সোমবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দাওয়াত ও তাবলিগের সংকট অপ্রত্যাশিত

মাওলানা শাহরিয়ার মাহমুদ

বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তির আহ্বান, শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার জাতি হিসেবে মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্ব। এর নামই দাওয়াত ও তাবলিগ। দীর্ঘ দেড় হাজার বছর ধরেই এ কাজ মুসলমানরা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী করে এসেছেন। বর্তমান সময়েও দাওয়াত ও তাবলিগ ইসলামী ভাবধারা প্রচারে কাজ করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বড় আলেম ও পীর। আলেম-উলামাদের মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা এবং ওয়াজ নসিহত ভিত্তিক দীনি কাজকে আরও গণমুখী করার জন্য দেওবন্দ ও সাহারানপুরের আলেম হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ., প্রচলিত তাবলিগ জামাত প্রবর্তন করেন। এর সঙ্গে কোনো দলীয় রাজনীতির সংযোগ ছিল না। নিছক দীনি আবেগ ও কথাবার্র্তার টানে দলমত নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ মানুষ এর সঙ্গে জড়িত হয়। সরল-সহজ ধর্মপ্রাণ মানুষ কোনোরূপ দ্বিধা-সংশয় ছাড়াই তাবলিগ জামাত পছন্দ করে। আলেম-উলামারাও এর উপকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় একে খোলামনে সমর্থন ও সহযোগিতা করেন থাকেন। এককথায় আলেম-উলামাগণই তাবলিগের অভিভাবক, তত্ত্বাবধায়ক ও পৃষ্ঠপোষক।

কিন্তু তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পরবর্তী তিনজন হজরতজি যে নীতি ও আদর্শের ওপর তাবলিগের কাজ চালু রেখেছিলেন বর্তমানে দিল্লি­র নিজামুদ্দীন মার্কাজের মাওলানা সাদ সাহেব এ সব থেকে অনেকটাই বিচ্যুত। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী উলামায়ে দেওবন্দের স্বতঃসিদ্ধ                     চিন্তাভাবনা ও নীতি থেকে অনেকাংশেই দূরে সরে গেছেন। ইলম ও তরিকতের লাইনে পরিপক্ব না হওয়ায় তার দ্বারা অনেক ভুলত্র“টি সংঘটিত হচ্ছে। তাবলিগের কাজকেও তিনি বহুলাংশে নিজ ইচ্ছানুযায়ী বিবর্তিত ধারায় পরিচালিত করছেন। তার চিন্তা-কথা তরিকত ও পীর আউলিয়াবিরোধী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সালাফি ও মওদুদীবাদ প্রভাবিত। এ অবস্থায় তাকে সংশোধনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দিল্লি­ তাবলিগি মার্কাজের সিনিয়র মুরুব্বিগণ এমনকি তার উস্তাদগণও মার্কাজ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আরব, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত ও বাংলাদেশের বিজ্ঞ আলেম ও তাবলিগের মুরুব্বিরা তাকে সংশোধনের আল্টিমেটাম দিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি শূরা বা পরামর্শ পদ্ধতি না মেনে নিজেকে বিশ্ব আমির ঘোষণা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ তার বিতর্কিত চিন্তাধারা ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলেও তিনি সংশোধন হননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরব, আফ্রিকা এমনকি ভারতের তাবলিগি জিম্মাদারগণ তাকে বয়কট করে চলেছেন।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের আলেম সমাজ তাকে সংশোধনের আহ্বান জানান। আল্লামা শফীর নির্দেশে দেশের সব আলেমের পক্ষ থেকে ৪০-৪৫ বড় আলেম কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর জোড়ে গিয়ে ঢাকার দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে মাওলানা সাদ সাহেবের প্রতি তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তারা তাকে নিজের ভুলত্র“টি সংশোধন, দিল্লি­ মার্কাজের মুরুব্বিদের সঙ্গে সমঝোতা ও দেওবন্দের আলেমগণের সঙ্গে বিতর্কিত বিষয়ে সুরাহা না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের ইজতেমায় যোগদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে আলেমগণের পরামর্শ মেনে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় শূরার পক্ষ থেকেও তাকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু একটি মহল যারা সালাফি ও মওদুদীবাদে প্রভাবিত এবং তাদের বিরুদ্ধে আলেম-উলামা বিদ্বেষসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে, তারা যে কোনো মূল্যে মাওলানা সাদ সাহেবকে বাংলাদেশে উপস্থিত করে তার নেতৃত্ব ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ওঠেপড়ে লেগেছে। যার ফলে ভবিষ্যতে তাবলিগ জামাত ও আলেম সমাজ মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাসহ বিশ্ব ইজতেমায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরবর্তীতেও এর প্রতিক্রিয়ায় তাবলিগ ও আলেম-উলামা পীর-মাশায়েখ এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যেও স্থায়ী মনান্তর ও অসন্তোষ বিরাজ করবে, যা সমাজে অস্থিরতার কারণ হতে বাধ্য। একজন বিতর্কিত ব্যক্তির জন্য বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করা কাম্য হতে পারে না। অতএব, বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এবং কাকরাইল মার্কাজের শূরা হজরতগণ একমত না হওয়া পর্যন্ত মাওলানা সাদ সাহেবকে বিশ্ব ইজতেমা ও জোড় ইত্যাদিতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত রেখে এবং বিতর্কিত সাদ সাহেবের কর্মকা- বাংলাদেশে স্থগিত রেখে দেশের উলামা সমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের আশ্বস্ত করা, টঙ্গী ইজতেমার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং তাবলিগ জামাতকে ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারের হাতিয়ার হতে না দেওয়া- সময়ের দাবি।

            লেখক : ইসলামী গবেষক।

সর্বশেষ খবর