শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মর্যাদাবান এক অন্ধ সাহাবি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মর্যাদাবান এক অন্ধ সাহাবি

বাহ্যিক চোখের আলো ছিল না তাঁর। তবে অন্তর চোখের আলো ছিল ঠিকই। তাই তো তিনি হতে পেরেছেন ‘খাইরুল কুরুনির’ প্রথম সারির সদস্য। হতে পেরেছেন প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রিয় সহচরদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি হলেন বিখ্যাত অন্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)। ইরাকিদের কাছে তিনি আমর ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) নামে পরিচিত। ‘মাকতুম’ অর্থ অন্ধ আর ‘উম্মে’ অর্থ মা। তার মা হজরত আতিকা (রা.) তাকে অন্ধ অবস্থায় প্রসব করেছেন। তাই তার মাকে ‘উম্মে মাকতুম’ বা অন্ধের মা উপনামে ডাকা হতো। পিতা কায়েস বিন যায়েদ আরবের বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি মায়ের নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। রিজাল শাস্ত্রে অসংখ্য সাহাবি, তাবেয়ি এবং তাবে তাবেয়ি আছেন যারা পিতার নামের পরিবর্তে মা, দাদা, দাদি, নানা কিংবা নানীর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) তাদেরই একজন।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান (রহ.) এর মতে, ‘তাঁর নাম ছিল হুসাইন। রসুল (সা.) রাখলেন আবদুল্লাহ।’ তিনি ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)-এর আপন মামাতো কিংবা ফুফাতো ভাই। সেই হিসেবে তিনি রসুল (সা.)-এর শ্যালক হন। প্রথমদিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি এবং ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘হুয়া মিম্মান আসলামা কাদিমান’। অর্থাৎ ‘তিনি একেবারেই প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ ইসলাম গ্রহণের কারণে তাকেও নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। শত নিপীড়নের মুখেও তিনি দ্বীনুল ইসলাম থেকে একচুল সরে দাঁড়াননি। নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের আদেশ আসে। আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-ই ছিলেন মদিনায় হিজরতকারী প্রথম দুজনের একজন। তাঁর সঙ্গে হিজরত করেছেন মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)। উম্মে মাকতুম (রা.) মুসআব (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন আর কোরআনের দাওয়াত দিতেন। এ সম্পর্কে মদিনার আনসার সাহাবি হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বলেন, ‘রসুল (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যে সর্বপ্রথম উম্মে মাকতুম এবং মুসআব (রা.) মক্কা থেকে হিজরত করে আমাদের কাছে আসেন। এবং তারাই প্রথম আমাদের মাঝে কোরআনের তালিম দেন।

আল্লাহর নির্দেশে রসুল (সা.)ও মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় এসে রসুল (সা.) উম্মে মাকতুম এবং বিলাল (রা.)-কে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেন। কখনো বিলাল (রা.) আজান দিতেন আবার কখনো উম্মে মাকতুম (রা.) আজান দিতেন। একজন আজান দিলে আরেকজন ইকামত দিতেন। রমজান মাসে বিলাল (রা.) সাহরির আজান দিতেন আর উম্মে মাকতুম (রা.) দিতেন ফজরের আজান। এ সম্পর্কে সহি বোখারিতে হাদিসও এসেছে। রসুল (সা.) যখন মদিনার বাইরে যেতেন, উম্মে মাকতুম (রা.)-কে নিজের প্রতিনিধি করে যেতেন। শত শত সাহাবি তার পেছনেই নামাজ পড়তেন রসুল (সা.)-এর অনুপস্থিতিতে। তিনি নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করতেন। মসজিদ থেকে বাড়ি দূরে থাকা সত্ত্বেও তিনি জামাত ত্যাগ করতেন না। তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি ছিলেন পবিত্র কোরআনের হাফেজ।

এ মহান সাহাবিকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিব রসুল (সা.)-কে মৃদু ধমক দেন। শুধু তাই নয় উম্মে মাকতুম (রা.)-কে কেন্দ্র করে পবিত্র কোরআনের মোট ষোলোটি আয়াত নাজিল করেন আল্লাহতায়ালা। ঘটনাটি ছিল এরকম। একদিন রসুল (সা.) মক্কার নেতাদের সঙ্গে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ করছিলেন। ওই বৈঠকে আবু জাহেল, উমাইয়া, উতবা, শায়বা, মুগিরার মতো বাঘা বাঘা নেতা উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় উম্মে মাকতুম এসে বলল, ‘হে আল্লাহর নবী (সা.)! মহান আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন সে ইলম থেকে আমাকে কিছু শিখিয়ে দিন।’ রসুল (সা.) উম্মে মাকতুমের প্রতি মনোযোগী না হয়ে নেতাদের প্রতিই মনোযোগী রইলেন। কাফের সরদাররা অন্ধ মানুষটিকে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এ অবস্থায় রসুল (সা.)ও উম্মে মাকতুমের প্রতি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। কাজটি পছন্দ হয়নি আল্লাহর। রহমাতাল্লিল আলামিন তো কারও দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আবাসার ১-১৬ আয়াত নাজিল করে বললেন, ‘সে ভ্রু কুঁচকালো। এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার কাছে অন্ধ মানুষটি এসেছে। হে নবী! আপনি কেমন করে জানবেন—হয়তো সে পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত’ (সূরা আবাসা : ১-৪)।

জন্মান্ধ হওয়া সত্ত্বেও উম্মে মাকতুম (রা.) কখনো কখনো জিহাদে অংশগ্রহণ করতেন। আল ইসাবা গ্রন্থের লেখক এমনটিই বলেছেন। তিনি মানুষকে বলতেন, ‘দেখো! আমি অন্ধ। ইসলামের পতাকা হাতে আমাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেবে। অন্ধ হওয়ার কারণে রাস্তাঘাট আমার অজানা-অচেনা। তাই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও জিহাদের ময়দান ছেড়ে পালানোর সম্ভাবনা নেই। যেমনটি তোমাদের চক্ষুষ্মানদের জন্য রয়েছে।’ বলেছেন যা, করেছেনও তা। ইবনে সাদ তার তাবাকাতে উলেস্ন্লখ করেছেন, দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে কাদেসিয়ার যুদ্ধে তিনি ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে কাফেরদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। যখন তাঁর হাতে পতাকা দেওয়া হয়, তখনই তিনি বলেছেন, এ পতাকা সমুন্নত রাখব না হয় শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করব।’

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।     www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর