বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভারতে এসব কী ঘটছে?

সুখরঞ্জন দাশ গুপ্ত

ভারতে এসব কী ঘটছে?

শহরের নকশাল এবং জঙ্গলের ভিতরে আত্মগোপন করে প্রশাসনের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালানো নকশাল- এই দুই ভাগে ভাগ করে ভারতের মধ্য-দক্ষিণ ও পূর্ব প্রান্তের অতি বাম সংগঠনগুলোর ওপর খড়গহস্ত হয়েছে মোদি সরকার। মূল নকশাল আন্দোলনের শুরু ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে। সেই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল মূলত পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার ও ওডিশার কিছু অংশ। এরপর দীর্ঘ সময় নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা এই অতি-বাম শক্তি প্রাসঙ্গিক থেকেছে। ধীরে ধীরে নকশাল সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতে দুর্বল হয়েছে, অন্যদিকে জোরদার হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং বিহারের বেশ খানিকটা অংশে। কিন্তু শহুরে নকশাল বা গ্রামের বা জঙ্গলের নকশাল বলে এতদিন কিছু শোনা যায়নি সংবাদমাধ্যমে। সম্প্রতি মোদি সরকার চালু করেছে এই নতুন শব্দবন্ধটি। মোদি প্রশাসনের মতে, যারা শহরে অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত থেকে নকশালদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে, তারাই হলেন শহুরে নকশাল। এদের মধ্যে অধ্যাপক, সাহিত্যিক, অভিনেতা, কবি, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, মানবাধিকার ও সমাজকর্মী, সাংবাদিক যে কেউ থাকতে পারে। চলতি মাসেই এরকম পরিচিত পাঁচ মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করেছে মোদি সরকার। অভিযোগ, এই পাঁচজন নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের মতো গুরুতর অভিযোগে সিবিআই, এনআইএ-র মতো এলিট তদন্তকারী সংস্থাকে বাদ দিয়ে তদন্তে নেমেছে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের পুলিশ। এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে পাঁচ শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী রমিলা থাপার, দেবকী জৈন, প্রভাত পট্টনায়ক, সতীশ দেশপাণ্ডে এবং মাজা দারুওয়ালার আর্জির ভিত্তিতে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, বিরুদ্ধ মত গণতন্ত্রের পক্ষে সেফটি ভালভের মতো কাজ করে। এই ভালভ না থাকলে প্রেশার কুকার ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আদালত এই গ্রেফতারির কারণ, সময় এবং উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। যে কায়দায় পাঁচ মানবাধিকার কর্মী ও লেখককে দেশজোড়া হানা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তা কার্যত জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা। বস্তুত, এই ভাষাতেই মহারাষ্ট্র  পুলিশের অপারেশনকে বর্ণনা করেছেন বিরোধীরা। গ্রেফতারির প্রতিবাদে ধিক্কার শুরু হয়েছে গোটা দেশেই। অনেকেরই মনে পড়ে গেছে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সেই ভয়ঙ্করতম কালো দিনগুলোর কথা। যে সময় প্রায় প্রতিটা দিনই কাটাতে হতো আতঙ্কে। লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ, কারও রেহাই ছিল না। শাসকের বিরুদ্ধাচরণ শোনা গেলেই তার ঠাঁই হতো কারাগারে। নামের পাশে রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা দিয়ে হতে পারত এনকাউন্টারও। একযোগে ছটি শহরে হানা দিয়ে কবি, লেখক, সমাজকর্মীদের যেভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে সেই স্মৃতিই আবার ফিরে এসেছে ভারতবাসীর মনে।

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মোদি সরকারকে উএষ্টশ করে বলেছেন, আরএসএস ছাড়া বাকি সব বন্ধ করে দাও। সব কর্মীকে জেলে পুরে দাও অভিযোগ করলে গুলি কর। স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে বাঁচাতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ। লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য, নির্বাচনের আগে এটা সংবিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! এই গ্রেফতার অভিযান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা, সে প্রশ্ন তুলেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল! কেন গ্রেফতার করা হলো সেই প্রশ্ন তুলে মহারাষ্ট্র পুলিশকে নোটিস পাঠিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।

আপাতত সামনে আনা হয়েছে এই বছরের ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিত সমাবেশকে কেন্দ্র করে গ-গোলের ঘটনাকে। ইতিমধ্যেই ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিন মাস আগেই আটক করা হয়েছে এমনই পাঁচ সমাজকর্মী-আইনজীবীকে। তাদের ‘শহুরে মাওবাদী তকমা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। একই মামলা টেনে নিয়ে গিয়ে বেআইনি কার্যকলাপ মোকাবিলা আইনসহ নানা ধারায় অভিযানে আটকদের গ্রেফতার করেছে পুনে পুলিশ। সাহায্য নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশদেরও। এভাবে সাজানো মামলায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির জগৎসহ বামপন্থি দলগুলো। সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সমাজকর্মীদের বাড়িতে পুলিশি হানা ও তাদের গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করে বলেন, মোদি সরকার মানুষের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে। অবিলম্বে ধৃতদের মুক্তি দিতে হবে। বিবৃতি প্রকাশ করে গ্রেফতারের ঘটনার নিন্দা করেছে সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোও।

পুনের উপকণ্ঠে ভীমা কোরেগাঁওয়ে প্রতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর এবং তার পরের দিন দলিতরা সমবেত হন ১৯১৮ সালে মাহার সেনাদের বিজয়বার্ষিকী পালনে। মাহাররা জিতেছিল ব্রিটিশ সেনার অংশ হিসেবে। পরাস্ত করেছিল পেশোয়ার মারাঠা সেনাদের। এই ঘটনার দ্বিশতবর্ষে ২০১৭-এর ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে দলিত ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ডাকে এলগার পরিষদের নামে সভা হয়। হিন্দুত্ববাদী শক্তি ভীমা কোরেগাঁওয়ে সমাবেশের ওপর পরদিন আক্রমণ চালালে হাঙ্গামা শুরু হয়। দিন তিনেক সেই হাঙ্গামার রেশ ছিল। সেখানে একজনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘জুনের প্রথম সপ্তাহেই একযোগে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে নাগপুরের আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙ, সুধীর ধাওয়ালে, আদিবাসী আন্দোলনের নেতা মহেশ রাউত, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সোমা সেন, দিল্লির সমাজকর্মী রোনা উইলসনকে। এদের হয়ে মামলা লড়ছিলেন আইনজীবী অরুণ ফেরেইরা। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই গ্রেফতারগুলো করা হয়েছে দুটি চিঠির ভিত্তিতে। সেই চিঠির সত্যাসত্য যাচাই করা না হলেও সেখানে উল্লেখ ছিল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার যড়ষন্ত্র।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একযোগে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই মঙ্গলবার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ! এই অন্যায় অভিযানের তীব্র নিন্দা করে সবাই বলেছেন, সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে অস্বীকার করতে এবং বিরুদ্ধ মতের গলা টিপে ধরতেই পরিকল্পিতভাবে গণতন্ত্রের ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ করা হয়েছে। বিশিষ্টদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে এখনই তাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন সবাই। মানুষের কণ্ঠরোধের চেষ্টাকে ধিক্কার জানিয়েছেন সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত থেকে শুরু করে সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই, ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদসহ অন্যরাও।

ধৃতদের অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে দিল্লি­ থেকে একটি যৌথ বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে সই করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, গুজরাটের বিধায়ক জিগনেশ নেবানি, তিস্তা শিতলবাদ, জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সভাপতি শেহলা রশিদ শোহরা, প্রাক্তন সভাপতি মোহিত পাণ্ডে, সমাজকর্মী স্বামী অগ্নিবেশ, সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত, মানবাধিকার কর্মী এস এস ওয়াজির, তথ্যচিত্র নির্মাতা নকুল সিং শেনয় প্রমুখ। রামচন্দ্র গুহ টুইটারে লিখেছেন- গান্ধীজীর জীবনীকার হিসেবে আমি নিশ্চিত, বেঁচে থাকলে উনি আজ গায়ে ফের আইনজীবীর পোশাক চাপিয়ে আদালতে সুধা ভরদ্বাজের হয়ে সওয়াল করতে যেতেন। অবশ্য তার আগেই যদি না মোদি সরকার তাকে গ্রেফতার করে ফেলত।

এদিকে মহারাষ্ট্র পুলিশ ধৃত পাঁচ সমাজকর্মীর বিরুদ্ধে মোদি সরকারকে ফেলে দেওয়ার মাওবাদী চক্রান্তে যুক্ত থাকার যে অভিযোগ তুলেছে, তাকে নির্বোধের দাবিবলে অভিহিত করেছে বিজেপির জোটসঙ্গী শিবসেনা। দলের মুখপত্রে বলা হয়েছে, মাওবাদীরা নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে পুলিশ যা দাবি করেছে, তা স্রেফ চক্রান্তের তত্ত্ব। এমন নির্বোধের মতো কথা বলা বন্ধ করা উচিত। একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এদেশে সরকার বদল হয়। মনমোহন সিংয়ের সরকারকে কোনো মাওবাদীরা ফেলে দেয়নি। জনগণই ওই সরকারের পতন ঘটিয়েছিল।

লৈখক :  প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর