ও মানবিকতা মানব সমাজের এই দুই স্তম্ভ ব্যতিরেকে মানব সভ্যতা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না।

আধুনিক মানুষ মনে করে আমাদের সেবায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতদিন আছে এবং আইনের শাসন আছে ততদিন আমাদের এই কালের অগ্রযাত্রা কোনো কিছুই রোধ করতে পারবে না। শুধু প্রযুক্তিপ্রাপ্ত নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও উপকরণ এবং মানব তৈরি আইনের শাসন দিয়ে মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না যদি বিবেকের অনুশাসন ও মানবিকতার স্নিগ্ধ ধারা সেখানে না থাকে। বিবেকহীন জীবন লাগামহীন জীবন। মানবিকতাশূন্য জীবন অন্তঃসারশূন্য জীবন। না স্রষ্টা না বিবেক আমরা যদি কোনোটাই না মানি, আমরা যদি শুধু বুদ্ধিচালিত ও রিপু তাড়িত Hedonistic জীবনধারায় গা ভাসিয়ে দিই তাহলে আজকের সভ্যতা ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগবে না।

লেখক : সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর