শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আধুনিক নেট হাউসে জারবেরা, ফুল চাষে নতুন বিপ্লব

শাইখ সিরাজ

আধুনিক নেট হাউসে জারবেরা, ফুল চাষে নতুন বিপ্লব

কয়েকদিন আগে ‘টিউলিপ ফিভার’ নামের  একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম, সেখানে সতেরো শতকে নেদারল্যান্ডসে টিউলিপ মেনিয়া পিরিয়ডের কিছুটা ইতিহাস ও আবহ উঠে এসেছে। ‘টিউলিপ ফিভার’-এ দেখলাম, সে সময় নতুন জাতের টিউলিপ নিয়ে ছিল চরম উত্তেজনা। টিউলিপের গাছ হয় টিউলিপ বাল্ব (কন্দ) থেকে, যেমন পিয়াজের গাছ হয় পিয়াজের কন্দ থেকে। টিউলিপের বাল্ব নিয়ে বসত নিলামের আসর। নিলামে নিমেষেই কেউ হয়ে উঠত ধনী। আবার কেউ হয়তো ধনী থেকে হয়ে যেত নিঃস্ব। এমনকি ধর্মীয় উপাসনা কেন্দ্রগুলোও জড়িয়ে গিয়েছিল টিউলিপ জ্বরে। নতুন জাতের টিউলিপ আবিষ্কারের চেষ্টা তখন থেকেই। ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের সেই ফুলের রাজ্য ঘুরে এসেছি, বিশেষ করে কুকেনহফ। দেখে এসেছি ফুল কীভাবে বদলে দিয়েছে তাদের অর্থনীতি। ফুলের রঙে কীভাবে রঙিন হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। প্রায় ৩০০ বছর পরও টিউলিপ নিয়ে এখনো চলছে নানা গবেষণা।

বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়। আশির দশকে যশোরের ঝিকরগাছায় যে বিপ্ল­বের শুরু হয়েছিল তা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ফুলের বাজার দখল করে রেখেছিল ভারত। মনে পড়ে আমার বিয়ের সময়কার কথা। বন্ধু নান্নু তখন বাংলাদেশ বিমানের ইঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্রে তাকে নিয়মিত ঢাকা-কলকাতা করতে হতো। সে সময় এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি সিনেমার রমরমা অবস্থা। সিনেমায় বিয়ের দৃশ্য মানেই বর-কনের গলায় রজনীগন্ধা-গোলাপ ফুলের মোটা মালা- এ দৃশ্য সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর আমাদের দেশে বিয়েতে মালাবদল হতো জরির মালায়। নান্নুকে বলেছিলাম কলকাতা থেকে ফেরার সময় দুটি রজনীগন্ধা ফুলের মালা আনার জন্য। এনে দিয়েছিল। সে মালা দিয়েই হয়েছিল আমার মালাবদল। যাক সে কথা।

এখন থেকে চল্লিশ বছর আগে এ দেশে ফুল চাষ ছিল অবিশ্বাস্য এক বিষয়। শৌখিনতার বশে অভিজাত পরিবারগুলো বাড়ির আঙিনা বা বাগানবাড়িতে নানা রঙের ফুল আর পাতাবাহারের গাছ রাখত। ওইসব বাগানের মালীরা প্রায়ই ফুল এনে হাই কোর্টের তখনকার প্রধান ফটকের সামনে (কার্জন হলের সামনে) বটতলায় ফুল বিক্রি করত। সেই অর্থে ওটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ফুলের বাজার। মনে আছে তখন সাপ্তাহিক ‘রোববার’-এ নিয়মিত লিখতাম। হাই কোর্টের এই ফুলের বাজার নিয়ে ‘হাই কোর্টে মৌসুমি ফুলের বাহার’ শিরোনামে একটি ফিচার লিখেছিলাম। আমাদেরই বন্ধু প্রখ্যাত বিনোদন সাংবাদিক আবদুর রহমান মতিঝিলে ‘পুষ্পক’ নামে প্রথম ফুলের বাণিজ্যিক দোকান দিয়েছিলেন। বন্ধু আবদুর রহমানের বাবা প্রয়াত আলী আহমেদ আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে মতিঝিলের রাজউক এভিনিউতে ‘ঢাকা সীডস স্টোরস’ নামে একটি বীজের দোকান দিয়েছিলেন। ওটিই ছিল ঢাকা শহরের প্রথম নার্সারি ও বীজের দোকান।

যা হোক, পরে ধীরে ধীরে শাহবাগে গড়ে ওঠে ফুলের বাজার। সামাজিক আচারে ফুলের ব্যবহারও বাড়তে থাকে। ফুলের ব্যবহার বৃদ্ধির পেছনে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক-তিত্ব রয়েছে। তিনি অনুষ্ঠানে ও শুভেচ্ছা বিনিময়ে ফুলের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গেই ফুল এখন নিত্যদিনের চাহিদার একটি অংশ। শুভেচ্ছা বিনিময় তো আছেই, ফুল ছাড়া কোনো উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানের কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই ফুল এখন গুরুত্বপূর্ণ এক কৃষিপণ্য।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে শের আলী সরদারের কথা। ১৯৮৩ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীতে শের আলী সরদার মাত্র ৩০ শতক জমিতে প্রথম চাষ শুরু করেন রজনীগন্ধা ফুলের। এর মধ্য দিয়ে দেশে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও বিপণন। গদখালীকে এখন বলা হয় ‘ফুলের রাজধানী’। সেখানে মাঠের পর মাঠজুড়ে দেখা যায় নানা রঙের, বর্ণিল জাতের ফুল। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে গদখালীর ৭৫টি গ্রামের ৫ হাজার চাষিসহ ৫ লাখ মানুষ ফুল উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে ২৪টি জেলার প্রায় ১২ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। ফুল চাষ ও ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ মানুষ জড়িত। বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফুলের বাজার তৈরি হয়েছে দেশে। বর্তমানে যশোর ছাড়াও ঢাকার সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা প্রভৃতি অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে।

ফুল চাষে কৃষকের এই বিপ্লব খুব কাছ থেকে দেখেছি। বিটিভির সেই ‘মাটি ও মানুষ’ থেকে ফুল চাষের এই বিস্তার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে এসেছি বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কাট ফ্লাওয়ার যেমন ক্রিসেনথিমাম, জারবেরা, কার্নিশা, টিউলিপ এই ফুলগুলো যার হাত ধরে চাষ এবং পরে সম্প্রসারিত হয় তার প্রধান কারিগর বেলজিয়ান উন্নয়নকর্মী জন পল পেরিন। ফুল নিয়ে কাজের সূত্রে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সারা বিশ্বের ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ফ্লোরা হল্যান্ড, রয়েল ভ্যানজানটিসহ বিভিন্ন এলাকার ফুল চাষ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম তুলে ধরেছি চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। কিংবা তারও আগে ২০০৬ সালে চীনের কুনমিংয়ে জারবেরা ফুলের আবাদ ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম আপনাদের সামনে তুলে ধরেছিলাম। এমনকি পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় গ্রিন হাউসে বড় পরিসরে ফুল উৎপাদনের চিত্রও দেখিয়েছি। দেখিয়েছি কাতারের ফুলের রাজ্য। তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলাম ময়মনসিংহের ভালুকায় নিশিন্দা গ্রামে। নিউ এশিয়া গ্রুপ পলিনেট হাউসে চাষ করছে জারবেরা ফুল। গহিন গ্রামের ভিতর নেট হাউসে বিশাল ফুলের চাষ ক্ষেত্র দেখে অভিভূত হলাম। গদখালীর ফুল চাষ থেকে এটি বেশ ব্যতিক্রম। গদখালীর কৃষক উন্নত দেশের প্রযুক্তি তাদের উপযোগী ও সীমিত ব্যয়-সাধ্যের মধ্যে নিয়ে এসে ফুল চাষ করছেন। কিন্তু নিশিন্দা গ্রামে ফুলের চাষ হচ্ছে বড় বিনিয়োগে পুরোপুরি উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি অনুসরণ করে। পলিনেট হাউসে ফুল উৎপাদন কার্যক্রমের কারিগরি সহায়তা পুরোপুরি দিচ্ছে ভারত। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত জারবেরার ১০টি জাতের আবাদ চলছে নেট হাউসে। চারাও সরবরাহ করেছে ভারতীয় একটি আধুনিক কৃষি সহায়ক কোম্পানি।

গত বছর আগস্টে এসব নেট হাউসের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আর এরই মধ্যে জারবেরা ফুলে ভরে উঠেছে একেকটি পলিনেট হাউস। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বাজারজাতও। ইউরোপের সুপরিকল্পিত ও ঠান্ডা আবহাওয়া উপযোগী পলিনেট বা গ্রিন হাউসের চেয়ে খুব বেশি ভিন্নতা নেই এখানে। তবে বাংলাদেশে ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীর কৃষকের স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত গ্রিন হাউসের তুলনায় এটি বিশেষায়িত ও টেকসই। নেট হাউসে তাপ নিরোধক ব্যবস্থা যেমন রয়েছে একইভাবে রয়েছে ধোঁয়ার মতো সূক্ষ্ম ছটায় পানি প্রয়োগের ব্যবস্থা। গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চল হলেও এখানে বেশ সুন্দরভাবেই গুছিয়ে উঠেছে আধুনিক জারবেরা খেত। এই কৃষি ক্ষেত্রের সামগ্রিক কার্যক্রম দেখাশোনা করছেন কয়েকজন চৌকস তরুণ। লেখাপড়া শেষ করে করপোরেট চাকরি হিসেবেই তারা এই আধুনিক কৃষিকাজ তত্ত্বাবধান করছেন। তাদের সঙ্গে কথা হলো এর কারিগরি দিক নিয়ে।

বেশ পরিকল্পিতভাবে মাটি ব্যবস্থাপনার পর তৈরি করা হয়েছে ফুল চাষের বেড। একেকটি শেডে বেড রয়েছে ১৬৪টি। একেক বেডে ফুটে রয়েছে একেক রঙের মনোমুগ্ধকর জারবেরা ফুল। সঠিক ব্যবস্থাপনায় জারবেরা ফুল আবাদ করতে পারলে খুব অল্প দিনেই পাওয়া যায় ফলন। এখানে গ্রিন হাউস তৈরি ও রোপণের পর তিন মাসেই শুরু হয়েছে ফুল বাজারজাতকরণ। এখন প্রতিদিন ১১-১২ হাজার জারবেরা যাচ্ছে রাজধানীর আগারগাঁও ও শাহবাগের ফুলবাজারে। এ প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মেহেদী হাসান জানালেন, চীন থেকে এখন আর জারবেরা আসে না। পাঠক! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত বছর গদখালীর জারবেরা নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিল রাজধানীর ফুলবাজারের বিক্রেতারা নাকি বলে থাকেন আমাদের দেশি জারবেরার মান খুব বেশি উন্নত নয়। তারা বলতে চান, ডগা বা স্টিকের সঙ্গে ফুল সোজা থাকে না, অর্থাৎ ঘাড় ভেঙে থাকে। এটি নিয়ে গদখালীর ফুল চাষিদের সঙ্গেও একাধিকবার কথা বলেছি। মূল সমস্যাটা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। দেখলাম এই পলিনেট হাউসে চাষকৃত জারবেরা ফুলের ডগা সোজা, ঘাড় ভেঙে যাচ্ছে না।  এ বিষয় নিয়ে নিউ এশিয়া গ্র“পের ফ্লোরিকালচার প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানালেন সঠিক পুষ্টি এবং নিয়ন্ত্রিত আলো ও তাপমাত্রায় জারবেরা চাষ করলে এ ধরনের সমস্যা হবে না। তারা বলছেন, সার, কীটনাশকের বাইরে, Fogger-এর মাধ্যমে পানি প্রয়োগের সময়, সেই পানিতে অন্য কোনো উপাদান প্রয়োগ করা হয় না। ভূগর্ভস্থ পানি তোলার পর শুধু বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ঘনত্ব কমিয়ে নেওয়া হয়। এই গ্রিন হাউসে আধুনিক সেচপ্রযুক্তি drip irrigation ব্যবহার করা হয়।

এই এলাকায় গ্রিন হাউসে ফুল চাষ নতুন। স্থানীয় কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের কাছেও এটি এক বিস্ময়। পরিকল্পিত চাষের তিন মাসের মাথায় ফুল তুলে বাজারে পাঠানোর এই ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে স্থানীয় কৃষিশ্রমিকরাও বেশ পুলকিত। এমন ফুলের সুরভির সঙ্গে মনেপ্রাণে মিশে গেছেন তারা। খেত থেকে ফুল তোলার পাশাপাশি আধুনিক প্যাকেজিংব্যবস্থাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় নারীরা। তাদের জন্যও এটি চমৎকার এক কর্মসংস্থান। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম এই প্রতিষ্ঠানে ফুল চাষ ও বিপণনের কাজে যুক্ত হয়ে তাদের আত্মনির্ভরশীলতার গল্পও। ফুল এদের জীবনকেও রঙিন করে তুলছে।

কৃষির গতি-প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত থেকে সব সময়ই উপলব্ধি করছি, বিশ্বব্যাপীই কৃষির বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। এ পরিবর্তন প্রযুক্তিতে যেমন, একইভাবে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যেও। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাণিজ্যিক কৃষি সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন দেশের কৃষি অনুরাগী শিল্পোদ্যোক্তারা। যারা ইতিমধ্যেই বেশকিছু সাফল্যের নজির গড়েছেন। এ অনুশীলনটি দিনে দিনে সম্প্রসারণ হতে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে একটি শ্রেণির বিষমুক্ত ফল-ফসলের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, অনেক ফসলেরই আমদানি চাহিদা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব আমরা, তৈরি হবে রপ্তানি বাণিজ্যও। ফুলের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছি। হয়তো অল্প দিনে ফুল রপ্তানিতেও একটি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। পরিবর্তিত ও বিশ্বমানের কৃষির এই দৌড়ে আমাদের কৃষক থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব ধরে রাখাটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় একটা নীতিমালা প্রণয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর