শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

হিজরি নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মুফতি মহিউদ্দিন কাসেম, পেশ ইমাম

হিজরত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হিজরত শব্দটির একটি সাধারণ অর্থ রয়েছে। হিজরতের সাধারণ অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো বস্তু স্থান বা ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করা, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। এ অর্থেই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসেছিলেন। হিজরতের এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা থেকেই হজরত ওমর (রা.) তাঁর খিলাফত-কালে হিজরতের ১৭তম বর্ষে হিজরি সন গণনা শুরু করেন। এর প্রেক্ষাপট ছিল এমন : হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসত। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা হতো কিন্তু সন থাকত না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা.) একটি পত্রে ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করেন, ‘আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন তাতে কোনো সন উল্লেখ নেই যে কারণে আমাদের অনেক সমস্যা হয়।’ তা ছাড়া সুপ্রসিদ্ধ আল ফারুক গ্রন্থে উল্লেখ আছে হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরির শাবান মাসে তাঁর কাছে একটি দাফতরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়। পত্রটিতে মাসের উল্লেখ থাকলেও সনের উল্লেখ ছিল না। তীক্ষè দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞাসা করেন পরবর্তী কোন সময়ে কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি কোন সনে তাঁর সামনে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নে কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত ওমর (রা.) সাহাবায়ে কিরামের সঙ্গে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। তখন পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সন নির্ধারণ ও গণনার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন উপলক্ষ থেকে সন গণনার মতামত এলেও শেষ পর্যন্ত হিজরতের ঘটনা থেকেই সন গণনার সিদ্ধান্ত হয়। সন গণনার আলোচনার সময় প্রস্তাব এসেছিল ইসলামী সনের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের সন থেকে ইসলামী সনের সূচনা হওয়ার। এ রকম আরও কিছু কিছু উপলক্ষের কথাও আলোচিত হয়। কিন্তু হিজরতের সন থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয়। ‘আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী বিষয় হিসেবে হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্যে ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন।

প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, জুমা, ঈদ সবকিছু হিজরতের পরই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.) আর তৎকালে আরবে অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী মহররম মাস থেকেই ইসলামী বর্ষ শুরু (হিজরি সন) করার এবং জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত উসমান (রা.)। তা ছাড়া মহররমকে হিজরি সনের প্রথম মাস নির্ধারণের পেছনে আল কোরআনের একটি নির্দেশনাও গুরুত্ব পেয়েছে। আল কোরআনে চারটি মাসকে সম্মানিত বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এ চারটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। মহররমে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের ইচ্ছা ঘোষণা করায় ও চারটি সম্মানিত মাসের অন্যতম হওয়ায় তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

হিজরি সন মূলত চান্দ্রবর্ষনির্ভর। চান্দ্রমাস ২৯ ও ৩০ দিনে হয় বিধায় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে বর্ষ পূর্ণ হয়। তাই চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষে সাধারণত ১০ বা ১১ দিনের পার্থক্য হয়। এ মাসগুলো আরবি হলেও গোটা মুসলিম উম্মাহর সন হিসেবেই তা গ্রহণ করতে হবে। কারণ এই চান্দ্রবর্ষের ও চান্দ্রমাসের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের বহু ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ইবাদতের তারিখ, ক্ষণ ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরি সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হিজরি সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য জরুরি। যেমন রমজানের রোজা, দুই ঈদ, হজ, জাকাত ইত্যাদি ক্ষেত্র চান্দ্রবর্ষ বা হিজরি সন ধরেই আমল করতে হয়।

রোজা রাখতে হয় চাঁদ দেখে, ঈদ করতে হয় চাঁদ দেখে। এভাবে অন্যান্য আমল ও মুসলমানদের ধর্মীয় কতগুলো দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্র রয়েছে সেগুলোয় চাঁদের হিসাবে দিন, তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করা আবশ্যকীয়। আরেকটি বিষয় হলো চান্দ্রমাসের হিসাব অনুযায়ী হওয়ায় একটি ইবাদত বিভিন্ন মৌসুমে পালনের সুযোগ মুসলমানরা পান। কখনো রোজা ছোট দিনের হয়, কখনো দীর্ঘ দিনের হয়- মৌসুমের এই বৈচিত্র্যের কারণে মুসলমানরা একটি ইবাদত আল্লাহর দেওয়া সব কটি মৌসুমেই পালন করতে পারে।

শুধু হিজরি সন নয়, হিজরি সনের মাসগুলোর তারিখ ব্যবহার ও চর্চা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কর্তব্য। মুসলমানের হিসাব-নিকাশ-গুলো হিজরি তারিখ উল্লেখ করে  করা উচিত। অন্য সনের হিসাব অনুযায়ী হিসাবে আসতে পারে। মনে রাখতে হবে ইসলামী তারিখ বা চান্দ্রবর্ষের হিসাব রক্ষা মুসলমানের জন্য ফরজে কেফায়া। এ কথা মনে করার কোনো অবকাশ নেই যে, হিজরি মাসটি আসলে আরবি বা আরবদের একটি সন; বরং এটি মুসলমানদের সন ও ইসলামী সন। আল্লাহ আমাদের এ  বিষয়ে যত্নবান হওয়ার তাওফিক  দান করুন।

সর্বশেষ খবর