সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভারদের চাই চাকরি ও নিয়োগপত্র

শিমুল মাহমুদ

দেশব্যাপী সর্বগ্রাসী সড়ক দুর্ঘটনায় যানবাহনের ড্রাইভারদেরকেই দায়ী করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ড্রাইভাররাই যাবতীয় দুর্ঘটনার হোতা। এই একটিমাত্র লক্ষ্যবস্তুকে সামনে রেখে ঘুরপাক খাচ্ছে সড়ক নিরাপত্তার সব আলোচনা। অথচ দুর্ঘটনার জন্য ড্রাইভারদের দায় দায়িত্বের পাশাপাশি আরও অনেক কার্যকারণ সম্পৃক্ত। সেসব কার্যকারণ উপেক্ষা করে শুধু ড্রাইভারদের ওপর দোষ চাপালে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ হবে না।  

দেশে প্রায় ২৯ লাখ যানবাহনের বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে প্রায় ১৭ লাখ। তার মানে কমপক্ষে ১২ লাখ গাড়ির চালকের বৈধ কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তারপরও তারা কোনো না কোনো উপায়ে রাস্তায় গাড়ি চালান। দেশের সরকারি যানবাহন এবং ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের বাদে বাকি বাণিজ্যিক যানবাহন চালকদের নির্ধারিত মাসিক কোনো বেতন নেই। অথচ সড়ক পথের সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো বিপুল সংখ্যক জানমালের দায়িত্ব নিয়ে তাদের চালাতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি কোম্পানির অধিকাংশ ড্রাইভারের নিয়োগপত্র থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের কোনো নিয়োগপত্র থাকে না। তারা মাস শেষে বেতন, নির্ধারিত উৎসব বোনাস হয়তো পান কিন্তু তাদের ধারাবাহিক চাকরির নিশ্চয়তা সম্পর্কিত কোনো নিয়োগপত্র নেই। অন্যদিকে দেশব্যাপী হাজার হাজার বাস ট্রাক চালকের তো কোনো নিয়োগপত্রই নেই। মাস শেষে তারা একটি নির্ধারিত অঙ্কের বেতন পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা একদিন হয়তো হাজার টাকা আয় করেন, অন্যদিন কোনো কাজই থাকে না। এসব ড্রাইভারের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। যেদিন আয় বেশি সেদিন খরচ বেশি হয়ে যায়। মালিককে দিয়ে, তেলের খরচ, চাঁদার খরচ, সার্ভিসিংয়ের খরচ দিয়ে তাদের হয়তো সামান্যই হাতে থাকে প্রতিদিন। সারা দিন মোটা অঙ্কের কাঁচা টাকা নাড়াচাড়া করেও তাদের সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। প্রয়োজনীয় মোটিভেশনের অভাবে তারা নেতিবাচক গ-িতে আটকে থাকে। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো থাকতে পারে না। পাওনাদার তাদের পিছু ছাড়ে না। অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা তাদের তাড়া করে বেড়ায়। এত দুশ্চিন্তা নিয়ে কীভাবে গাড়ি চালাবে একজন ড্রাইভার? এ জন্যই বাড়তি আয়ের আকাক্সক্ষায় তারা চুক্তিতে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। বেশি যাত্রীর জন্য রাস্তায় অন্য বাসের সঙ্গে রেষারেষি করে। চলন্ত গাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে মাঝ রাস্তায় যাত্রী তোলে। তার মাথা থেকে বেশি আয়ের চিন্তা দূর করতে হবে। মাস শেষে তার নির্দিষ্ট বেতনের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। একজন গাড়ি চালককে সর্বদা চোখ, কান, মস্তিষ্ক, হাত, পা সক্রিয় রাখতে হয়। একসঙ্গে এতগুলো প্রত্যঙ্গের ব্যবহার করেই তাকে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি চালনা যে কোনো কায়িক পরিশ্রমের চেয়েও কষ্টকর একটি কাজ। গাড়ি চালনা একটি বিশেষ কৌশলের ব্যাপার। কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে মানবিক উৎকর্ষতার ব্যাপার। তাই গাড়ি চালককে উপেক্ষা, অবজ্ঞার কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, সমাজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী ও বিচক্ষণ মানুষজনই ড্রাইভার হন। তাদের একটু ভালো প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন দিতে পারলে, আর্থিক নিশ্চয়তা ও সড়ক পরিবেশ দিতে পারলে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। শুধু ড্রাইভারদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল উঁচিয়ে আমরা দুর্ঘটনা রোধ করতে পারব না। চাকরির নিয়োগপত্রহীন, আর্থিক সঙ্গতিহীন হাজার হাজার বাণিজ্যিক যানবাহনের ড্রাইভার অনেক কষ্টের জীবনযাপন করেন। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তার মাথাটা কিন্তু সবার আগে থাকে। তার জীবনটা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তার চাকরির নিশ্চয়তা নেই। বেতন ভাতার নিরাপত্তা নেই। অসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এমনকি কাজের ফাঁকে বিশ্রামেরও সুযোগ নেই। এই ড্রাইভারদের নিয়ে ভাবার মানুষও খুব বেশি নেই। তাদের পরিবারের মানুষদের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। কীভাবে তার সংসার চলে সে খবর কোনো পরিবহন মালিক নেন না। নগর পরিবহনে যারা বাস চালান কিংবা মহাসড়কের দূরপাল্লায়, তাদের ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। তারা শত শত যাত্রীকে নির্বিঘেœ গন্তব্যে পৌঁছে দেন। আমরা যাত্রীরা পেছনে বসে ড্রাইভারকে অনেক উপদেশ দেই। গতি মন্থর হলে গাল দেই। পেছনের গাড়ি ওভারটেক করে সামনে গেলে চৌদ্দগোষ্টি উদ্ধার করি। অথচ বুঝতে চাই না টানা ৭-৮ ঘণ্টা ইঞ্জিনের তাপের ওপর বসে গাড়ি চালানোর পর তার শরীর মনের কী অবস্থা দাঁড়ায়। তাদের অনেকের লেখাপড়া কম। প্রশিক্ষণ নেই। সাধারণ মানুষের মমতাও কম তাদের প্রতি। সেই ড্রাইভারদের অনেকে গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে! ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে-ঝিমিয়ে গাড়ি চালালে তো দুর্ঘটনা ঘটবেই। আমাদের সড়ক পরিবেশটাও তো অনুকূল নয়। ড্রাইভারদের ঘাতক হিসেবে ঢালাওভাবে দায়ী করার আগে তাদের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমরা যারা দৌঁড়ে  রাস্তা পার হই, ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করি না দুর্ঘটনার জন্য তারাও কি কম দায়ী?

দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার দায় চাপছে ড্রাইভারদের ওপর। বিশেষ করে বাস-ট্রাকের চালকদের ওপর। বাড়তি আয়ের আশায় তারা মালিকের কাছ থেকে চুক্তি নিয়ে গাড়ি চালায়। সম্প্রতি এই চুক্তিভিত্তিক প্রথা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মালিক সমিতি। কিন্তু সেটি কার্যকর করা যাচ্ছে না। গাড়ি মালিকদের আন্তরিকতার অভাবে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। ড্রাইভারদের এই চুক্তিতে গাড়ি চালানোর কথা যত বলা হচ্ছে ঠিক ততটাই উপেক্ষা করা হচ্ছে তাদের জীবন-জীবিকার প্রসঙ্গটি। 

রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ হচ্ছে চুক্তিতে বাস চালানো। চুক্তিতে গাড়ি চালানো হলে চালকদের বেশি আয়ের তাড়া থাকে। রাজধানীর একাধিক বাসের চালক বললেন, নির্ধারিত বেতন ঠিক করা থাকলে মাথায় চাপ কম থাকত। নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাতে পারতাম। এখন ট্রিপ অনুযায়ী টাকা পাওয়া যায়। যানজট কিংবা অন্য কারণে ট্রিপ সংখ্যা কমে গেলে সেদিনের আয়ও কমে যায়। এ জন্য বেশি ট্রিপ ও বেশি যাত্রী তোলার চেষ্টা থাকে আমাদের। অন্যদিকে কয়েকজন পরিবহন মালিক বলেছেন, চালকদের নিয়োগপত্র দিতে হলে মালিকের আয়ের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। মালিক নিয়মিত আয় করতে পারলেই চালককে ঠিকমতো বেতন দিতে পারবেন। কিন্তু মালিকের আয় নিশ্চিত করবে কে? এই অনিশ্চয়তা থেকেই মালিকরা চালকের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি চালাতেই পছন্দ করেন। চালককে নিয়োগপত্র দিতে রাজি নন তারা। তারা শুধু বাস বা ট্রাকে বিনিয়োগ করেই মুনাফা তুলতে চান। এ ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। আমরা মনে করি, যিনি কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সড়ক মহাসড়কে পরিবহনের ব্যবসায় নামবেন তাকে দায়িত্ব নিতে হবে। চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের দায়িত্ব নিতে হবে মালিককে। একজন বাস মালিকের কোটি টাকা দামের গাড়িটি যখন ড্রাইভারের তত্ত্বাবধানে থাকে তখন তাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ড্রাইভার আপনার গাড়িটি পাহারা দিচ্ছেন। রক্ষা করছেন দুর্বৃত্তের হাত থেকে। আপনার গাড়ি চালাতে গিয়ে মহা গ্যাঞ্জামপূর্ণ সড়কে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। অনেকে জীবনও দিচ্ছেন। এ জন্যই তাদের মাস শেষে নির্ধারিত বেতন পাওয়ার একটি নিয়োগপত্র থাকা উচিত। ড্রাইভারদের চাকরি ও বেতন নিশ্চিত করা গেলে, তাদের মাথা থেকে বাড়তি আয়ের দুর্ভাবনা দূর করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। পাশাপাশি পরিবহন মালিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবহন ব্যবসাকে শুধু দায়হীন মুনাফার নিশ্চিত বিনিয়োগ ভাবলে হবে না। এদিকে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেছেন, ঢাকার কোনো গাড়ি চুক্তিতে চলবে না। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ব্যবস্থা বন্ধ করতে মালিক সমিতি মাঠে আছে। সময় লাগলেও চুক্তিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হবেই। মালিক সমিতির এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু ড্রাইভারদের নির্ধারিত বেতন ও নিয়োগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা না গেলে চুক্তিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা কঠিন। এই উদ্যোগটিও মালিক সমিতিকেই নিতে হবে। পরিবহন মালিকরা নিজেদের স্বার্থেই চালকদের ভালো রাখার দায়িত্ব নেবেন। দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক নিশ্চিত করতে হলে মালিকদের এই দায়িত্বটি নিতে হবে।

রাস্তায় চলতে গিয়ে আমরা কে কখন লাশ হয়ে ঘরে ফিরব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই এই বাংলাদেশে। এত উদ্যোগ, তৎপরতার পরও এখনো দিনে ৯-১০ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হচ্ছে সড়কে। মানুষের এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ সড়ক চাই বলে মিছিল, সমাবেশ আর রাস্তায় কান্নাকাটি করে সড়ক দুর্ঘটনারোধ করা যাবে না। দুর্ঘটনা প্রশমনে ড্রাইভারদের কাছেই যেতে হবে। তাদের জীবন-জীবিকার খোঁজ রাখতে হবে। তারা খেয়ে পড়ে ভালো থাকছে কিনা সেটির খোঁজ রাখতে হবে। কারণ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হচ্ছেন ড্রাইভার। শেষ করার আগে আরেকটি কথা, নিরাপদ সড়কের জন্য সড়ক পরিবেশটা ঠিক রাখতে হবে। মহাসড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ দেড় শতাধিক ব্ল্যাক স্পট শনাক্ত করে সেগুলো ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু এখনো সড়ক মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নসিমন, করিমনসহ ঝুঁকিপূর্ণ থ্রি হুইলার ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। এগুলো সড়ক দুর্ঘটনায় বড় ভূমিকা রাখে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বছর মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ এসব ছোট গাড়ি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যকর করতে পারেননি। মহাসড়কে মন্ত্রীর কথা কেউ শুনছেন না। আবারও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন বন্ধের কথা উঠেছে। এবার কঠোরভাবে এসব ছোট গাড়ি বন্ধ করতে হবে। কারণ, মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটার গতির একটি যাত্রীবাহী বাসের সামনে দিয়ে যখন নসিমন, করিমনের মতো হালকা যান ছুটে চলে তখন হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। তখন দুর্ঘটনার কবল থেকে দক্ষ ড্রাইভারও রক্ষা পান না।

লেখক :  সাংবাদিক।

 ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর