বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের পর্যটনে চাই টেকসই উন্নয়ন

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

বাংলাদেশের পর্যটনে চাই টেকসই উন্নয়ন

প্রকৃতির অপরূপ নান্দনিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পর্যটন। বাংলাদেশ আকর্ষণীয় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক-বাহক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ দেশে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। আগামীকাল ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বা স্লোগান হলো ‘পর্যটন ও ডিজিটাল রূপান্তর’। পর্যটন বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.২ বিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৮ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটনশিল্পকে তাদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে রূপান্তর করলেও বাংলাদেশ সে তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছে। অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ যার প্রাকৃ-তিক রূপবৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। অথচ সঠিক প্রচারের অভাবে বিশ্বের অনেক পর্যটক এ সম্পর্কে জানেন না। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এর মোট বনভূমির ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ ভারতের মধ্যে। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এ বনের জীববৈচিত্র্য এটিকে পৃথিবীর অন্য যে কোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্ররূপে উপস্থাপন করেছে। সুন্দরবনের নামের সঙ্গে যে বিষয়টি নিবিড়ভাবে জড়িত তা হলো বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনভূমিটিতে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, ডলফিন, সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। তাই তো সুন্দরবন বিশ্বের পর্যটকদের জন্য একই সঙ্গে বিনোদনের যেমন উৎস হয়ে উঠতে পারে, তেমনি হয়ে উঠতে পারে গবেষণার স্থান।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত হলো পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম অখ-িত, অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রসৈকত যা আর পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ বালুকাময় সৈকতটিতে কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতের চেয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা। সমুদ্রসৈকতটিতে প্রচুর দেশি পর্যটক এলেও বিদেশি পর্যটকের আগমন আশানুরূপ নয়। তবে  বর্তমানে কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে নেওয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় বেঁধে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটননগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলবে। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর এতে বাড়তি ২০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক (জালিয়ার দ্বীপ) ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এসব পর্যটন পার্কে প্রায় ৩০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি হবে। আর এসব অঞ্চলে গড়ে তোলা হবে পাঁচ ও তিন তারকা মানের হোটেল, জিমনেসিয়ামসহ অ্যাপার্টমেন্ট, রিসোর্ট, বিনোদন পার্ক, লাইভ এন্টারটেইনমেন্ট থিয়েটার ও মিউজিয়াম, মেগা শপিং মল, সিনেমা হল, বোলিং সেন্টার, ঘূর্ণায়মান রেস্টুরেন্ট, ওয়াটার স্পোর্টস বিচ, গলফ ক্লাব, কেবল কার, নদী ভ্রমণ, মিউজিক্যাল ওয়াটার ফাউনটেইন, অফিস ভবন, পাওয়ার প্লান্ট ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এর সুফল বাংলাদেশ পেতে শুরু করবে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তিনটি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের মূল উপকরণ হলো পাহাড়ঘেরা সবুজ প্রকৃ-তি; যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। পাহাড়, নদী আর ঝরনা এই নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এখানে প্রকৃতি যেমন ভিন্ন তেমনি ভিন্ন এ এলাকার মানুষের জীবনাচার। সব মিলিয়ে পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম।

বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে পর্যটনশিল্পের গন্তব্য। পর্যটন-শিল্পের উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। আর সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আমাদের পর্যটনের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে আমাদের সাহায্য নিতে হবে তথ্যপ্রযুক্তির। ওয়েবসাইট-গুলোকে আমরা এখনো পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারিনি। এসব ওয়েবসাইটকে আরও তথ্যবহুল করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে একটি স্থান থেকে দেশি-বিদেশি সব পর্যটক প্রয়োজনীয় সবরকম তথ্য পেতে পারেন।

 

লৈখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর