বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগের কাছে অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়

পীর হাবিবুর রহমান

আওয়ামী লীগের কাছে অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়

আওয়ামী লীগ হচ্ছে এ দেশের তৃণমূল বিস্তৃত রাজনৈতিক সংগঠন। গরিবের দল হিসেবে বটবৃক্ষের মতো এর শিকড় ছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে ছড়ানো। দলটি একসময় ছিল একচ্ছত্র জনপ্রিয়। গণমুখী নেতা-কর্মীর আদর্শিক ত্যাগের মনোভাবে মানুষের কল্যাণে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা গৌরবময় এক গণসংগঠন। আর এই আদর্শের উৎস জাতির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মের পর থেকে দফায় দফায় যত দুর্যোগ আসুক না কেন নেতা-কর্মীদের প্রাণ আকুল করা ডাকে ‘মুজিব ভাই’ মানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হালই ধরেননি, চূড়ান্ত বিকাশই করেননি, তুমুল জনপ্রিয় দলে পরিণত করেছিলেন। সেই দল বঙ্গবন্ধুর মহান আত্মত্যাগের আদর্শিক, সৎ, গণমুখী রাজনৈতিক চরিত্র একালে এসে কতটা ধরে রাখতে পেরেছে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর আদর্শিক কমিটেড সংগঠককে নেতৃত্বে যেমন ঠাঁই দিয়েছেন, তেমনি তৃণমূল থেকে জাতীয় রাজনীতিতে তুলে এনেছেন। সাধারণ পরিবারের উকিল-মোক্তার, মাস্টার যারা কখনো জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্নও দেখেননি, তাদের এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছেন। আজকের আওয়ামী লীগ দলের আদর্শিক গণমুখী চরিত্রের অর্থ-বিত্তহীন সংগঠকের কতটা মূল্যায়ন করে সেই প্রশ্ন থেকে যায়। একদা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল জননেতার মুকুট পরে নেতারা ইমেজ নিয়ে সৎ-সরল নিরাভরণ জীবনে যেভাবে মানুষের সম্মান কুড়াতেন একালে তা কেন অদৃশ্য— কেউ ভাবেনওনা কেন?

আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই সরকার আর দল একাকার হয়ে যায়। একদল সুবিধাভোগী লুটেরা শ্রেণি কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে, নয় হঠাৎ নেতা হয় কিংবা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে ক্ষমতার ষোলো আনা ভোগ করে যায়। ভোগের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাঁধে চড়ে ষোলো আনা সুখ নেয় এ চক্রটি। অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়। আর আওয়ামী লীগ নামের দলটির আদর্শিক চরিত্র হনন করে চলে যায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে এদের নীরব প্রস্থান ঘটে। বাতি জ্বালিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন আসল আওয়ামী লীগ কর্মীরা পুলিশের মার খায়, প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়। তবু কামড় খেয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে দলকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে।

এক আড্ডায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রতি  ভীষণ অনুগত তাঁর একসময়ের সহকর্মী আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বলেছিলেন, সিক্সটিন ব্রিগেড একসময় এসেছিল, তারপর ঊনত্রিশ ব্রিগেড এসে ভর করেছে আওয়ামী লীগে। সিক্সটিন ব্রিগেড মানে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর ক্ষমতাসীন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর যে সুবিধাভোগী চক্রটি ভর করে মৌমাছির মতো নাচতে নাচতে ক্ষমতার মধু আহরণ করে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে দলের জন্য নেমে আসা গভীর অন্ধকার সময়ে ঠিকঠাকভাবে কেটে পড়েছিল, সেই চক্রটিকে বোঝানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের যে নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন থেকে ষাটের অগ্নিঝরা সেনাশাসনকবলিত দুঃসময়ে দলের জন্য পরিশ্রম করেছিলেন, ছয় দফাকে ছড়িয়েছিলেন, ঊনসত্তরের আগুন জ্বালিয়েছিলেন, আইয়ুবের পতন ঘটিয়ে কারাবন্দী শেখ মুজিবকে জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নায়কোচিত একক নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন, সত্তরের গণরায়ে ব্যালট বিপ্লব ঘটাতে নৌকার গুণ টানা মাঝি হয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বিজয়ের পর তারা সেদিন ক্লান্ত ও বিষণ্ন অভিমানী হৃদয়ে দূরে সরে যান। আর সুবিধাবাদীরা ক্ষমতানির্ভর আওয়ামী লীগে ভোগবাদী সংস্কৃতির আস্ফাালন ঘটিয়েছিলেন।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাত চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসতার শিকারই হননি, আওয়ামী লীগ নামের দলটির ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন নেমে এসেছিল। দলের প্রথম সারির চার নেতা কারাগারে জীবন দিয়েছেন। এক নেতা বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করে অবৈধভাবে খুনিদের রাষ্ট্রপতি হয়ে ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়েছেন। তিনি মীরজাফর-খ্যাত খুনিদের প্রেসিডেন্ট খুনি মোশতাক। খুনির চেহারা নিয়ে তিনি যেমন সারা জীবন করা দলটির প্রতি ছিলেন নিষ্ঠুর, তেমনি তাঁর হাত থেকে চলে যাওয়া ক্ষমতা নিয়ে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানও ছিলেন সেই ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার। তাঁর সমর্থকরা বহুদলীয় গণতন্ত্র আর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের অসাড় যুক্তি দাঁড় করালেও নির্মম সত্য হচ্ছে, সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশে সেদিন ঘোর অন্ধকার সময় নেমে এসেছিল। সামরিক শাসক আর অতিবিপ্লবীদের প্রতিহিংসার বিষের তীরে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। সেদিন কারাগার, নয় পলাতক অথবা পাশের ভারতে নির্বাসন হয়েছিল তাদের ঠিকানা। সেই দুঃসময়ে কারাগার হয়েছিল কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রায় সব নেতার ঠিকানা।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে সামনে রেখে মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীরা আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে ’৭৭ সালে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন কাজ শুরু করলেও ’৭৮ সালের কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি, আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক ও তোফায়েল আহমেদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ায়। সে সময় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামই নিষিদ্ধ হয়নি, আওয়ামী লীগ থেকেও নিরাপদ দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন অনেকেই। আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথে আদর্শিক নেতা-কর্মীরা সেদিন আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে ঘিরে আওয়ামী লীগ একটি আদর্শিক ও সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করা তারুণ্যের শক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল। যদিও দলের ষোলো আনা নেতা-কর্মী দলের মধ্যমণি আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ছিলেন। যদিও সেদিন সেনাশাসকদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাপতি জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে জোটপ্রার্থী করে মাঠে নামতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। ’৭৯ সালে প্রহসনের সাজানো ভোটে ৩৯ আসন নিয়ে সংসদে বিরোধী দল হতে হয়েছিল আওয়ামী লীগকে। সে ভোটে রাজ্জাক প্রার্থী হননি। মালেক উকিল ও তোফায়েলকে জিততে দেওয়া হয়নি। তখনো দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, সৎ, গণমুখী রাজনীতিবিদরা ছিলেন দলের নেতৃত্বে। পোড় খাওয়া কর্মীরা ফিনিক্স পাখির মতো জন্ম নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রলীগকে আওয়ামী লীগের শক্তি হিসেবে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত করছিলেন। সেই অমিত সাহসের উৎস ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দল এবং মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট। অর্থ-বিত্ত, অস্ত্র, ক্যাডারের প্রয়োজন তাদের পড়েনি। নেতৃত্বের কোন্দল তীব্র হয়ে উঠলে জনগণের মাঝে দলকে আরও জনপ্রিয় করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালে দিলিস্নতে নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়েছিল। তাঁর নেতৃত্ব, সাহস ও দীর্ঘ সংগ্রাম ভাঙনকবলিত দলকে ঐক্যবদ্ধই করেনি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তির পস্ন্যাটফরমই তৈরি করেনি, আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধুর পর দ্বিতীয়বারের মতো তৃণমূল বিস্তৃত জনপ্রিয় দলে পরিণত করে শক্তিশালী রূপ দেয়।

দীর্ঘ ২১ বছর পর তাঁর হাত ধরে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফসল হিসেবে দলটি ক্ষমতায় আসে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার হাত ধরে ’৯১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপির প্রথম পাঁচ বছরের শাসনামল যেমন উত্তম, তেমনি শেখ হাসিনার প্রথম ’৯৬-২০০১ শাসনামল ছিল স্বর্ণযুগ। রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন হাত ধরাধরি করে হেঁটেছিল। সেবারও ক্ষমতায় আসার পর পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ আদর্শিক নেতা-কর্মীদের একটি অংশ সবখান থেকে ছিটকে দূরে সরে যায়। অন্যদিকে আবার একদল সুবিধাভোগী ভর করলেও রাহুগ্রাস ঘটাতে পারেনি।

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে নেতৃবৃন্দ ও দলীয় পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা একে ষড়যন্ত্রের মোড়কেই কেবল বিচার-বিশেস্ন্লষণ করেছেন। কিন্তু সেদিন চারদলীয় জোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগের মহাজোট করে ভোটযুদ্ধ না করা যে পরাজয়ের বড় কারণ তা খতিয়ে দেখেননি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের নবযাত্রার প্রথম শাসনামলের সুন্দর ধারাকে হারিয়ে ফেলে। দিগ্্ভ্রান্ত ক্ষমতার উন্নাসিকতায় আত্মঅহংকারে বিএনপি-জামায়াত জোট দুর্নীতি ও অপশাসনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর, সংখ্যালঘুদের ওপর অবর্ণনীয় হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ঘরবাড়িছাড়ার মতো প্রতিহিংসার চূড়ান্ত আঘাত ঘটায়। বোমা, সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। বিএনপি-জামায়াত জোটে সুবিধাবাদীরা ভর করে।

২০০১ সাল থেকে ওয়ান-ইলেভেন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর নেতা-কর্মীদের জন্য কঠিন এক অশুভ সময় নেমে আসে। একুশের গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাদের উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। সেই দুঃসময়েও শেখ হাসিনার সঙ্গে একদল সাহসী, আদর্শবান নেতা-কর্মী রাজনৈতিক সহযোদ্ধা পাশে থাকলেও ক্ষমতার কালে উড়ে আসা বসন্তের কৌকিলরা আহরিত মধু নিয়ে উড়ে উড়ে চলে যায়। মাঠের লড়াইয়ে অগ্নিপরীক্ষা দেন নেতা-কর্মীরা। কেউ দেশ ছাড়েন, কারও শরীরে বোমার আঘাতে ক্ষতচিহ্ন দেখা দেয়, কেউ জীবন দেন, কেউ আহত ও পঙ্গু হন। জেল রিমান্ডে যেতে হয় অনেককে। সেই সময় সরকারবিরোধী জনমত আওয়ামী লীগের অনুকূলে বইতে শুরু করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র দিয়ে অর্থ ও ক্যাডার সংস্কৃতির ওপর পথ হেঁটেছিল শাসকরা। সেই শক্তি তাদের শেষ রক্ষা হতে দেয়নি।

ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ, নির্যাতন ও জেলের শৃঙ্খল ভেঙে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোদ্ধারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে গণরায়ে বিশাল বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় আসেন। আবার ক্ষমতার ওপর এসে ভর করে রাতারাতি সুবিধবাদীরা হয়ে যায় বড় আওয়ামী লীগ। এদের বলা হয় ২৯ ব্রিগেড। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে নৌকার বিজয় ঘটতেই কাউয়ার দল উড়ে এসে ভিড়ে যায় ২৯ ডিসেম্বর থেকে। আওয়ামী লীগের কাছে এই প্রশ্ন থেকে যায়, বিরোধী দলে থাকাকালে যে আওয়ামী লীগ কঠিন নির্যাতন ভোগ করেছে, সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিনে দিনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কেন দমননীতির মাত্রা এতটা বাড়িয়েছে? প্রশ্ন থেকে যায়, সেই আওয়ামী লীগ কেন সরকার আর দলে একাকার হয়ে যায়? আবার কেন দুঃসময়ের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতা-কর্মীরা দূরে ছিটকে পড়ে যায়? বিরোধী দলে থাকতে যেখানে মিছিলে লোক পাওয়া যেত না, নির্যাতিত, পঙ্গু, আহত মানুষ ও কর্মীর পাশে শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি, সেখানে আজ ১০ বছরের শাসনামলে যত দূর চোখ যায়, তত দূর কীভাবে সব আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ হয়ে যায়? আর সেই সুবিধাবাদীরা হাইব্রিড কাউয়া গালি খেয়েও বহাল তবিয়তে থেকে যায়? আওয়ামী লীগ নামের গণমানুষের দল ক্ষমতায় থাকাকালে কীভাবে স্থানে স্থানে একদল এমপি-নেতা-কর্মী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে? উন্নাসিক-দাম্ভিক আচরণে সরকারবিরোধী অসন্তোষ বাড়ায়? এতবার বেদনার চিহ্ন বুকে নেওয়া কঠিন বিপর্যয়ের মুখে পতিত হওয়া আওয়ামী লীগ কীভাবে ভুলে যায় ‘সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারও নয়’?

আওয়ামী লীগ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লড়াইয়ের আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত হয়ে যখন ক্ষমতায়, তখন কেন অনেকেই বিরুদ্ধমত সহ্য করার মতো, সমালোচনা সইবার মতো ধৈর্য ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যে আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছে, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কণ্ঠ সারা দেশে ছড়িয়েছে, মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করেছে, সেই মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে কেমন করে সংসদ ও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়? গরিবের দল আওয়ামী লীগ, কর্মীর দল আওয়ামী লীগে কীভাবে আজ আদর্শিক নেতৃত্বের বিপরীতে উঠে আসে অর্থ-বিত্ত ও পেশিশক্তির মুখগুলো? কীভাবে তৃণমূল নেতৃত্বেও হারিয়ে যায় আদর্শিক সেই গণমুখী, পরিচ্ছন্ন ইমেজের কর্মীরা, পেশা যাদের আইন ব্যবসায় বা শিক্ষকতা? আজকের আওয়ামী লীগের বড় ধরনের কর্মসূচিতে মঞ্চে কেন যুগের পর যুগ ধরে বহমান ধারাকে উপেক্ষা করে ঠাঁই দেওয়া হয় না দলের ওয়ার্কিং কমিটিকে?

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশ ও মানুষের কল্যাণে অপ্রতিরোধ্য গতিতে যেখানে তাঁর স্বপ্নের দরজায় পা দিতে ছুটছেন, দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটছে, দেশের বিদ্যুৎ খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপ্লব ঘটিয়ে যোগাযোগব্যবস্থায়, কৃষিতে সাফল্য তুলে পদ্মা সেতুর মতো এত এত দৃশ্যমান উন্নয়ন— তার পরও কেন এত সমালোচনা সইতে হয়? কেন শেয়ারবাজার, ব্যাংকিং খাত একের পর এক লুট হয়ে যায়? হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়? কারও শাস্তি হয় না! একেকটি ব্যাংক তছনছ হয়ে গেলেও কাউকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না, কারাবরণ করতে হয় না। এ প্রশ্নগুলো থেকে যায়। আজকের আওয়ামী লীগে বা শেখ হাসিনার পাশে দুর্দিনের মানুষগুলোকে কখনো সখনো কেন খুঁজে পাওয়া যায় না? একটি কথা প্রচলিত ছিল, আওয়ামী লীগ কেউ হতে পারে না, আওয়ামী লীগ হয়ে জন্মাতে হয়। সেই সত্য আজ আওয়ামী লীগে কেন নির্বাসিত হতে চলেছে? আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ যদি হয় বিএনপি, সেখানে সেই দলের স্থায়ী কমিটির চেহারার সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম এত দুর্বল কেন? আওয়ামী লীগের মতো দল যেখানে ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেখানে দল ও সরকারের নেতৃত্বে সেখানে তাঁর দুঃসময়ের নৌকার মাঝিরা আজ কোথায়?

শেখ হাসিনা যেখানে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অহংকারের অর্জনের ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও তার সন্তানদের জন্য আপসহীন, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন, সেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন এমপির হাত ধরে এত জামায়াত ও বিএনপির মামলা খাওয়া লোকজন কীভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন? এদের চিহ্নিত করে বের করে দেওয়া বা সেই এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত বা ব্যবস্থা গ্রহণে আওয়ামী লীগ কেন নীরব? এভাবে কত জায়গায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে? কত খাতে? এক সুনামগঞ্জে ঘোষিত জেলা কমিটিতে বিভিন্ন দল থেকে আসা ৩৫ জনের ঠাঁই হলেও পঁচাত্তর-পরবর্তী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের একজন ছাড়া কারও কেন ঠাঁই হলো না? এই বিচার চেয়ে পোড় খাওয়া দুঃসময়ের নির্যাতিত কর্মীরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও কেন জবাব পেলেন না? আওয়ামী লীগের সর্বশেষ স্থানীয় নির্বাচন ও রাজনীতি ঘিরে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে অনেক এমপি, স্থানীয় নেতা শোকজ নোটিস পেয়েছেন। অথচ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গরিবের দল আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে হয়ে যাওয়া সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে ঘটে যাওয়া মনোনয়ন বাণিজ্যের কোনো তদন্ত কেন করতে পারেনি?

রাজধানীর চকবাজার থানা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল আজিজুল্লাহ মৃত্যুর ২৮ মাস পর কীভাবে ককটেল ছুড়ে মারার অভিযোগে পুলিশি মামলার অভিযুক্ত আসামি হন? এই অতি-উৎসাহী আওয়ামী লীগার শুধু প্রশাসনেই নয়, সর্বত্র কীভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে? শেখ হাসিনার চেয়েও সুদিনে অনেক বড় আওয়ামী লীগার দৃশ্যমান হন, দুঃসময়ে তারা কোথায় যান? ক্ষমতার ১০ বছরে আওয়ামী লীগ কি ফিরে দেখেছে ’৭৫ থেকে ’৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৮ সালের বিপদের সময়ের সেই সাহসী সব সহযাত্রী কোথায়?

নির্বাচন দুয়ারে। আড়াই কোটি নতুন ভোটার। যাদের হৃদয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রস্ফুটিত হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নানা ঘটনায় তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। এই তারুণ্য বিএনপির অপশাসন ভুলে গেছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বড় হতে হতে ভোটার হয়েছে। তাদের বুকের ভাষা গণমুখী দল আওয়ামী লীগ কতটা শুনতে পাচ্ছে? জেলায় জেলায় একদল উন্নাসিক, ক্ষমতানির্ভর, সুবিধাবাদী যেমন লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছে, তেমনি জাতীয়ভাবে একটি চক্র হরিলুটে নামতে নামতে লুটেরা গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এদের লাগাম ধরতে আওয়ামী লীগ কি ব্যবস্থা নিচ্ছে? উন্নয়ন যেমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে ইতিহাসে অমরত্ব দেয়, তেমনি ব্রিটিশের শাসন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মতো শেখ হাসিনার উন্নয়ন হয়তো মুজিবকন্যাকে অমরত্ব দেবে। কিন্তু উন্নয়নই কি জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতায় ফিরে আসার একমাত্র শক্তি? যদি গণতন্ত্র ও সুশাসন পায়ে পায়ে না হাঁটে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা যদি না থাকে আওয়ামী লীগ এর জবাব কী দেবে? আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন থেকেই যায়, দলটি আজ নিবেদিতপ্রাণ আদর্শিক নেতা-কর্মীদের খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করবে, নাকি সুযোগসন্ধানী সুবিধাভোগী শ্রেণিটিকেই লালন করে যাবে?

আওয়ামী লীগের প্রথম দফার নির্বাচনী ট্রেনযাত্রা সুশৃঙ্খলই ছিল না, পথে পথে গণজাগরণ ঘটানো অভূতপূর্ব দৃশ্য উন্মোচিত করেছে। দলটির জন্য এটি সুসংবাদ হলেও গণতন্ত্রের জন্য প্রশ্ন থেকে যায়, এই সুযোগ বিরোধী দলগুলোর জন্যও সমান প্রাপ্য হবে কিনা? সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা যেমন বলে দিচ্ছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে থাকবেন, নির্বাচন কবে হবে এবং তিনি নির্বাচন করবেন না তাঁর ভাই করবেন। সেখানে প্রশ্ন থেকে যায়, এই এখতিয়ার তিনি রাখেন নাকি প্রধানমন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন ও দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড রাখেন? তাহলে সরকারের শৃঙ্খলা কোথায় থাকে? এমনিতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য মানুষকে হতাশ করেছে। নির্বাচন কমিশনকে দুর্বল করেছে।

অতিকথন বন্ধে কিংবা সহনশীলতার পথে কোনো পক্ষই হাঁটছে না। বহুবার আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিপর্যয়ে পড়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে অগণতান্ত্রিক শাসনের চেয়ে ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক শাসনই উত্তম। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সংবিধান ও আইনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের সামনে কী অঙ্গীকার নিয়ে এসেছে— সেই প্রশ্নও থেকে যায়।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর