রবিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার বিকল্প নেই

নূরে আলম সিদ্দিকী

রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার বিকল্প নেই

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আজকে একটা রাজনৈতিক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্য এবং পারিষদবর্গ তো বটেই, সরকার ও বিরোধী দলের শীর্ষ  নেতৃত্ব থেকে মাঝারি এমনকি ছোট-বড় আতি-পাতি নেতারাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে সোচ্চার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তৃতা শুরু করলে প্রায় সবাই বাগ্মী অথবা বাগ্মীর কাছাকাছি মনে হয়। শব্দচয়ন ও উচ্চারণে প্রায় সবাই নিজ নিজ আঙ্গিকে প্রচ-ভাবে জ্বলে ওঠেন, বিস্ফোরিত হন। এমনভাবে তারা বাণী বর্ষণ করতে থাকেন যে মনে হয় বক্তা একজন শুচিশুদ্ধ সূর্যস্নাত সততার বরকন্যা অথবা বরপুত্র। তাদের জীবনের আদি অন্ত যেন দিগন্ত বিস্তৃত সততার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তারা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারস্বরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বুলি কপচাতে থাকেন, তখন প্রান্তিক জনতা তো বটেই, তাদের ভাড়া করে আনা শ্রোতারাও মনে মনে হাসেন। কেউ কেউ ভাবেন, এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। কেউ কেউ আবার এও ভাবেন, এ যে ইবলিশের মুখে কলেমার আওয়াজ। নেতা-নেত্রীরা, বাগ্মী বক্তারা আমজনতাকে যেভাবেই ভাবুন না কেন, এদেশের প্রান্তিক জনতা মূলত যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত বিজ্ঞ মানসিকতার অধিকারী। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিক মাধ্যমে মঞ্চের বক্তাদের আস্ফালন শুনে ও দেখে         প্রান্তিক জনতা এমনকি তাদের ভাড়া করে আনা জনগোষ্ঠীও বিরক্ত হন। হয়তো ম্লান মূক মুখে তারা শপথ গ্রহণ করেন, একদিন এই মিথ্যাচার ও আস্ফালনের প্রতিশোধে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিস্ফোরিত হবেন। মঞ্চের বক্তারা জনগণের হৃদয়ের এই অনুরণনের কথা মোটেই অনুধাবন করতে পারেন না, আমলে নেন না প্রান্তিক জনতার নাড়ির স্পন্দন। কারণ আজকের রাজনীতির ফ্যাশনটাই হলো নেতিবাচক। মঞ্চের বক্তৃতায় অথবা বাকসর্বস্ব ক্ষুরধার বিবৃতিতে পুরোটাই অন্যের প্রতি গালাগাল এবং সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নেতিবাচক অবজ্ঞা বা সমালোচনাই ফুটে ওঠে। স্বীয় দলের ইতিবাচক কর্মসূচির নিশ্চিত তেমন কোনো ইঙ্গিত তাতে থাকে না। ক্ষমতাসীনরা অবশ্য ভোট চাওয়ার কৌশল হিসেবে আগামীতে সোনার হরিণ ধরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছেন। পরম            পরিতৃপ্তিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে তাদের মুখমন্ডল। তাদের দুর্নীতি, দুরাচার ও দুঃশাসনের যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর বেদনাপ্লুত হৃদয়ের কোনো চিত্রই তারা আমলে আনতে চেষ্টা করেন না। ফলে সরকার ও বিরোধীপক্ষের রাজনীতিকদের সমালোচনা ও আশ্বাসকে দেশের সাধারণ মানুষ তেমনভাবে আমলে নেন না।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে রাজনীতির পথপরিক্রমণের মধ্য দিয়ে আমার সক্রিয় রাজনৈতিক পদচারণা শুরু। এটা কথার কথা নয়, আমার সত্যস্নাত হৃদয়ের অনুরণন থেকে উদ্ভাসিত এক অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টান্ত সেদিনের মানুষ আমাদের কথাগুলো বিশ্বাস করত, হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করত। আমাদের বক্তৃতায় তারা উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত হতো। তারা শুধু বিমুগ্ধই হতো না, নিষ্কলুষ চিত্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতো সাফল্যের স্বর্ণসৈকতে অভিযাত্রার তরণী ভেড়াতে।

বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমরা স্বতঃসিদ্ধ ঋষিবালকের মতো যখন বাণী উদ্গিরণ করতাম, তখন আমাদের সত্তার নিভৃত কন্দরে, অনুভূতির পরতে পরতে নিঃশ্বাস এবং বিশ্বাসে একই সত্য সূর্যের বিকীর্ণ অগ্নিকণার মতো আমাদের শুধু উদ্ভাসিতই করত না, একটি কঠিন শপথে উজ্জীবিত করত। উচ্চারিত বাণীর সফলতা অর্জনে আমাদের এতটাই নিষ্ঠাবান থাকতে হবে যে, আমরা যেন মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যোদয়ের মতো আদর্শ লালন করি এবং চেতনার সঙ্গে বাস্তবমুখী কর্মের সংমিশ্রণে সবার জন্য অনুকরণীয় থাকতে পারি। আমাদের সতীর্থ সহযাত্রিক এমনকি সহকর্মীদের মনেও যেন এতটুকু সংশয়, দ্বিধা ও সন্দেহের ছায়া না পড়ে যে, আমরা যা বলি তা হৃদয়ের নিঃসংকোচ প্রকাশ নয়, এর মধ্যে কৃত্রিমতা সংস্পর্শ রয়েছে।

আজকের রাজনীতির সবচেয়ে বড় দৈন্যতা নেতৃত্বকে সমগ্র জনতা তো বটেই, তৃণমূল কর্মীরাও সার্বিক সত্য বলে সর্বান্তকরণে মেনে নিতে পারেন না। অর্থাৎ- তারা ভাবেন, এটি ছেলেভোলানো ছড়ার মতো শ্রোতার হৃদয়কে আপ্ল­ুত করে ভোট বাগানোর কৌশল মাত্র। 

একটু ভাবলেই অনুধাবন করতে কষ্ট হবে না, সামনের ডিসেম্বরেই নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করেছে। ভোটার হালনাগাদ থেকে শুরু করে নির্বাচনের অনেক প্রস্তুতি তারা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন বলে প্রায়শই ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনগুলো তো বটেই, দেশে সব দলের অংশগ্রহণের নির্বাচন হবে কি-না, এমনকি নানা জটিলতার আবর্তে পড়ে আদৌ নির্বাচন হবে কি-না, এ আশঙ্কা কখনো সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। প্রধান বিরোধী দল এখনো ক্রমাগত ধূম্রজাল সৃষ্টি করে চলেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে তারা আদৌ নিঃসংশয় চিত্ত নন। অন্যদিকে সরকারি দলের দাম্ভিকতা ও ঔদ্ধত্য এবং শিষ্টাচার বিবর্জিত নেতিবাচক বক্তব্য ও বিবৃতি এতই প্রকট যে, বোঝাই যায় না আসন্ন নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে তারা আদৌ সচেতন কি-না।

আসন্ন নির্বাচনটি সার্বিকভাবে নিরপেক্ষ হতে হলে সব দলের অংশগ্রহণে তো বটেই, ক্ষমতাসীনদের নিরপেক্ষ সহনশীল মানসিকতা অত্যাবশ্যক। এ সত্যটি সরকারি দলকে মর্মে মর্মে শুধু অনুধাবনই নয়, সত্যনিষ্ঠ মানসিকতায় প্রতিস্থাপিত করতে হবে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া জেদ করে ৮৬-এর মতো নির্বাচন বর্জন করলে যে রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পড়বেন তা নিশ্চিত। এবারের জেদ ৮৬-এর মতো তার সাহসিকতার দৃষ্টান্ত হবে না, বরং রাজনৈতিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরিতেই উপাদান জোগাবে।

কোনো কারণে সরকার বা বিরোধী জোটের নেতিবাচক কোনো ভূমিকার জন্য নির্বাচনটি যদি সব দলের অংশগ্রহণ না হয় বা একপক্ষীয় হয়, তাহলে আমাদের অজান্তেই দেশকে যে চরম দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে তা সরকারি ও বিরোধী জোটকে সততার সঙ্গে বিশ্বাস করতে হবে। আজকে একটি সত্য প্রকটভাবে দেশের রাজনীতিকদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, রাজনীতি ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের ও প্রান্তিক জনতার জন্য। রাজনীতিকরা শুধু মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নয়, তাদের হতে হবে দেশ জাতিকে রক্ষা করার অতন্দ্র প্রহরী। আত্মকেন্দ্রিকতা অথবা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থচিন্তার পরিম-ল থেকে পুরোপুরি বের হয়ে না এলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের নৈতিক অধিকার থাকে না বা থাকা উচিত নয়। সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতির প্রথম শর্তই হলো নৈতিকতা। দুর্নীতি তো দূরে থাক, নৈতিকতার স্খলন থাকলে তো বটেই, দুর্নীতির এবং নৈতিক অধঃপতনের কোনোরকম বহিঃপ্রকাশ ঘটলে বা ধরা পড়লে তাকে চরম মূল্য দিতে হয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে রাজনীতি হতে চিরবিদায়ও নিতে হয়। ঠিক তার উল্টোদিকে একটা সততার দৃষ্টান্ত মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় বসাতে পারে, তারও ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে। একটি ট্রেন দুর্ঘটনার সর্বময় দায়িত্ব রেলমন্ত্রী হিসেবে নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়ে পদত্যাগ করার দৃষ্টান্ত স্থাপনের কারণে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীই হননি, ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ভারতরত্ন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। বোধকরি এটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, সেই ভারতবর্ষেই রাজনীতির ৬০ বছরের উদার মূল্যবোধকে উপেক্ষা তো বটেই, পদদলিত করে উগ্র ধর্মান্ধ মোদি উদার ভারতবর্ষকে হিন্দুস্তানে রূপান্তরিত করার যে অন্ধ উন্মাদনার হিংস্র পাশবিকতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তাকে ভারতবাসীই অনেকটা রুখে দিয়েছে। ধর্মান্ধ মোদি সর্বভারতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে যে উন্মত্ততা প্রকাশ করেছিলেন, গান্ধীজী, নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীর উদার ভারতবর্ষের আবহ মোদির শাসনামলেই মোদিকে সংযত হতে বাধ্য করেছে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিবেশ সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণে সহনশীল পরিম-লে প্রতিষ্ঠিত না হলে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আঁচ সারা ভারতের রাজনীতিতে অনুভূত হতে পারত। আমি এ কথাটির ওপরই জোর দিতে চাই। রাজনীতিকদের আচরণের দূরদর্শিতার ওপরই একটি দেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা তৈরি হয়। কোনো কারণে কোনো ধর্মবিদ্বেষী কিংবা ধর্মান্ধ ব্যক্তিত্ব কোনো একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন, কিন্তু আবহমানকালের ঐতিহ্যকে মুছে দিতে পারেন না। তিনি যত বড় শক্তিধর সরকারের অধিকর্তাই হোন না কেন। প্রসঙ্গক্রমে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমেরিকার রাজনীতির দীর্ঘ পথপরিক্রমণে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বর্ণবাদ বিলুপ্ত হয়েছে। আব্রাহাম লিংকন থেকে জন এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং-এর মতো কালজয়ী ব্যক্তিত্ব জীবনের অর্ঘ্য প্রদান করেছিলেন বলেই বারাক ওবামা একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের ঔরসে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও দু-দুবার আমেরিকার রাষ্ট্রপতিই শুধু নির্বাচিত হননি, শাসনতান্ত্রিক বাধানিষেধ না থাকলে দুবারেরও অধিক মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারতেন। কালো বর্ণের বারাক ওবামা শুধু রাষ্ট্রপতিই নির্বাচিত হননি, গণতন্ত্রের প্রবল স্রোতধারায় বর্ণবাদকে ভাসিয়ে দিয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। রাজনীতি যদি ইতিবাচক হয়, জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক হয়, আত্মকেন্দ্রিকতা ও গোষ্ঠীস্বার্থের পরিম-লে অবরুদ্ধ না হয়, তাহলে সব প্রতিবন্ধকতার অন্ধকার বিদীর্ণ করে দেশকে তো বটেই ইতিহাসকেও সূর্যস্নাত করে, উদ্ভাসিত করে, প্রজ্বলিত করে। সব কূপমন্ডূকতা, ধর্মান্ধতা ও রক্ষণশীলতার প্রাচীর ভেঙে ফেলার কারিগর হলো জনগণ।

শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার পথপরিক্রমণে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তাকে রক্ষা করবে দেশের প্রান্তিক জনতা। কিন্তু পথ বিনির্মাণ করতে হবে রাজনীতিকদেরই। তাদের দূরদর্শিতা, আত্মস্বার্থ ও প্রতিহিংসা-বিবর্জিত দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত রাজনৈতিক ধারা আজকের রাজনীতিকরা অনুসরণ করলে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। নেতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে কলহ ও হিংসাত্মক রাজনীতিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যায় কিন্তু দেশের বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করা যায় না, ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয় না। আমি স্বাধীনতা অর্জনের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের ধারার একজন জীবনসায়াহ্নে উপনীত ব্যক্তি। আজকে হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা ও পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব অবলোকন করে জীবনসায়াহ্নে বিক্ষুব্ধ চিত্তে আজকের রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুকে সামনে নিয়ে প্রান্তিক জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক পথপরিক্রমণের অবিচল ধারায় ৭০-এর নির্বাচনের নিরঙ্কুশ রায়কে পুঁজি করে ৭১-এর অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেই স্বাধীনতাকে অমলিনভাবে টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক সহনশীলতা অনিবার্য। হিংসা-বিদ্বেষ, পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা, আমি ছাড়া আর কারও মাঝে দেশপ্রেম নাই- এই নেতিবাচক মানসিকতা সব রাজনীতিককেই পরিহার করতে হবে। সবার মানসিকতায় আনতে হবে- দেশটি আমার নয়, আমাদের সবার। আজকের রাজনীতিটা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতিকরা একদল আরেক দলের সঙ্গে সামাজিকভাবে ওঠাবসা তো করেই না, বরং দৈবক্রমে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হয়ে গেলে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কথা তো বলেনই না,  সন্তর্পণে সুকৌশলে বোধহয় কম্পিত হৃদয়ে এড়িয়ে চলেন। আগে আমরা ভিন্ন মতের রাজনীতি করলেও, এমনকি চিন্তা-চেতনায় একটা বিশাল মতপার্থক্য থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে এতটাই বন্ধুপ্রতিম থাকতাম যে, অনেকেই তা অবলোকন করে বিস্ময়াভিভূত হতো। কেউ কেউ শুধু আপ্লুত নয়, উজ্জীবিতও হতেন। রাজনীতির বিশাল অঙ্গনে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যক্তি হিসেবে আমি মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাসী, সমাজতান্ত্রিক ধারার কঠোর সমালোচক। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অলীক বাসনায় বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে বিপ্ল­বের নামে মানুষ হত্যার আমি শুধু বিরোধীই না, সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। তবুও আমার চিন্তা-চেতনার ঘোর পরিপন্থী রাজনৈতিক ধারার অনেক ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিগত জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। গণবাহিনীর কাজী আরেফ আহমেদ আমার এতটাই অন্তরঙ্গ ছিলেন যে, রাজনৈতিক অঙ্গন তো বটেই, দুই পরিবারের সদস্যরাও অবাক হতেন। এসবির তদানীন্তন এসপি গোলাম মোর্শেদ ও ডিআইজি ই এ চৌধুরী একদিন বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশই দিয়ে বসলেন, আমাদের মোস্ট ওয়ান্টেড কাজী আরেফের আশ্রয়দাতা যখন নূরে আলম সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিরা হন, তখন আমাদের গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। পাঠক ও আজকের প্রজন্ম অবশ্যই অনুধাবন করতে পারছেন, তখন কীরকম বিপাকে আমাকে পড়তে হয়েছিল বা নেতার কাছ থেকে কী বকুনিই না খেতে হয়েছিল। একদিন হঠাৎ গভীর রাতে বন্ধুবর কাজী আরেফ আমার সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে এসে হাজির হলো। আমি কি সেই রাতে তাকে তাড়িয়ে দেব, না পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব? আমি আশ্রয় দিয়েছি। এখানে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি রাজনৈতিক মতানৈক্যের ঊর্ধ্বে উঠে আসত। তবে সত্যি বলতে, ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কখনোই কোনো অবস্থাতেই আমার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। বরং সুযোগমতো ওই ধ্বংসাত্মক রক্তাক্ত পথ পরিহারের জন্য আমি পীড়াপীড়ি করতাম।

আজকের প্রজন্মের কাছে আমার হৃদয়ের আকুতি, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই। তাই বলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকবে না বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে এটা তো কাম্য নয়। আজ আমি আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতি করি না। তবে আওয়ামী লীগ পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে অনুভূতির নিভৃত কন্দরে দলটির কর্মকা-ের প্রতি একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ যে আমার রয়েছে, সেটাও সর্বজনবিদিত। আজকে আওয়ামী লীগের যে সমালোচনা আমি করি, সেটা সংগঠনের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামাতকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য নয়। আমার দৃষ্টিকোণ হতে অনুভূত ভুলত্র“টিগুলো ধরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচার, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও পরিবারতন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নির্মোহ অভিপ্রায়ে। আজকের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কেউ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অন্য কোনো উত্তরসূরিকে বিকল্প ভাবে না। শুধু শেখ হাসিনাই নয়, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরিরাই আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্বের তালিকায় সার্বজনীনভাবে বিবেচিত হয়। জয়, রেহানা, ববি, রূপন্তীদের নাম সেই তালিকায় আসে। কালের ধারাবাহিকতায় এটিই হয়ে আসছে।

 লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর