মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি

বাহালুল মজনুন চুন্নু

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি

শিক্ষা সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একজন মানুষ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এবং বিশ্বের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য দায়িত্বশীল সদস্যে পরিণত হয়। তবে তা সম্ভব হয় কেবল মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমেই। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আবেগিক, বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার চর্চায় দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে যোগ্য করে তোলে, মনুষ্যত্ব বিকাশে গতিশীলতা আনে, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে নতুন প্রজন্মকে জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে জাগ্রত করে তুলতে পারে, সেই শিক্ষাই হলো মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সাক্ষরতার হার ৭০%-এর ঊর্ধ্বে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশু ৯৮%-এর ঊর্ধ্বে, ঝরে পড়ার হার চলে এসেছে ২০%-এর নিচে, পাবলিক পরীক্ষার ফলও সন্তোষজনক। এসব সূচকে উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে। তিনি শিক্ষার পরিমাণগত উন্নয়নই কেবল ঘটাননি, প্রত্যাশিত শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষার সার্বিক ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। বছরের প্রথম দিন শতভাগ শিক্ষার্থীকে শতভাগ নতুন বই প্রদান, উপবৃত্তি প্রদান, বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগ ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন, শিক্ষকদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণসহ শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন খাতে অর্থ বরাদ্দসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এতসব করার পরও মানসম্মত শিক্ষার দিক দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে এর উত্তরে তেমন সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায় না। এর কারণ প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সম্পূর্ণ গলদপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টে দেওয়াটা অনেক কঠিন। এজন্য সব অংশীজনেরই অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গে বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া দরকার।’ বর্তমান সরকারও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে। তার পরও শিক্ষার মানের তেমন উন্নতি হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘাটতি তথা সমস্যার কথা বলা যেতে পারে। প্রথমেই বলতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানমুখিতার পরিবর্তে সনদমুখিতার প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদানের কথা। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা, সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে। অনেক ছেলেমেয়েই পরীক্ষায় পাস করে সনদপত্র পায়, কিন্তু জ্ঞানার্জন করে না। এসএসসি, এইচএসসিতে ৭০-৮০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় তারা পাস করতে পারছে না। দেশ-জাতি নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্ন করলেও বেশির ভাগই সেগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারছে না। এটা ভাবনার বিষয়। পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণিতেও পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই হয়ে উঠছে পরীক্ষানির্ভর। পরীক্ষাসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় নোটবই, গাইডবই আর কোচিং সেন্টারের যে ব্যাপকতা সৃষ্টি হয়েছে তা জাতির জন্য আশঙ্কাজনক। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা কমানোর জন্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখন নোটবই, গাইডবই আর কোচিং সেন্টারের প্রকোপে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল প্রশ্ন মুখস্থ করেই পরীক্ষায় বসছে। মাঝখান থেকে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের পেছনে কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। অনেক কোচিং সেন্টার তো জিপিএ-৫-এর গ্যারান্টি দেয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে এসব কোচিং সেন্টার যে জড়িত তা পত্রিকায় অনেকবারই এসেছে। তবু বন্ধ হচ্ছে না কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য। কেউই যেন মানসম্মত শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, সর্বত্রই পরীক্ষায় ভালো ফল করানোর আয়োজন। ফলে দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধ, সুনাগরিকের গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না; সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরাধপ্রবণতা।

শিক্ষার এই যে সংকট চলছে তার মূলে বড় ভূমিকা রেখেছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এটা আমাদের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি। কিন্তু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ একে পণ্য হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ফলে কোচিং সেন্টার, নোটবই, গাইডবই, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপৃতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা তথৈবচ। এগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জোরেশোরে শোনা গেলেও কোনো এক অজানা কারণে সব থমকে পড়ে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার বিষয়টি এখনো অধরা। এ রকম আরও অনেক বিষয় আছে যা শিক্ষানীতিতে বলা হলেও আমরা সেদিকে তেমন এগোতে পারিনি। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখনো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই ভৌত অবকাঠামোর তেমন উন্নতি হয়নি। শিক্ষা উপকরণও অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত নেই। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব ক্ষেত্রে অনুদান দিচ্ছে, সরকারও অনেক বরাদ্দ বাড়িয়েছে কিন্তু আশানুরূপ দৃশ্যমান উন্নতি এখনো অনুপস্থিত। দীর্ঘকাল ধরেই শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে আসছে। শিক্ষা পক্ষত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য সরকার অনেক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিলেও আরও কঠোর হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। নোটবই, গাইডবই, কোচিং সেন্টার এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

সর্বশেষ খবর