সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মানুষ গান গায় কেন : লেব তলস্তয়ের ‘হাজি মুরাদ’ প্রসঙ্গে

সলিমুল্লাহ খান

মানুষ গান গায় কেন : লেব তলস্তয়ের ‘হাজি মুরাদ’ প্রসঙ্গে

[এই ক্ষুদ্রকায় নিবন্ধটি লিখিয়াছিলাম মহাত্মা লেব তলস্তয়ের ‘হাজি মুরাদ’ উপন্যাসের শতবর্ষ উপলক্ষে-আজ হইতে কমপক্ষে চৌদ্দ বছর আগে-ইংরেজি ২০০৪ সালের প্রথম ভাগে। ‘সূর্যতরু’ নামক একটি প্রায় অপরিচিত পাক্ষিক পত্রিকার এক সংখ্যায় (বর্ষ ২ সংখ্যা ৬, জুন ২০০৪) লেখাটি পত্রস্থও হইয়াছিল। সম্প্রতি লেখাটির সহিত আকস্মিক দেখা হইল আরেকবার। ২০০৪ সালের মুদ্রিত সংস্করণে কিছু ছাপার ভুল ছিল। সেইগুলো সংশোধন করিতে বসিয়া আরও কিছু পরিমার্জনা করিবার সুযোগ পাইলাম। কিন্তু লেখার মূল কাঠামো বদলাইয়া লিখিবার অবকাশ আর হইল না। ঐ সময়ে যে রীতির গদ্য মক্শো করিতাম অনেকদিন হয় তাহা হইতে সরিয়া গিয়াছি। কিন্তু পুরানা দিনের গদ্যরীতিটা স্মৃতিস্বরূপ রাখিয়াই দিলাম। ১৮  সেপ্টেম্বর ২০১৮।] এ বছর মহাত্মা লেব তলস্তয় রচিত ‘হাজি মুরাদ’ কাহিনীর একশ বছর পূর্ণ হলো। তলস্তয় ‘হাজি মুরাদ’ গল্পটি লেখা শেষ করেছিলেন ইংরেজি ১৯০৪ নাগাদ। লেখকের জীবদ্দশায় গল্পটির প্রকাশ কেন সম্ভব হয়নি তা কাহিনীর মধ্যভাগ পর্যন্ত পৌঁছলে স্পষ্ট হয়।                তলস্তয় এন্তেকাল করেন ১৯১০ সালে। এক বছর পর ১৯১১ সালে গল্পটির প্রথম প্রকাশ। এই গল্পের একাধিক ইংরেজি তর্জমা পাওয়া যায়। রচনার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি আরও একটি নতুন অনুবাদ হাতে পেলাম। ১৯৮৪ সালে অশীতিপর মহাত্মা আকবরউদ্দীন গল্পটির একপ্রস্ত প্রাঞ্জল বাংলা তর্জমা প্রকাশ করেছিলেন। বর্তমান নিবন্ধের সুবাদে ভদ্রলোকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আজ শান্তি ও প্রীতির বাণী নিবেদন করছি। তলস্তয় বিশেষজ্ঞ পন্ডিতদের ধারণা, ‘হাজি মুরাদ’ গল্পটির আরও দুই দুইটি বিকল্প নাম তলস্তয় চিন্তা করেছিলেন-একটি নাম ‘কাঁটা’, অন্যটি ‘জেহাদ’। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি হয়তো চোখের পাতা কুঁচকে বলবেন, ‘জেহাদ’! আবার জেহাদ কেন? এই সহৃদয় পাঠক-সুহৃদদের বরং ধৈর্য ধরার আবেদন জানাব আমি। তলস্তয়ের ব্যাখ্যা অনুসারে জেহাদ বলে সেই লড়াইকে যে লড়াইয়ের মধ্যস্থতায় কৃষক আপনকার জমিজমার ওপর আপনার অধিকার কায়েম করে আর আপন জমির ফসল আপনার দখলে রাখে। তলস্তয়ের মতে জেহাদ নিছক ধর্মযুদ্ধ নয়, জেহাদ বলতে চাষির লড়াই বা কৃষকযুদ্ধ বুঝতে হবে। লেব তলস্তয়ের হাজি মুরাদ এমনই নিছক কৃষকযুদ্ধের নায়ক বিশেষ।

প্রশ্ন হলো কৃষকের অধিকার আর কৃষকের ধর্ম যেখানে একাকার, যেখানে কৃষক নিজেই নিজের লড়াইকে জেহাদ বলে অভিহিত করে সেখানে উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তশ্রেণি কোন অধিকার বলে এই ন্যায়বোদ্ধা কৃষকদের ধর্মান্ধ কি মৌলবাদী বলে গাল দেবেন? ‘হাজি মুরাদ’ কাহিনীর সারাংশ ধরে আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারব। জানা যায় লেব             তলস্তয় গোটা নয় নয়টি বছর ধরে-মানে ১৮৯৬ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত-এ গল্পের মুসাবিদা করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যে লেখা একটি খসড়ায়-যা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত সংস্করণে খুঁজে পাওয়া যায় নাই-তলস্তয় যে কথা লিখেছিলেন তাতে গল্পের গোড়াটা ভালোমতেই পাওয়া যায়।

১৮১২ সালে খানশাসিত অবার দেশের খুনজাক জেলার দুই ভদ্রমহিলা একই রাতে দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। এদের একজন স্বয়ং শাসক খান সাহেবের স্ত্রী : পাকু বিকে তাঁর নাম। আর জনের নাম-ফাতেমা। ফাতেমা পাহাড়িয়া কোনো এক সাধারণ কৃষকের বেগম। খান সাহেবের স্ত্রীর সাথে ফাতেমার ঘনিষ্ঠ চেনা-পরিচয় ছিল, ফাতেমাকে তিনি নিজ পুত্র-সন্তানের দাই মা নিয়োগ করেন। ফাতেমার দুঃখ এই, তাকে খান সাহেবের ছেলেকে দুধ খাওয়াতে হয়, আর তার নিজের ছেলেটা (দুধের অভাবে) মারা যায়। ফাতেমা বেগম খুনজাক জেলার খানম সাহেবার সখী বটেন। এদিকে ফাতেমার বড় দুই ছেলে ওসমান আর হাজি মুরাদ ঐ খানের প্রাসাদেই বড় হয়। তারা খান সাহেবের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা আর ঘোড়ায় চড়া যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করত। এরকম একটি সাধারণ পরিবারে, তথাকথিত ছোটলোক সমাজে হাজি মুরাদের জন্ম। নিজের ছেলেদের ভাগের শেষ দুধটুকুন খান সন্তানদের খাওয়াব না-এই দাবিতে মুরাদের মা অনেকবার অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। একবার এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আপন স্বামীপ্রবর তাকে খুন করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন, ছোরার আঘাতে গায়ে ক্ষতসৃষ্টি করেছিলেন। এহেন মায়েরই পেটের ছেলে হাজি মুরাদ। একদিন বড় হয়ে আপন জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধবিগ্রহে যোগ দেয় সে, প্রাণবাজি লড়াই করে। কপাল তাঁর মন্দ, যুদ্ধে সে আহত হয়ে শত্রুর হাতে ধরা পড়ল। কিন্তু আত্মসমর্পণ করলে না। কে এই বীর! কত তাঁর হিম্মত! এ প্রশ্নের উত্তরেই তলস্তয়ের ছোট্ট উপন্যাস ‘হাজি মুরাদ’।

১. ককেসাস পর্বতের ছায়ায় ঘেরা চেচনিয়া হাজি মুরাদের দেশ। এই ককেসিয়া মহাদেশের ইতিহাস বড়ই জটিল, বড়ই ঝঞ্ঝাপূর্ণ। পয়গম্বর হজরত ঈসা আলায়াহেস সালামের তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত জর্জিয়া আর আর্মেনিয়া নামের দেশ দুটি রোমক সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন বা তাঁবেদার রাষ্ট্র ছিল। সেই সময় কাজার জাতি দেশ দুটি দখল করে নিলে এই দুই দেশে-এবং ককেসাস উপমহাদেশের আরও অনেক স্থানে-ছোট ছোট অনেক পার্বত্য জাতি স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। সেখানকার আদ্যের বাসিন্দা বা স্থানীয়দের সাথে এশিয়া মহাদেশের অভ্যন্তর থেকে আগত অনেক জাতি একদেহে মিলে যাকে বলে বিলীন হয়ে যায়। হজরত ঈসার উনিশ শতকের গোড়া নাগাদ নানা জাতির লোক-প্রায় ৭০টি ভাষায় কথা বলার মত-ককেশাস জাহানে বসবাস করত। তুরানি জাতি আর ইরানি ভাষার আধিপত্যের জায়গায় সে দেশে-প্রথমবারের মতো-রুশ জাতির আধিপত্য কায়েম হয় হজরত ঈসার পঞ্চদশ শতকে। উনিশ শতকে এসে রুশ বিজয় ও দখলদারি আরও পাকাপোক্ত হয়। যেমন ১৮০১ সালে জর্জিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অবিভাজ্য অংশ বলে স্বীকৃতি পায়। তিফলিস থেকে ব্লাদিকাবকাজ পর্যন্ত একটা আন্তমহাদেশীয় মহাসড়ক রুশ সেনাদের চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়। প্রধানত এরমলব নামে প্রসিদ্ধ রুশ সেনাপতির প্রতিভাবলে যে অঞ্চলকে আমরা এখন ককেসিয়া পারের দেশ বা ট্রান্স-ককেসিয়া বলি তার পুরোটাই ১৮৩০ নাগাদ রুশদের তাঁবে চলে আসে। শুদ্ধ দুটি বড় দেশ তখন পর্যন্ত রুশশাসন মেনে নেয় নাই। একটি পূর্বে-চেচনিয়া, অন্যটি পশ্চিমে-চরকাসিয়া। এরা আরও ৩০-৪০ বছর পর্যন্ত বিদেশি দখলদারের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে থাকে। এই প্রতিরোধ সংগ্রামেরই এক খ্যাতনামা নায়ক, বীরত্ব আর মনুষ্যত্বের শেষ অবলম্বন ওরফে সম্বল বা পতাকার নাম অবার জাতির সন্তান হাজি মুরাদ। তলস্তয়ের ‘হাজি মুরাদ’ গল্পে চেচনিয়ার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের একপ্রস্ত ঐতিহাসিক বা সত্যকার ছবি পাওয়া যায়। এই সময় ককেশাস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতেন অপর এক পার্বত্য জাতির নেতা শামিল। শামিল মহোদয় শুদ্ধ এই দুনিয়ার শাসক নন, একই সঙ্গে পরকালের মুক্তির উপায় বা পথ নির্দেশকও বটেন। যাকে বলে ধর্মীয় নেতা তিনি। তিনি ইমাম শামিল। পূর্ব ককেসিয়ার অনেক পার্বত্য জাতি ইমাম শামিলের নেতৃত্বে রুশ দখলদারদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। তাঁর প্রতিরোধ যুদ্ধ সফল হয়। ১৮৪০ সালের দশকে রুশ উপনিবেশবাদ পরাজয় স্বীকার করে, প্রায় পরাভূত চরকাসিয়া দেশে তারা সামরিক অভিযান কিছুদিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সনের ক্রিমিয়ার যুদ্ধ চলার সময় এই পার্বত্য জাতিসংঘ কিছুদিন শান্তিতে স্থির ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় তারা আবার রুশ আগ্রাসনের মুখে পড়ে। তাদের ধনদৌলত, রসদপত্র, গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। তারা আত্মসমর্পণ করে দলে দলে। বলা হয় এ যুদ্ধে চেচনিয়ার মূল ভূখ-ের জনসংখ্যার চার ভাগের তিন ভাগই উচ্ছন্ন হয়ে যায়। ১৮৬৪ সালে একলা চরকাসিয়া থেকেই প্রায় ছয় লাখ মানুষকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর সেখানে স্থাপন করা হয় রুশ বসতি। আজও সেই যুদ্ধের শেষ হয় নাই। যুদ্ধ এখনো চলছে। (লেরমন্তব ১৯৯৪ : ২৪)

রুশ লেখকদের মধ্যে আলেকসান্দর পুশকিন, মিখাইল লেরমন্তব ও লেব তলস্তয় এই এশিয়াবি ককেসাস নিয়ে অনেক স্মরণীয় গল্প লিখেছেন। স্বাধীনতা-পূজারি এই সব পার্বত্য জাতির আদর্শ বীরদের স্থানীয় ভাষায় বলে ‘জিগিত’-এই জিগিতের বৈশিষ্ট্য অকুতোভয় যোদ্ধার, বুদ্ধিমান সেনাপতির, দেশপ্রেমের, প্রতিশোধ গ্রহণে অপরাক্সমুখ অশ্বারোহীর। চেচেন আর চরকাসিয়াবী জাতির আনুগত্য শুদ্ধ আপন আপন জাতির জন্য নয়, আপন আপন ধর্মের জন্যও বটে। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা যেমন জাতির প্রতিটি সন্তানের, প্রত্যেক বীরের দায়িত্ব, বিধর্মীর হাত থেকে আপনার জাতীয় ধর্ম রক্ষা করাও তেমনই তাদের দায়িত্ব বৈ নয়। লেরমন্তবের ‘আমাদের কালের নায়ক’ গল্পে ঢের চরকাসিয়াবি চরিত্র দেখা যায়, আর তলস্তয়ের ‘হাজি মুরাদ’ গল্পে শোনা যায় চেচেন জাতির মাহাত্ম্যগাথা।

আদিতে রুশ-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধেই যোগ দিয়েছিলেন হাজি মুরাদ। প্রথমে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন ধর্মীয় নেতা ইমাম শামিলের নেতৃত্বেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শামিলের বশ্যতা স্বীকারের মধ্যে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাননি তিনি। পরাধীনতা ব্যবসায়ী রুশদের কাছে একবার আত্মসমর্পণ করেন, আবার সেখান থেকে পালিয়েও আসেন হাজি মুরাদ। সেই পালানোর পথেই শেষ পর্যন্ত বীরের মতো লড়তে লড়তে প্রাণ দেন তিনি। তবে ঠিক রুশ বাহিনীর হাতে নয়, রুশপক্ষভুক্ত রাজাকার অর্থাৎ শামিলের অনুগত বাহিনীর হাতে। তাঁর কাটা মাথা অবশেষে রুশদের হাতেই পড়ে। তলস্তয়ের গল্পের মধ্যেই আমরা সেই কাটা মাথার দেখা পাই। তলস্তয়ের মতে এই রুশ-চেচেন যুদ্ধটি শেষ বিচারে এক ধরনের প্রভু ও ভৃত্যের যুদ্ধ, এক জাতীয় জমিদার-কৃষক লড়াই বৈ নয়। তিনি দেখান, রুশদেশের কৃষক আর চেচেনজাতির কৃষক-দুই জাতিরই অভিন্ন দুশমন রুশ স্বৈরতন্ত্র এবং রুশ শাসকশ্রেণি। এই শাসকশ্রেণি চেচনিয়ার কৃষকদের ফসল, খেতের ভুট্টা সাবাড় করে ফেলছে আর সৈনিকের উর্দি গায়ে চাপিয়ে দিয়ে অভুক্ত রুশ কৃষককে চেচেন সন্তানদের পেছনে লেলিয়ে দিচ্ছে। তলস্তয় জানেন, রুশ           কৃষক আর পার্বত্য জনগণ-উভয়েরই-একনম্বর দুশমন রুশদেশের সম্রাট-জার। ঘটনাচক্রে সে যুগে-গল্পের ঘটনা ১৮৫১ সালের-যিনি জারের সিংহাসনে আসীন তাঁর নাম নিকোলাস, পরবর্তী ইতিহাসের আলোকে বললে প্রথম বা একনম্বর নিকোলাস। ‘হাজি মুরাদ’ গল্পে তলস্তয় জার একনম্বর নিকোলাসের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। ক্ষমতার ব্যবসায় আর স্বৈরতন্ত্রের হাতে সৃষ্ট যে অশুভ কাঠামো রুশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রমূলে স্থাপিত সেই বড় অশুভের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নায়ক হাজি মুরাদ। পরিচয়ে তিনি যুগপদ চেচেন মুসলমান ও কৃষক সংগ্রামের নেতা।

তাই বলে তলস্তয় এই যুদ্ধে হাজি মুরাদকে জয়ী করেছেন এমন নয়। আমাদের মহাযুগের ট্র্যাজেডি যে কৃষকযুদ্ধের ট্র্যাজেডি              তলস্তয় এ সত্য ঠিকই ধরে ফেলেছেন। কারণ কৃষকরা সমবেত হয় কোন রাজা, কোন গান্ধী, কংগ্রেস, বেগ, খান বা এই জাতীয় কোন খেতাবধারীর পতাকাতলে আর ঘরে ফিরেই তারা দেখতে পায় মাথার ওপর তাদের নতুন প্রভু। হাজি মুরাদ কি মুসলমান না খ্রিস্টান? ইমানদার না পৌত্তলিক? এ প্রশ্ন বড় প্রশ্ন নয় তলস্তয়ের চোখে। অথচ হাজি মুরাদের চোখে ধর্মবিশ্বাস আর ন্যায়ের সংগ্রাম আদপেই আলাদা জিনিশ নয়। এইখানেই আমরা দেখতে পাই তলস্তয়ের মতো মনীষীও গোঁড়ামির কবজা থেকে ষোলো আনা মুক্ত থাকতে পারেন নাই। তিনি নিজে ন্যায়ের সংগ্রামে মহাত্মা যিশুর পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন অথচ হাজি মুরাদের ইসলামি পতাকা তাঁর চোখে বড় জোর একপ্রস্ত উপদ্রবের অধিক নয়। তলস্তয়ের ধারণা, হাজি মুরাদের মুসলমানিত্ব একটা কথার কথা বৈ নয়, তাঁর অন্তরের কৃষক ভাবটাই আসল। ১৮৯৭ ইংরেজির ৪ঠা এপ্রিল তারিখের রোজনামচায় তলস্তয় লিখেছিলেন : ‘হাজি মুরাদ লোকটি ধর্মান্ধতার শিকার-তাঁর বিষয়ে বলার আমার মূলকথাটা এটাই। তা যদি না হতো বা লোকটাকে কী ভীষণ সুন্দরই না দেখাত!” (শক্লোভস্কি ১৯৭৮ : ৬৮৩)

গণ্যমান্য অভিজাত শ্রেণির সুযোগ্য লেখক তলস্তয়ের এইটুকু ভুলচুক হয়েছে, এ কথা অবশ্যই কবুল করা যায়। তবুও আমাদের অধিক যেতে হবে, স্বীকার করতে হবে হাজি সাহেবের সমস্যাও নেহায়েত সরল সমস্যা ছিল না। হাজি মুরাদ কৃষক সমাজের নেতা, হাজি মুরাদের জেহাদ যুগপৎ রুশ জারতন্ত্র ও শামিল স্বৈরাচার উভয়ের বিরুদ্ধেই। এ ছাড়া তাঁর আর যাওয়ার অন্য কোনো পথও ছিল না। তলস্তয় চরিতামৃতকার শক্লোভস্কি লিখেছেন : ‘যদি সে শামিলের পথে যায়, তার যশ-মান-সম্মান সবই হবে, কিন্তু চাষিসমাজ কিছুই পাবে না। আবারও যে জোরজুলুম সে জোরজুলুমই চলতে থাকবে। যদি সে রুশ সম্রাটের কাছে যায় টাকা-পয়সা, মানসম্মান সবই তার হবে কিন্তু এই রুশরাই তো চেচেন চাষির ফসলের খেত-খামার দুপায়ে দলন করছে।’ জার একনম্বর নিকোলাসের চেয়ে জোরজুলুম অত্যাচারে শামিলও একচুল কম যান না। শামিলের ক্রোড় থেকে হাজি মুরাদ ছুটে যান নিকোলাসের বাহুডোরে। যাওয়ার পথে সে দেখা পায় জনৈক রুশ সৈন্যের-বেটা পালাচ্ছে ঐ নিকোলাসের সৈন্যদল ছেড়ে। এমন সময় আচমকা একটা বুলেট এসে বেটার গায়ে বেঁধে। বেইমান সৈন্য নামের কলঙ্ক থেকে সে বেঁচে গেল। কারণ আচমকা গুলিটা এসেছিল চেচেনপক্ষের বন্দুক থেকে।

২. হাজি মুরাদকে তলস্তয় দেখিয়েছেন যুদ্ধে আহত, বন্দী, পলাতক, সম্মুখযুদ্ধে অকুতোভয়, বীরদর্পে নিহত যোদ্ধা চরিত্র আকারে। তিনি শির দিয়েছেন কিন্তু আমামা দেন নাই। সুতরাং তাঁরই জয় হয়েছে। এই জয়টা তলস্তয় দেখান মোট দুই প্রকরণে। প্রথম প্রকরণে প্রেম, দুই নম্বরে যুদ্ধ। রুশপক্ষীয় দুর্গে জনৈক সেনাপতির স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েবনা হাজি মুরাদের দিকে বেশ একটা ভালোবাসার টান অনুভব করেন। ওদিকে বাটলার নামক জনৈক সৈন্যাধিনায়কও এই মহীয়সী মারিয়ার কৃপাপ্রার্থী। জ্যোৎস্নাভরা এক রাতে বাটলারের সঙ্গে হাওয়া খাওয়ার তাগিদে সেনা শিবিরের চৌহদ্দির মধ্যে পায়চারি করছেন মারিয়া। তখন ছোটখাটো এক সেনাপতি-নাম কামেনেব-কয়েকজন কসাক সৈন্য অভিব্যহারে তাদের মুখোমুখি। তারা ঝুলি খুলে হাজি মুরাদের কাটা মাথাটি টেনে বের করে দেখালেন মারিয়াকে। চাঁদের আলোয় অর্ধদৃষ্ট কাটামু-টা দেখিয়ে ওরা যেন বা দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে-‘দেখ তো মাথাটা, কার চেনা যায় কিনা?’ শত শত আঘাত আর ক্ষতের দাগধস হজম করেও জীবিত হাজি মুরাদের ঠোঁটের শিশুসুলভ হাসিটি হারায় নাই এই কাটা মাথা। ঘৃণায় মারিয়া মুখ ঘুরিয়ে নেন। এই মহার্ঘ, খ- মাথা দেখতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। অসম যুদ্ধের এই বিজয়চিহ্নে, এই করুণ সম্বলে মোটেও আনন্দ হয় না তার।

মারিয়া দিমিত্রিয়েবনাকে এভাবে কাটা ছিন্নমাথা দেখাবার কিছুক্ষণ পরই তলস্তয় হাজি মুরাদের সঙ্গে পশ্চাদ্ধাবনরত রুশ সৈন্যদলের শেষ মহারণের বিবরণটা পেশ করেন। এদিকে আমরা বিলক্ষণ জানি হাজি মুরাদের কাটামু- এখন রুশ বাহিনীর থলের ভিতরই। চাঁদের আলোয় দেখা না দেখা সেই কর্তিত শিরের স্মিতহাসিটি এখনো অম্লান। তবু শেষ অধ্যায়ের বিবরণটা আমরা পড়ি শিরা টান টান দশায়। এমনকি আশাও করি হাজি মুরাদ তাঁর শত্র“বাহিনীর বিরুদ্ধে জিতবেন, প্রাণে বেঁচে যাবেন শেষ পর্যন্ত। একেই কি বলে ‘কবির বিচার’-ইংরেজদের ভাষায় পোয়েটিক জাস্টিস!

তলস্তয়ের বিচারে হাজি মুরাদের লড়াই রুশ জাতির বিরুদ্ধে চেচেন জাতির লড়াই নয়। তিনি দেখাচ্ছেন হাজি মুরাদকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করল-ঠিক রুশবাহিনী নয়, রুশপক্ষে যোগ দেওয়া চেচেন রাজাকারের দল। তলস্তয় এখানে ন্যায় আর অন্যায়ের যুদ্ধ অপূর্ব সুন্দর চিত্রাকারে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন : ‘সুবেহ সাদেকের সময় হাজি মুরাদ অজু করার জন্য পানি নিতে আবার এই কামরায় এলেন। রাত্রি-দিবার এই সন্ধিক্ষণে ভোরের আলোর উদ্দেশে পাপিয়ার উল্ল­সিত কণ্ঠস্বর উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। আর এই সময় মুরিদদের কামরা থেকে শোনা যাচ্ছিল ছোরা শান দেওয়ার পাথরের সঙ্গে লোহার ঘষ ঘষ শব্দ।’

হাজি মুরাদ টব থেকে পানি নিয়ে নিজের কামরায় দোরের কাছে এসেছেন, এমন সময় ছোরা শান দেওয়ার ঘষ ঘষ শব্দ ছাপিয়ে ছাপিয়ে হানেফির কণ্ঠে শুনতে পেলেন পরিচিত গানের স্বর। শুনবার জন্য দাঁড়ালেন। গানের বিষয়বস্তু এই : হামজা নামের একটি জোয়ান তার সাঙ্গপাঙ্গ সমভিব্যহারে রুশদের একপাল ঘোড়া ছিনিয়ে নিয়েছিল। জনৈক রুশ রাজপুরুষ বিস্তর সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের পিছু নেয়। পরিশেষে তেরেক নদীর পাড়ে এসে তাদের ঘেরাও করে। অনন্যোপায় হামজা ঘোড়াগুলো হত্যা করে। যতক্ষণ তাদের রাইফেলে গুলি, কোমরবন্দে ছোরা আর শিরায় রক্তপ্রবাহ জারি ছিল ততক্ষণ তারা লড়াই করে। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কতকগুলো পাখিকে উড়ে যেতে দেখে হামজা। তাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে সে। গান গাইতে থাকে-

যাও পাখি উড়ে  যাও, আমাদের বাড়ি যাও

মায়েদের বলো আমাদের, বলো আমাদের বোনেদের

আমাদের প্রিয়াদের বলো, যুদ্ধ করে মরেছি আমরা

মরেছি জেহাদ করে! গিয়ে বলো তাদের

কবরে আরামে থাকবে না আমাদের লাশ

আমাদের খাবে বাঘে, টুকরা টুকরা ছিঁড়বে,

কাক আর শকুন আমাদের চোখ উপড়াবে।

 (তলস্তয় ১৯৮৪ : ১৪২-৪৩)

গানের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে গায়কেরা উপনীত হলো-‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণে। গানের শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে না পৌঁছতেই তীক্ষ্ণ একটা আর্ত স্বর বাতাস খান খান করে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল। তারপর সব স্তব্ধ, নীরব।

শোনা যায় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা একবার লেব তলস্তয়কে জিজ্ঞাসা করেছিল : ‘মানুষ গান গায় কেন?’ শক্লোভস্কির মতে এই প্রশ্নের উত্তরেই তিনি ‘হাজি মুরাদ’ লিখেছিলেন। এখানেই তলস্তয় অজ্ঞাতসারে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন হাজি মুরাদের লড়াই আচমকা এক ব্যক্তির লড়াই নয়, এই লড়াইয়ের একটা পূর্ব আছে, সম্ভবত একটা উত্তরও আছে। হামজার জীবনের সহিত হাজি মুরাদের জীবনদানের মিলটাও একান্ত আপতিক মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বীকার করতে হয় তলস্তয় নিজের অজান্তেই যেন মেনে নিয়েছেন-হাজি মুরাদের লড়াই নিছক কৃষকের লড়াই নয়, এ লড়াই জাতীয় মুক্তির লড়াইও বৈকি!  দোহাই

১. লিও তলস্তয়, হাজি মুরাদ, আকবরউদ্দীন অনূদিত (ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪)।

2. M. Yu. Lermontov, A Hero of Our Time, D.J. Richards, ed. (London: Buitol Classical Press, 1994).

3. V. Shklovsky, Lev Tolstoy, Olga Shartse, trans. (Moscow: Progress Publishers, 1978).

4. Leo Tolstoy, Hadji Murat, Hugh Alpin, trans. (London: Hesperus Press, 2003).  

লেখক : অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর